চ্যাটজিপিটি প্রযুক্তি ভীতি! লেখনীর আবিষ্কারক মেসোপটেমিয় সভ্যতা কী প্রমাণ দিচ্ছে
২১ শতকের জীবনযাত্রা মানেই প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে চলা। যদিও এই চ্যালেঞ্জ একান্ত আমাদের সময়েরই নয়: ইতিহাসের লিখিত রেকর্ড রাখা যেদিন থেকে শুরু, সেদিন থেকেই রয়েছে। বিভিন্ন সময় যার অংশ হয়েছে প্রাচীন বিভিন্ন উপকথা ও কিংবদন্তি।
বর্তমানে চারিদিকে শোরগোল ফেলেছে, এআই চালিত চ্যাটবট- চ্যাটজিপিটি। লেখনীর ধাঁচই বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এর কারণে। সঙ্গে লেখা-সম্পর্কিত কাজ বা চাকরিও বদলাবে। আর তাতেই তুমুল উত্তেজনা। কারণ, মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার দিকে এবার হাত বাড়াল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। শুধু আমরাই কী নতুন প্রযুক্তি নিয়ে সন্ত্রস্ত? ইতিহাস অন্তত তা বলে না। লেখনীর উদ্ভব ঘটেছিল আজ থেকে চার হাজার বছর আগে। অধুনা ইরাকের প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতাই যার সূতিকাগার। তাই বলা যায়, মেসোপটেমিয়রা আমাদেরও আগে বিশাল এক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে।
পরিবর্তনশীল সময়ে বসবাস
চ্যাটজিপিটি তৈরি করেছে বিশ্বের প্রথমসারির একটি এআই ল্যাব– ওপেনএআই। নভেম্বরে তারা চ্যাটজিপিটি লঞ্চ করে। মাত্র মাস দুয়েকের মধ্যেই ১০ কোটির বেশি মানুষ এটি ব্যবহার করেছে।
বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর মানুষের মতো করেই লিখে দেওয়ার অভূতপূর্ব ক্ষমতার জন্য সকলের মনোযোগ কাড়ছে এই 'লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল'। চ্যাটজিপিটির লেখা দিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় আর চাকরির পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হয়েছেন অনেকে। রায় নির্ধারণে সাহায্য নিতেও এটি ব্যবহার করেছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ার একটি আদালত।
চ্যাটজিপিটি বা এর প্রতিযোগী এআই-চালিত সেবাগুলোর সম্ভাব্য ঝুঁকি আর সম্ভাব্য সুবিধাগুলো নিয়ে গুণকীর্তন– এ দুয়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ যেন মূল আলোচনা। অগ্রসর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, জীবনযাপন ও কাজের ক্ষেত্রকে বদলে দেবে– তা নিয়ে হাজারো তত্ত্ব হাজির করা হচ্ছে।
অথচ শুধু আমরাই নই; প্রাচীন মেসোপটেমিয়াতেও মানব সভ্যতার প্রাথমিক অনেক আবিষ্কার হয়েছে। যা সেই সময় থেকেই যুগান্তকারী সব ধারার সূচনা করে, চিরতরে বদলে দিয়েছে চেনা পৃথিবীকে। আজকের সময়ে বসে শুনতে অতি-সাধারণ মনে হবে, এমন সব আবিষ্কারই কিন্তু হাজার হাজার বছর এগিয়ে নিয়েছে মানবজাতিকে। এক কথায়, উদ্ভাবনগুলো ব্যাপক প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনে মেসোপটেমিয় সভ্যতায়।
মেসোপটেমিয়রা চাকা আবিষ্কার করেছিলেন; কৃষিকাজের সূচনাও তাদের হাত ধরে। অঙ্কশাস্ত্রের প্রাথমিক পথচলা তাদেরই প্রচেষ্টা। নগরায়ন ও পরিবহনের মতো উদ্ভাবনেও তাদের জুড়ি মেলা ভার। এক অর্থে, প্রাচীন বিশ্বের সৃষ্টিশীলতার কেন্দ্রে ছিল মেসোপটেমিয়ার সভ্যতাগুলো। তাদের অসামান্য অগ্রগতির নানান নিদর্শনই ফুটে ওঠে কিউনিফর্ম লেখনীতে, যাকে আজ আমরা বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন লেখন পদ্ধতি বলে জানি।
কিউনিফর্ম লেখার মতো এর ইতিহাসও বেশ জটিল; তবে ধারণা করা হয় অর্থনৈতিক তথ্যউপাত্ত- যেমন দেনা-পাওনা রেকর্ড করতেই এর উদ্ভব। কিন্তু, সময়ের সাথে লেখনীতে বিভিন্ন চিহ্ন ও প্রতীকের সংযোজন বাড়ে। লেনদেনের বাইরেও মাটির ফলকে অন্যান্য বিভিন্ন তথ্য লিখে রাখা শুরু হয়। আর লেখালেখিও হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। এর মাধ্যমে কূটনৈতিক বার্তা আদানপ্রদান থেকে শুরু করে দৈববাণী প্রচার – লেখা হয়েছে সবই। এগুলো আজ বিশ্ব সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীনতম সম্পদ।
প্রযুক্তির সহায়তায় ইতিহাসের মহানায়ক যারা
বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীনতম মহাকাব্য হিসেবে পরিচিত 'গিলগামেশ'। মহাকাব্যের নায়ক গিলগামেশ পৃথিবীর শেষপ্রান্ত এবং তা ছাড়িয়ে আরো বহুদূরের যাত্রায়– পানিতে ডুব দেওয়ার ভার ও নৌকার পালসহ– বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহার করেছেন।
অ্যাসিরিয় বা অসুর সভ্যতা বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু জর্জ উল্লেখ করেছেন, মহাকাব্যের তরুণ এই নায়ক খ্যাতি ও অমরত্বের সন্ধানে করা তার যাত্রায় নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন। এগুলোর সাহায্যে সে যুগে মানুষের অজানা ছিল এমন সব কর্মকাণ্ড– যেমন পালতোলা নৌযানে চলাচল এবং গভীর সাগরে ডুব দিতে সক্ষম হন।
মেসোপটেমিয়ার আরেক রাজকীয় নায়ক হলেন লুগালবান্দা (যিনি অবিশ্বাস্য দ্রুত গতির জন্যও পরিচিত)। প্রযুক্তিকে আরো অগ্রসর করার কৃতিত্ব তাকেও দেওয়া হয়। খনিজ স্ফটিক ঘষে আগুন জ্বালানো এবং রুটি তৈরির পদ্ধতিকে আরো উন্নত করেন লুগালবান্দা। এসব কাজে নতুন উপকরণের ব্যবহার তার ব্যতিক্রমী অথচ উদ্ভাবনী চিন্তাশীলতাকে তুলে ধরেছে।
আবিষ্কার ও অস্পষ্টতা
প্রযুক্তিগত অগ্রসরতা এবং তার ফলে হওয়া সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে উপকারই হয়েছে এমন দাবি কিন্তু স্পষ্টভাবে করা হয়নি মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন সাহিত্যে। যেমন গিলগামেশ মহাকাব্যে দেওয়াল তৈরির উন্নত পদ্ধতির হাত ধরে হওয়া সভ্যতা ও নগরায়নের ক্ষতিকর দিক – প্রাকৃতিক বিনাশ এবং বন্যপ্রকৃতি থেকে মানুষের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াকেও তুলে ধরা হয়।
উঠে এসেছে, সংঘাতের কাজে প্রযুক্তির ব্যবহারের কথা; আর সমাজের প্রভাবশালীদের এর মাধ্যমে বেশি সুবিধাভোগী হওয়ার ঘটনাও।
'ইনমেরকার ও আরাট্টার প্রভূ' নামক সুমেরিয় মহাকাব্যে, এক বীর রাজা তার শত্রুদের উন্নত প্রযুক্তি আবিষ্কার ও প্রয়োগের মাধ্যমে হারান। যার মধ্যে অন্যতম ছিল: মাটির ফলকে তার লিখতে পারার ক্ষমতা।
সার্গনের মহাকাব্যেও এই উদ্ভাবনের ইঙ্গিত রয়েছে বলে মনে করা হয়। যেমন পড়তে পারার অসামান্য গুণে হত্যাচেষ্টা থেকে প্রাণে বেঁচে যান সার্গন।
কিউনিফর্ম সাহিত্যে নতুন প্রযুক্তির এমন বর্ণনার সাথে- আমাদের সমসাময়িক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বিভিন্ন উদ্বেগের মিল রয়েছে। যেমন সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি এবং সাইবার যুদ্ধের কাজে এর ব্যবহারের শঙ্কা করা হচ্ছে।
ইতিহাসের ভবিষ্যৎ!
অতীত ইতিহাস গবেষণা করে আমরা জানতে পারি, সে যুগে মানুষ কীভাবে নতুন প্রযুক্তির সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছে। কীভাবে হাজারো বছর ধরে সমসাময়িক আধুনিক প্রযুক্তিকে গ্রহণ করেছে মানুষ। আধুনিক প্রযুক্তিও আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে বোঝাপড়াকে বিস্তৃত করতে সাহায্য করছে।
কিউনিফর্ম যেমন লেখনীতে বিপ্লবের সূচনা করেছিল, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লেখনীতে তেমনই বিপ্লবের বাহন হয়ে এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এই প্রযুক্তিকে প্রাচীনতম লিপিগুলো উদ্ধারেও ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন 'ফ্রাগমেন্টারিয়াম প্রজেক্ট' এর আওতায়, উন্নততর অ্যালগরিদম দিয়ে ভেঙে যাওয়া মাটির ফলকের কিউনিফর্ম লেখাকে জোড়া লাগানো হচ্ছে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে অনেক সময় সম্পূর্ণ অক্ষত মাটির ফলক মেলেনি, তাই যে অংশটি মেলেনি সেখানে কী লেখা ছিল তার অনুমান করে অ্যালগরিদম।
ফলে অতীত বিশ্লেষণে ঐতিহাসিকরা আরো বেশি বেশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করবেন ভবিষ্যতে। ইতিহাস উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রচলিত কিছু সমস্যা, যেমন বিতর্কিত তথ্যপ্রমাণ এবং তথ্যের উৎস – নিয়ে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের সময়েও তাদের সতর্ক থাকতে হবে।
এছাড়া, বৃহত্তর একাডেমিক ক্ষেত্রেও কীভাবে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত, এখনও তার কোনো গাইডলাইন তৈরি হয়নি। যেমন গত জানুয়ারিতে এক শীর্ষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে, বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লিখতে এআই ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। তবে গবেষণাপত্র সম্পাদনায় এআই টুলস ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে।
প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতাকে কেন স্মরণে রাখা দরকার
প্রাচীনকালে যারা প্রযুক্তিকে রপ্ত করেছিল, সেই মেসোপটেমিয় সভ্যতাগুলোও এসব উদ্ভাবন নিয়ে নানান সমস্যার মুখোমুখি হয়। যেমন তখনকার প্রযুক্তিকে অনেক কাজেই কাঙ্ক্ষিতভাবে প্রয়োগ করা যেত না। ছিল না নির্ভরযোগ্য।
মেসোপটেমিয়ার আক্কাদিয় সাম্রাজ্যকে ইতিহাসের প্রথম বহুজাতিক রাজনৈতিক স্বত্বা বলা হয়। কিন্তু, এই সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনে জলবায়ু পরিবর্তন। অর্থাৎ, প্রযুক্তি তাদের কৃষি ব্যবস্থা, খাদ্য উৎপাদনকে বিরূপ আবহাওয়ার প্রকোপ থেকে বাঁচাতে পারেনি। এমনকী কৌশলী উদ্ভাবক গিলগামেশও নিজের মৃত্যুকে এড়াতে পারেননি।
তারপরও সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে মানবজাতি নানান প্রযুক্তি উদ্ভাবন, রপ্ত ও ব্যবহার করছে। মেসোপটেমিয় মহাকাব্য সাহিত্যে দেখা যায়, নয়া প্রযুক্তি কিছু ব্যক্তিকে চেনা সীমাবদ্ধতাগুলোকে কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করেছে। করেছে নতুন দক্ষতার উন্নয়নে সাহায্য। তবে প্রযুক্তি ও তার জ্ঞান সবাই সমানভাবে পায়নি।
অতীতে মানব সভ্যতাগুলো কীভাবে পরিবর্তিত প্রযুক্তির সাথে মানিয়ে চলেছে, সে সম্পর্কে বোঝাপড়া আমাদের মানবিক সীমাবদ্ধতাকে পুরোপুরি উপলদ্ধি করতে শেখাবে। হয়তো তা আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও প্রস্তুত করে তুলবে।
লেখক: লুই প্রিক সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানীয় গবেষণা সহযোগী