যুদ্ধে রাশিয়াকে সহায়তা দিতে ড্রোনের চালান পাঠাচ্ছে চীন
ইউক্রেনে ব্যবহারের জন্য রাশিয়াকে নিজেদের তৈরি ডুয়েল-ইউজ ড্রোন সরবরাহ করছে চীন। সামরিক-বেসামরিক উভয় ধরনের কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা যায় এমন ড্রোনকে 'ডুয়েল-ইউজ' বা দ্বৈত-ব্যবহারযোগ্য বলা হয়। জাপানভিত্তিক গণমাধ্যম নিক্কেই এশিয়ার এক অনুসন্ধানে এমন চিত্রই উঠে এসেছে। তবে মস্কোকে যুদ্ধ-সরঞ্জাম সরবরাহ করার অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে বেইজিং।
নিক্কেই এশিয়া জানায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এক লাখ তিন হাজার ডলার মূল্যের অন্তত ৩৭টি চীনে তৈরি ড্রোন আমদানি করেছে রাশিয়ান কোম্পানিগুলো। রাশিয়ার কাস্টমস ক্লিয়ারিংয়ে দেওয়া নথিতে এসব পণ্যকে 'বিশেষ সামরিক অভিযানে' ব্যবহারের জন্য করা আমদানি হিসেবে দেখানো হয়। প্রসঙ্গত, ইউক্রেন যুদ্ধকে রাশিয়ায় সরকারিভাবে এ নামেই উল্লেখ করা হয়।
তদন্ত সূত্রে আরও দাবি করা হয়েছে, ড্রোন শনাক্ত ও জ্যাম করার জন্য চীনা কোম্পানিগুলোকে ১২ লাখ ডলার দিয়েছে রাশিয়ান ফার্মগুলো। এছাড়া, মজবুত ও প্রতিকূল পরিবেশে পরিচালনা করা যায় এ ধরনের পার্সোনাল কম্পিউটারের জন্য দিয়েছে প্রায় ৩৭ হাজার ডলার। কাস্টমস নথিতে এ সবকিছুকেই 'বিশেষ সামরিক অভিযানের' সামগ্রী হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যাতে কাস্টমসের গতানুগতিক প্রক্রিয়া ছাড়াই এগুলোর দ্রুত ছাড় করা হয়।
নিক্কেই এশিয়ার প্রতিবেদনে প্রকাশ, ২০২২ সালের মার্চ থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত চীন ২০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের ৩০ হাজারের ওপর ড্রোন রপ্তানি করেছে রাশিয়ায়। তবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের আগপর্যন্ত কাস্টমস নথিতে এগুলোকে 'বিশেষ সামরিক অভিযানের' জন্য আমদানিকৃত সামগ্রী হিসেবে দেখানো হয়নি। উল্লেখ্য, এর কিছুদিন পরই সরকারি কর্মকর্তাদের যুদ্ধ-সরঞ্জামের সরবরাহ বৃদ্ধির নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
এদিকে, ইউক্রেনের রণাঙ্গনে চীনে তৈরি ড্রোন ব্যবহার হচ্ছে এমন অভিযোগ জোরালোভাবে নাকচ করে আসছে চীন। কারণ, রপ্তানির বিষয়টি স্বীকার করলে দেশটির পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে নিক্কেই এশিয়া। ওই কর্মকর্তা বলেছেন, 'যুদ্ধক্ষেত্রে সব ধরনের ড্রোন ব্যবহার পরিহার ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানায় চীন। একইসঙ্গে, আন্তর্জাতিক শান্তি ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় কাজ করারও তাগিদ দেয়।'
এর আগে ২০২২ সালের মে মাসে এশিয়া টাইমস-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের সূত্রে জানা যায়, চীনের ড্রোন প্রস্তুতকারক ডিজেআই রাশিয়া ও ইউক্রেনে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ করেছে। এই সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিয়ে বেশ কয়েকটি বিবৃতি দেয় ডিজেআই। এতে তারা জানায়, বিভিন্ন অঞ্চলের বিধিবিধানের সঙ্গে সম্মতি রাখার বিষয়ে অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনার পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কোম্পানিটি জানায়, তাদের নীতি হলো সামরিক কাজে ব্যবহার বা কারও ক্ষতির পরিকল্পনা রয়েছে এমন গ্রাহকের কাছে পণ্য বিক্রি না করা।
ইউক্রেন যুদ্ধে বিবাদমান দুই পক্ষই ডিজেআই-এর তৈরি ড্রোন ব্যবহার করছে। অনুমোদনহীন এই ব্যবহারের কড়া নিন্দা জানিয়ে কোম্পানিটি বলেছে, 'এ ধরনের ব্যবহার বাণিজ্যিক নীতিআদর্শের পরিপন্থী এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের তৈরি ড্রোন যেন ব্যবহৃত না হয়, তা নিশ্চিত করতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের কাছে ড্রোন বিক্রি বন্ধ রাখবে।'
আকাশ থেকে ছবি, ভিডিও তোলা ইত্যাদি বেসামরিক কাজেই মূলত ব্যবহার হয় ডিজেআই-এর পণ্য। কিন্তু, রাশিয়া ও ইউক্রেন এই সক্ষমতাকে কাজে লাগাচ্ছে গোলন্দাজ বাহিনীর জন্য লক্ষ্যবস্তু শনাক্তে বা চোরাগুপ্তা হামলার পরিকল্পনা করতে। অন্যদিকে, ২৫ কেজির বেশি ওজনের ড্রোন মডিফাই করে আক্রমণের কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে ধারণা করা হচ্ছে, চীন রাশিয়াকে অন্যান্য সামরিক সহায়তা পাঠিয়েছে। যদিও বেইজিং মস্কোকে কী পরিমাণ সহায়তা দিয়েছে তা অস্পষ্ট।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাংক কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর একটি প্রশ্নোত্তর সেশনে পল হেনলি দাবি করেছিলেন, চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন প্রতিরক্ষা কোম্পানি রাশিয়ার সরকারি মালিকানাধীন প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর কাছে নেভিগেশন সরঞ্জাম, জ্যামিং প্রযুক্তি ও যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছিল।
হেনলি তখন বাইডেন প্রশাসনের অবস্থান পুনরায় ব্যক্ত করে বলেন, চীনের এ ধরনের কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে এলে তার জন্য দেশটিকে ফলভোগ করতে হবে।
তবে কার্নেগি রশিয়া ইউরেশিয়া সেন্টার-এর পরিচালক আলেকজান্ডার গ্যাবয়েভ বলেছেন, হেনলির উল্লেখ করা সরঞ্জামগুলোর ক্রয়-আদেশ ইউক্রেনযুদ্ধের আগেই দিয়েছিল রাশিয়া। এ বাণিজ্যে দুই দেশের প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর যারা যুক্ত ছিলেন, তারা যুদ্ধের আগে থেকেই মার্কিন নিষিদ্ধ ব্যক্তির তালিকায় আছেন।
তবে গ্যাবয়েভ উল্লেখ করেন, এর বাইরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনের অন্য কোনো খাতে নতুন নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। আর তেমনটা হলে চীন এটিকে ইউক্রেনযুদ্ধের অজুহাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চীনের প্রতি শাস্তিমূলক নীতি হিসেবেও বিবেচনা করতে পারে।
ইউক্রেনযুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া ও পশ্চিমের মধ্যে চীনের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা একটি জটিল ও সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া। চীন চায় না কোনো দলই এ যুদ্ধে সহজে জিতুক বা সহজেই পরাভূত হোক।
রাশিয়া এ যুদ্ধে হেরে গেলে তা চীনের জন্য তাইওয়ান ইস্যুকে আরও কঠিন করে ফেলতে পারে। কারণ তখন রাশিয়ার হারকে পুঁজি করে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা তাইওয়ান বিষয়ে চীনের প্রতি আরও কঠোর হয়ে উঠবে। এমনকি তাইওয়ানকে আরও উন্নতমানের অস্ত্রও সরবরাহ করতে পারে মার্কিনীরা।
তাই রাশিয়ার এ যুদ্ধে টিকে থাকাটা চীনেরও বৃহত্তর স্বার্থের অংশ। তবে রাশিয়াকে সহায়তা করা এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা — এ মুহূর্তে এ দুইয়ের মধ্যে দৌদুল্যমান পরিস্থিতিতে রয়েছে চীন।
অন্যদিকে রাশিয়ার জয় হলেও চীনের স্বার্থে তার প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়া জয়লাভ করলে পশ্চিমাশক্তি ইউক্রেন থেকে সহায়তা তুলে নেবে বা কমিয়ে ফেলবে।
এ পরিস্থিতিতে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে কোনো শান্তিচুক্তি হলে তাতে ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও জ্বালানি সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের এজেন্ডাও থাকতে পারে। এর ফলে চীনের ওপর রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা আর থাকবে না এবং ইউরেশিয়ায় চীনের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হয়ে উঠবে রাশিয়া।
কিন্তু যুদ্ধ যদি কোনো ফলাফল ছাড়াই বর্তমান পরিস্থিতির মতো করে চলমান থাকে, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে তার সুবিধা পেতে পারে চীন। কোরিয়ান যুদ্ধের মতো কোনো অস্ত্রসংবরণ চুক্তি যুদ্ধের নিষ্পত্তিহীন বিরতি টানতে পারে।
সেরকম হলে নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত ও কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন রাশিয়া ক্রমশ অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক লাইফলাইন হিসেবে চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। আর তাতে রাশিয়ার জ্বালানি ও কাঁচামাল রপ্তানির দামে সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে চীন।
এমন দৃশ্যপটে পশ্চিমাবিশ্বের সঙ্গে ক্রমশ উদীয়মান নতুন স্নায়ুযুদ্ধে রাশিয়া চীনের সমকক্ষ কোনো শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রকাশ তো করতেই পারবে না, বরং চীনের চেয়ে দুর্বল হিসেবেই এটি বিবেচিত হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।