যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ট্যাকটিক্যাল নিউক রয়েছে রাশিয়ার, সেক্ষেত্র জয়-পরাজয় কার?
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক হামলা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। আর এর জন্য বেশিরভাগ দায় বর্তায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অনেকবার আকারে-ইঙ্গিতে, কখনো সরাসরি চলমান যুদ্ধে প্রয়োজনে পারমাণবিক হামলা চালানোর কথা বলেছেন পুতিন।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় যেকোনো ধরনের পারমাণবিক মহাবিপর্যয় এড়াতে যেসব আচরণবিধি যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে গড়ে উঠেছিল, গত ৫০০ দিনে পুতিন সেগুলোর সব অমান্য করেছেন।
প্রথমত, তিনি খুব ভাবলেশহীনভাবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়ে এ ধরনের অস্ত্র সম্পর্কে থাকা ট্যাবুকে ভেঙে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধে বিশ্ব-ঐক্যকে তুচ্ছ করেছেন। এছাড়া তিনি পারমাণবিক ফিশনের ভালো ও খারাপ ব্যবহারের পার্থক্যকের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছেন।
পুতিনকে অনুসরণ করে রাশিয়ার টেলিভিশন, প্রোপাগান্ডা, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, ও সমাজ সবাই পারমাণবিক হুমকিকে স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করেছে। রাশিয়ার একজন প্রখ্যাত প্রতিরক্ষানীতি বিশেষজ্ঞ সার্গেই কারাগানভ বলেছেন, রাশিয়ার প্রতি পশ্চিমাদের ক্রমহ্রাসমান ভয়কে পুনরায় ফিরিয়ে আনার উপায় হচ্ছে ক্রেমলিনের ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক (নিউক) হামলা চালানো।
তকে কারাগানভের মতে, এ পারমাণবিক হামলা ইউক্রেনের ওপরে নয় বরং ন্যাটোভুক্ত পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর ওপর করা উচিত। তিনি দৃঢ়বিশ্বাস করেন, রাশিয়া এভাবে ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক হামলা চালালেও মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট প্রতিশোধ নেওয়ার সাহস দেখাবে না।
সমস্যা হচ্ছে, এক বছরের ব্যবধানে পারমাণবিক ভূরাজনীতির সুর এমন নেতিবাচক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আমার মতো অনর্থবাদীরাও এমন পরিস্থিতি সম্ভব বলে মনে করেননি। এ বছর পুতিন রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে টিকে থাকা সর্বশেষ অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি নিউ স্টার্ট স্থগিত করেছেন। এছাড়া তিনি তার প্রতিবেশী বেলারুশে ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক ওয়ারহেড স্থাপন করেছেন।
গণহারে মানুষ হত্যা না করে যুদ্ধজয়ের উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে ট্যাকটিক্যাল এই ওয়ারহেডগুলো বানানো হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়েই আমি বেশি উদ্বিগ্ন। রাশিয়ার কাছে আনুমানিক এক হাজার ৯০০টি ট্যাকটিক্যাল ওয়ারহেড আছে। এ সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি।
আর ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকিই দিচ্ছেন পুতিন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পুতিন বিশ্বাস করেন, চিরায়ত যুদ্ধে তার বাহিনীর ব্যর্থতাগুলো 'সীমিত পরিসরে' পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে পুষিয়ে নেওয়া যাবে। আর এ অস্ত্র ছোট বলে এর ব্যবহারের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশোধমূলক হামলা চালাবে না বলেও মনে করেন তিনি।
পুতিনের এ ধারণাসমূহ কল্পনাতীতভাবে বিপজ্জনক। এ কথা সত্য যে, পুতিন যদি আগবাড়িয়ে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে রাশিয়ান বাহিনীর ওপর কনভেনশনাল পদ্ধতিতে পালটা জবাব দেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাও সেই হামলা হতে পারে কেবল ইউক্রেনে যুদ্ধরত রাশিয়ান বাহিনীর ওপর।
কিন্তু এমন কোনো দৃশ্যপট তৈরি হলে পুতিন বা তার স্থলে যিনি থাকবেন, তিনি পরাজয়ের আশঙ্কার মুখে আরও বেশি ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক হামলা চালাতে উৎসাহী হবেন। এভাবে একাধিক ট্যাকটিক্যাল ওয়ারহেডের জবাব পশ্চিমারা কীভাবে দেবে? বিশেষ করে এসব হামলা যদি ন্যাটোর সীমানায় হয়?
বাস্তবতা হলো, একবার একটি পারমাণবিক ওয়ারহেড বিস্ফোরিত হলে সেটার প্রভাব গেম থিওরি দিয়ে অনুমান করা সম্ভব নয়। একটি বৈজ্ঞানিক সিমুলেশনে দেখা গেছে, রাশিয়া কেবল একটা ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে তার জেরে এক ঘণ্টার কম সময়ে সম্পূর্ণ পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হবে। এ যুদ্ধে চার কোটি ৪০ লাখ মানুষ নিহত ও পাঁচ কোটি ৭০ লাখ মানুষ আহত হবেন।
প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে, রাশিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে যুক্তরাষ্ট্রর উচিত হবে এর ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা বাড়ানো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি হিসাব অনুযায়ীই, নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রাগার 'আধুনিকায়নের' প্রকল্পে আগামী এক দশকে কেবল ছয় বিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে দেশটি।
এছাড়া যুদ্ধজাহাজ থেকে ক্রুজ মিসাইলের মাধ্যমে নিক্ষেপণযোগ্য ট্যাকটিক্যাল নিউক তৈরি করার একটি প্রকল্প বাইডেন প্রশাসন বাতিল করেছে। পুতিন যা করছেন, তার সাপেক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে এসব পদক্ষেপ কি অপরিমাণদর্শী নয়?
আদতে না। কোনো শক্তির পক্ষে অনির্দিষ্টসংখ্যক ট্যাকটিক্যাল নিউক হামলা চালানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন ওয়াশিংটনের আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশন-এর প্রধান ড্যারিল কিম্বাল। এ ধরনের হামলার ক্ষতি এত তাড়াতাড়ি এত মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছাবে যে, এটি হয় খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাবে অথবা তা স্ট্র্যাটেজিক পারমাণবিক হামলা তথা পারমাণবিক মহাবিপর্যয়ে পরিণত হবে। তাই কয়েক ডজনের বেশি ট্যাকটিক্যাল নিউক থাকার কোনো সামরিক যৌক্তিকতা নেই।
আবার ট্যাকটিক্যাল ও স্ট্র্যাটেজিক; পারমাণবিক অস্ত্রের এ ধরনের প্রকারভেদও খুব একটা সহায়ক কিছু নয়। স্নায়ুযুদ্ধের সময় পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র যখন আলোচনা শুরু করেছিল, তখন কোন অস্ত্র রাখা হবে আর কোনটি বাদ দেওয়া হবে — তা নির্ধারণ করার জন্য এ দুটি শ্রেণি তৈরি করেছিল দেশদুটো। পারমাণবিক অস্ত্র যে ধরনেরই হোক না কেন, পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণের যুক্তি সবসময়ই একই থাকে।
দীর্ঘমেয়াদি দৃশ্যপটকে আরও জটিল করে তুলছে চলমান নতুন অস্ত্র-প্রতিযোগিতা। চীনের কাছে প্রায় ৪১০টি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সমতায় পৌঁছানোর পাশাপাশি এ দশকেই এ ভান্ডার বাড়িয়ে এক হাজার করার পরিকল্পনা করছে দেশটি। অবশ্য তার মানে এ নয় যে চীন এক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত একটি অস্থিতিশীল ফ্যাক্টর।
কিন্তু চীনের এ উচ্চাকাঙ্ক্ষা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে। চীন যদি পারমাণবিক পরাশক্তি হয়, তাহলে সার্বিকভাবে এটি একটি 'ত্রি-রূপী সমস্যা'য় পরিণত হবে।
যুক্তরাষ্ট্র চীন আর রাশিয়াকে আলাদা হুমকি হিসেবে বিবেচনা করবে, নাকি জোটবদ্ধ শত্রু হিসেবে? সেক্ষেত্রে আমেরিকাকে নাটকীয়ভাবে এর পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার বাড়াতে হবে। আর তার ফলে দেশটির অর্থনীতির ওপর মারাত্মক চাপ পড়বে। আর যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্র বাড়ালে চীনও নিজেদের উৎপাদন বাড়াতে উতলা হয়ে উঠবে।
এর সঙ্গে রয়েছে পারমাণবিক বিস্তারের ঝুঁকি। উত্তর কোরিয়া এর পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার বাড়াচ্ছে। ফলে দক্ষিণ কোরিয়াও তার পারমাণবিক অস্ত্রসংখ্যা বাড়াতে পারে। ইরান যদি নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র বানায়, তাহলে সৌদি আরব, তুর্কিসহ ওই অঞ্চলের অন্যরাও একই পথ অনুসরণ করবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।