এই মুহূর্তে যুদ্ধ শেষ হলেও ইউক্রেনকে অর্ধ-লাখ কোটি ডলার দিতে হবে আমেরিকাকে
ধরুন আগামীকালই শেষ হলো- ইউক্রেন যুদ্ধ। তারপরও দেশটিকে সহায়তা হিসেবে শত শত বিলিয়ন ডলার দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। এরমধ্যে আছে সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখা, বাজেট সহায়তা এবং যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশটি পুনর্গঠনের ব্যয়।
সম্প্রতি প্রতিনিধি পরিষদের (কংগ্রেস) কাছে ইউক্রেনের জন্য ২৪ বিলিয়ন ডলারের সহায়তার অনুমোদন চেয়েছে বাইডেন প্রশাসন। যার সিংহভাগই সামরিক সরঞ্জামের জন্য, তবে ৭৩০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা এর অন্তর্ভুক্ত।
এদিকে অন্তহীন সংঘাতে বস্তা বস্তা টাকা অনর্থক ঢালা হচ্ছে এমন বিশ্বাস দানা বাঁধছে কংগ্রেসে। কিন্তু, যুদ্ধ শেষে যে সহায়তা দিতে হবে তার তুলনায় এটি সিন্ধুতে বিন্দুর মতোই সামান্য।
যুদ্ধের এক বছরের (২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) ক্ষয়ক্ষতির তথ্য বিশ্লেষণ করে ইউক্রেন পুনর্গঠনের ব্যয় প্রাক্কলন করেছে বিশ্বব্যাংক। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক বৈশ্বিক দাতাসংস্থাটির মতে, এই এক বছরের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আগামী ১০ বছরে পুনর্গঠন ব্যয় বাবদ ৪১১ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে দেশটির।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ক্ষতির হিসাব করলে এই হিসাব আরো বেশি হবে। তাই ধরা যাক, এই মুহূর্তে যুদ্ধ শেষ হলে- ইউক্রেনকে পুনর্গঠনে ব্যয় করতে হবে কমবেশি ৬০০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, অর্ধ-লাখ কোটি ডলারের বেশি দরকার হবে দেশটির।
সেই তুলনায়, ইরাক পুনর্গঠন কর্মসূচি ছিল মাত্র ৬০ বিলিয়ন ডলারের। আর ১২ বছর ধরে আফগানিস্তানে তাদের পুতুল সরকারকে ৯০ বিলিয়ন ডলার এ ধরনের সহায়তা দেয় যুক্তরাষ্ট্র (যদিও দেশটিতে এসময় যুদ্ধ চলছিল)।
আফগানিস্তানকে দেওয়া বেশিরভাগ সহায়তাই হয় লুটপাট হয়েছে, নাহলে তা আমেরিকার শত্রু তালেবানের হাতে চলে গেছে। মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান ত্যাগের সময়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধ-সরঞ্জামও ফেলে আসে, যা এখন তালেবান যোদ্ধাদের দখলে।
দুর্বল পরিকল্পনা, বাজে ব্যবস্থাপনা এবং সীমাহীন দুর্নীতির কারণে ইরাককে দেওয়া বেশিরভাগ মার্কিন সহায়তাও বিফলে গেছে।
কিন্তু, তাতো কিছুই নয়, ইউক্রেনকে বার্ষিক ৬০ বিলিয়ন ডলার দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের। এটা জেনেও যে, এই অর্থের বেশিরভাগই দুর্নীতির ফলে লোপাট হবে। তারপরও, ১০ বছর ধরে চালিয়ে যেতে হবে অর্থায়ন।
ইউক্রেনকে যতদিন দরকার আর্থিক সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে জার্মানি। বছরে ৫ বিলিয়ন ডলারের অঙ্গীকার করেছে বার্লিন। কিন্তু, বর্তমান জার্মান সরকার ক্ষমতায় হয়তো বেশিদিন নেই। পরবর্তী সরকার কিয়েভের প্রতি উদারহস্ত হবে– তারও নেই কোনো নিশ্চয়তা। ফলে বার্লিনের অঙ্গীকারও অচল টাকার মতই মূল্যহীন।
যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিও ঘোর অনিশ্চিত, ফলে ভবিষ্যতে কিয়েভের পেছনে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করাটা লন্ডনের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। আখেরে এই বোঝার সিংহভাগটাই আমেরিকার ওপর চাপবে।
হয়তো একারণেই ওয়াশিংটনে ক্ষমতার অন্দর মহলের অনেকেই মনে করেন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করাই মঙ্গলজনক। কারণ যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে আমেরিকাকে শুধু সামরিক সরঞ্জাম এবং ইউক্রেন সরকারকে বাজেট সহায়তা দিতে হবে, পুনর্গঠনের বিপুল খরচের ধাক্কা সইতে হবে না।
কার্যত এটাই বাইডেন প্রশাসনের ইউক্রেন-নীতি। বাইডেনের সরকার মনে করছে, ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে তারা প্রতিনিধি পরিষদকে রাজি করাতে পারবে। সরকারি কর্মীদের বেতন বাবদ কিছু টাকা ও অস্ত্র, রসদ দিয়ে ইউক্রেনকে হয়তো 'বাঁচিয়ে' রাখা যাবে।
কিন্তু, কংগ্রস কি অন্তহীন যুদ্ধের পেছনে ব্যয় অব্যাহত রাখতে চাইবে? একটি বিষয় স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা জানতে চাইবেন, কীভাবে এসব অর্থ ব্যয় হচ্ছে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কীভাবে তার হিসাব দিচ্ছে।
বেশিরভাগ মার্কিন নাগরিক ইউক্রেনকে আরো সহায়তা দেওয়ার বিপক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনী মওসুম শুরু হচ্ছে, খুব শিগগিরই রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হবে। বিতর্কের অন্যতম বিষয়বস্তু হবে ইউক্রেন। এছাড়া রবার্ট কেনেডি জুনিয়রের মতো কিছু ডেমোক্রেট রাজনীতিবিদও এই যুদ্ধকে সমর্থন দেওয়ার বিপক্ষে বক্তব্য দিচ্ছেন।
এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, প্রতিনিধি পরিষদকে রাজি করানো বাইডেনের জন্য বড় সমস্যা হবে। নিশ্চিত পরাজয়ের পেছনে ব্যয় অব্যাহত রাখার বিষয়ে সহকর্মী ডেমোক্রেটদের বোঝাতেও বিড়ম্বনা বাড়বে প্রেসিডেন্টের।
ইউক্রেন একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ একথা দীর্ঘদিন ধরেই কারো অজানা নয়। জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের অনেক রাজনীতিক অবৈধ এ আয়ের কিছু অংশ বিদেশে পাচার করেছেন। টাস্কনিতে সমুদ্রতীরে একটি ভিলা রয়েছে জেলেনস্কির, যা তিনি রাজনীতিতে আসার আগেই কিনেছিলেন। এখন সেটি রুশ গ্রাহকদের কাছে মাসিক ১২ হাজার ডলারে ভাড়া দিচ্ছেন।
এদিকে চীন ও ইউক্রেনের সঙ্গে হান্টার বাইডেনের ব্যবসায়িক চুক্তি নিয়েও তদন্ত হচ্ছে। প্রতিনিধি পরিষদের রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাদের সংখ্যাধিক্য থাকা একটি কমিটি এই অনিয়মের সাথে প্রেসিডেন্টের কোনো সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা- সেদিকটাও অনুসন্ধান করতে চায়।
এই অবস্থায় দুর্নীতিগ্রস্ত একটি সরকারকে অর্থ সাহায্যের ঝুঁকি কি নেওয়া যাবে? যদি যুদ্ধ বন্ধ হয়, আর ইউক্রেন পুনর্গঠনের জন্য সহায়তা দেওয়া শুরু হয়– তাহলে কিয়েভের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতারা নিশ্চিতভাবেই নিজেদের পকেট ভারী করতে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের সুযোগ নেবেন।
ইউক্রেনে দুর্নীতির চিত্র অত্যন্ত দৃশ্যমান। চলতি মাসেই ঘুষের বিনিময়ে তরুণদের সেনাবাহিনীতে ভর্তি এড়ানোর সুযোগ করে দেওয়ায় – সব অঞ্চলের প্রধান নিয়োগ কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করেছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি।
এসব দুর্নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ব্যয়বহুল অপারেশন হতে চলেছে ইউক্রেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্শাল প্ল্যানের আওতায় ইউরোপের দেশগুলো পুনর্গঠনে ১৩.৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছিল ওয়াশিংটন। ডলারের বর্তমান মূল্যে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭৩ বিলিয়ন। অর্থাৎ, ইউক্রেন পুনর্গঠনে যা দরকার, তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
ইউক্রেনকে পুনর্গঠনে যুক্ত হয়ে নিজেদের পকেট ভারী করার সুযোগ আছে মার্কিন কোম্পানিগুলোর। এজন্য তারা হয়তো জোরালো দেনদরবারও করবে। তার সাথে প্রতিরক্ষা খাতের চিরাচরিত লবি গ্রুপগুলো থাকবে।
ইরাককে ধবংস করে তথাকথিত পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয় আমেরিকা। তার ফলাফল বিশ্ববাসীর দেখেছে। যেসব রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট আইনপ্রণেতা যুদ্ধের অবসান চান – তাদের প্রলুদ্ধ করতে পারে এসব লবিস্টরা। কিন্তু, তা কি আমেরিকান ভোটারদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট হবে?
আমেরিকানরা ন্যায্যভাবেই প্রশ্ন তুলবেন: করদাতাদের ওপর বিপুল ব্যয় চাপানো এই অহেতুক ব্যয় কেন?
যুক্তরাষ্ট্রের ইউক্রেন নীতি অনেক দিন থেকেই একটি বিপর্যয় হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু, তারমধ্যে অন্যতমটি হচ্ছে, অন্তহীন এই দুষ্কর্মের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার ঢালার মূল্য।