ব্রিকস-এর ভবিষ্যৎ কী হবে? আগামী ১ বছরেই স্পষ্ট হয়ে যাবে
সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস দেশগুলোর শেষ হওয়া ১৫ তম সম্মেলন আন্তর্জাতিক মহলের নজিরবিহীন মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। কেউ কেউ এটিকে ১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুংয়ে হওয়া জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সূচনা-সম্মেলনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মনে হচ্ছিল, নতুন প্রজন্মের একদল বিশ্বনেতা মার্কিন নেতৃত্বাধীন ওয়ার্ল্ড অর্ডারের বিকল্প তৈরি করতে নেমেছেন।
তবে এ সম্মেলনের নেতাদের কিছু কার্যক্রম প্রশ্নও উত্থাপন করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার একটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, স্বাগত দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বিমানবন্দরে উপস্থিত না থাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিমান থেকে নামতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
অন্যদিকে উদ্বোধনী এক অনুষ্ঠানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভিডিওর মাধ্যমে বক্তৃতা দিলেও কোনো অস্বাভাবিক কারণে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার নির্ধারিত বক্তৃতা দিতে পারেননি।
যুদ্ধাপরাধের কারণে গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কায় পুতিন দেশ ছেড়ে সম্মেলনে আসেননি, তবে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য তিনি পাশ্চাত্যকেই দোষারোপ করেছেন। শি তার বক্তৃতায় 'হেজিমনি ধরে রাখতে মরিয়া' ও চীনের উত্থানকে বাধাগ্রস্তকারী একটি দেশের নিন্দা করেছেন। তিনি কোনো দেশের নাম নেননি, তবে কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইঙ্গিত করেছেন তা বোঝা অসম্ভব নয়।
এ সম্মেলনে ব্রিকস নতুস সদস্য যুক্ত করেছে। এ গোষ্ঠীর নব্যসভ্যদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য চোখে পড়ে। ব্রিকস-এর নতুন সদস্যের মধ্যে যেমন রয়েছে সংকটের পাকে পড়া আর্জেন্টিনা ও ইথিওপিয়া, তেমনি আছে তেলসমৃদ্ধ ধনী দেশ সৌদি আরব এবং কিছুদিন আগেও এটির সঙ্গে অহিনকুল সম্পর্ক থাকা ইরান।
ব্রিকস কোন ধরনের বিকল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। এ নিয়ে হয়তো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যেত যদি পূর্বনির্ধারিত একটি সংবাদ সম্মেলন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু বুধবার সেটি বাতিল করা হয় — সাংবাদিকদের খানিকটা 'বিশ্রাম' দিতেই এমন সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছিলেন রামাফোসা।
তাহলে ব্রিকসকে নিয়ে এখন আমাদের কী ভাবা উচিত? দশকব্যাপী চলে আসা মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে নাড়া দিতে ব্রিকস-এর সক্ষমতাকে কি একটু বাড়িয়ে দেখা হচ্ছে?
পাশ্চাত্যের ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির পুনর্ভারসাম্য আরও এক শতক আগেই হওয়ার কথা ছিল, যখন থেকে ইউরোপ প্রথমবারের মতো মহাযুদ্ধে যোগ দিলো। কিন্তু একদল পশ্চিমা সাংবাদিক ও বিশ্লেষক আছেন যারা ইতিহাসের এ মৌলিক প্রগতিশীলতাকে সবসময় একটু বাড়াবাড়ি ভাবেই ব্যাখ্যা করারই প্রবণতা দেখিয়েছেন।
ইউরোপীয় সাম্রাজ্যগুলোর পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র এর কর্তৃত্ববাদী অবস্থান লাভ করে। এ পরিবর্তন বিশ্ব সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মধ্যে তাদের মৌলিক অনুমানও তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময় স্নায়ুযুদ্ধে জড়িত থাকা এ শেষতক সাফল্যলাভ পশ্চিমাদের এতটাই আসক্ত করে রেখেছিল যে, তারা ২০ শতকের আরেকটি আরও বড় ও প্রভাবশালী ঘটনা — বি-উপনিবেশায়নের — প্রতি মনোযোগ দিতে পারেনি।
পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আলাদা হওয়ার পর এশিয়ান, লাতিন আমেরিকান ও আফ্রিকান দেশগুলোর নিজেদের অতীতের সম্পদ ও শক্তির কিছুটা পুনরার্জনের সম্ভাবনা সবসময় ছিল। তাই ডলারের বৈশ্বিক প্রভাবও কিছুটা কমে আসার নিয়তি অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। আর বিশ্বায়নের এ যুগে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়ার মতো শ্রমশক্তিসম্পন্ন বৃহৎ দেশগুলোকে বেশকিছু তুলনামূলক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করারও কোনো উপায় ছিল না।
তবে বান্দুং আর প্রিটোরিয়া-জোহানেসবার্গ এক নয়। ১৯৫০-এর দশকে ভারত, মিশর ও চীনের নেতারা বিশ্ব-ঐতিহাসিক উপনিবেশবিরোধী ও জাতীয়মুক্তির আন্দোলন থেকে সদ্য সদ্য উঠে এসেছিলেন। এ নেতারা বর্ণবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর দখলদারিত্ব ও লুটতরাজের ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তারা তখন আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন ন্যায়সঙ্গত আর্থিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে তৈরি হয়েছিল নিউ ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অর্ডার (এনআইইও)-এর মতো কার্যকর পরিকাঠামো।
অন্যদিকে এ সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকায় জড়ো হওয়া স্বৈরশাসক, গলাবাজ, ও যুদ্ধাপরাধীদের না আছে কোনো সম্মান, না আছে বান্দুংয়ের সেই নেতাদের মতো দূরদৃষ্টি। আদতে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা যেন কাজ করার মাঝপথেই শিখছেন কীভাবে ক্রমশ বিপজ্জনক হতে চলা বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে নিজেদের পথ পরিষ্কার করে নেবেন।
ব্রিকস-এর নতুন-পুরোনো সদস্যদের যে 'ভিশন', তা আদতেই স্রেফ স্বার্থপর সুবিধা বই আর কিছু নয় — বৈশ্বিক বাণিজ্য, প্রযুক্তি, ও সামরিক চুক্তিতে নিজেদের দরকষাকষির সক্ষমতা বাড়ানো যা তারা সদর্পে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে ব্যবহার করবে।
এর অন্যথা হওয়ারই কথা না। ভারতের কথাই ভাবা যাক। কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী চীন থেকে সস্তাদরের পণ্য, রাশিয়া থেকে ছাড়মূল্যে তেল, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে সামরিক হার্ডওয়্যার ও প্রযুক্তির স্থানান্তর, এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বিনিয়োগ দরকার দেশটির। তাই মাল্টিপোলার বিশ্বে এসব দেশ বা ব্লকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতো ভারসাম্যপূর্ণ বৈদেশিক নীতি না থাকা ছাড়া ভারতের উপায় নেই।
ভারতের পক্ষে এখনো গ্লোবাল সাউথকে নেতৃত্ব দেওয়ার দাবি করার সময় হয়নি। চীনের হয়তো এক্ষেত্রে কিছুটা প্রভাব ছিল, কিন্তু বিশাল অর্থনৈতিক সংকট সামলাতে গিয়ে চীনও এখন এ ভূমিকা প্রায় হারানোর পথে। আগামী বছর রাশিয়ায় ব্রিকস-এর সবচেয়ে বড় সম্মেলনের আয়োজন করবেন পুতিন। কে জানে, হয়তো ততদিন অপেক্ষা করতে হবে না, তার আগেই বিস্তৃত হওয়া এ নামসর্বস্ব সংগঠনের মাঝখানজুড়ে অর্থহীন এক বিকট শূন্যতা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।