কৃষকের আত্মহত্যা: আধুনিক কৃষি অব্যবস্থাপনার পরিণতি
এখন বোরো ধানের সময়। হাওর ও নিচু অঞ্চল ছাড়া সারা দেশে বোরো ধান সেচের পানি ছাড়া উৎপাদন করা যায় না, এই কথা কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট না হলেও কম-বেশি সবাই জানেন। এই সময় গ্রামে গভীর নলকূপে পানি তোলার শব্দ খুব কানে বাজে। আধুনিক কৃষি পদ্ধতিতে যারা চাষ করে তাদের জমিতে সেচের পানি দেয়া হয়। ধানের দুটি মৌসুম থেকে তিন মৌসুম করার জন্যে ব্যাপক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে। কিন্তু সেচের যে নির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনা আছে, তার সাথে জড়িত আছে কিছু মানুষের ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং প্রভাবশালীদের প্রভাব খাটানোর সুযোগ। মাটির তলার পানি প্রাকৃতিক সম্পদ হওয়া সত্ত্বেও গভীর নলকুপের মালিক হয়ে তারাই পানি নিয়ন্ত্রণ করেন। কৃষক এখানে পানির ক্রেতা মাত্র। ক্ষুদ্র কৃষকের জন্যে এটা খুব বড় সমস্যা, কারণ গভীর নলকূপের পানি পাওয়া এক বড় ধরনের অব্যবস্থাপনার মধ্যেই চলে আসছে। ক্ষুদ্র কৃষক সব সময়ই ভুগছেন, হয়তো তারা আত্মহত্যা করেননি, কিন্তু ধুঁকে ধুঁকে মরেছেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। গত ২৩ মার্চ রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলায় দেওপাড়া ইউনিয়নের ইশ্বরীপুরের গ্রামে অভিনাথ মারান্ডি (৩৬) এবং রবি মারান্ডি (২৭) কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করেছেন। তাঁরা
সম্পর্কে চাচাতো ভাই, অর্থাৎ একই পরিবারের সদস্য। অভিনাথ প্রথমে মারা যান, রবি মারান্ডি একদিন হাসপাতালে ছিলেন, কিন্তু তাঁকেও বাঁচানো যায়নি। তাঁদের এই আত্মহত্যার ঘটনা ব্যক্তিগত পর্যায়ের কোন মান-অভিমান থেকে নয়, এই আত্মহত্যা সেচের পানি ব্যবস্থাপনার অবিচারের কারণে হয়েছে। তাই একে আদৌ আত্মহত্যা বলা হবে, নাকি হত্যা, সেই প্রশ্ন তোলা যায়। আধুনিক কৃষির অব্যবস্থাপনার করুণ পরিণতি বলেও আখ্যায়িত করা যেতে পারে, যার দায় দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে।
পত্রিকায় প্রকাশ (বাংলা ট্রিবিউন ২৪-২৫ মার্চ), স্থানীয় লোকজন, আত্মীয়স্বজন ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ধানক্ষেত শুকিয়ে যাওয়ায় পানি দেওয়ার জন্য ১০-১২ দিন ধরে অভিনাথ ও রবি বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপের দায়িত্বশীলদের বারবার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেন পানি দিচ্ছিলেন না। এ কারণে তারা ক্ষোভে কীটনাশক পান করেছেন। তারা নিজ ঘরে নয়, গভীর নলকূপের কাছেই কীটনাশক পান করেছিলেন। যদিও নলকূপের অপারেটর পানি দিয়েছেন বলেই দাবি করছেন। তার মতে, ইশ্বরীপুরে বিএমডিএর ২ নম্বর গভীর নলকূপের অধীনে দেড়শ একর জমি ধান চাষের আওতায় এসেছে। তার মতে, 'কোথাও পানির সংকট নেই'। তিনি বুঝতেই পারছেন না 'এরপরও কেন তারা আত্মহত্যা করতে গেলেন'। তিনি বুঝতে না পারলেও অভিনাথ ও রবি আর বেঁচে নেই।
কেউ মনের সুখে আত্মহত্যা করে—এমন ঘটনা বিশ্বে কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। মৃত্যুর আগে অভিনাথ বলেছেন, 'মনের দুঃখে বিষ খেয়েছি।' মৃত্যুর আগে অভিনাথের বলা এই কথা তার একভাই তদন্ত কমিটিকে বলেছেন। যেকোনো ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, কিন্তু সেই তদন্তের অপেক্ষায় না থেকেও বলা যায়, অভিনাথ ও রবির আত্মহত্যা এই সেচ ব্যবস্থার সাথেই জড়িত। তদন্ত হতে হলে সেই সব বিষয় নিয়েই বিস্তারিত জানতে হবে। শুধু একজন সেচ অপারেটরের কার্যকলাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। ইতিমধ্যে চার সদস্যের তদন্ত কমিটির সদস্যরা যেভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হচ্ছে মূল কারণ উদঘাটন হবে না। তারা আত্মহত্যার পেছনে পানি না পাওয়ার বিষয় আছে কি না, এমনকি বিষপান করেছেন কি না, তা-ও নাকি মেডিকেল রিপোর্ট দেখে বলবেন। বিষ না খেয়ে থাকলে অভিনাথ এবং রবি কিভাবে মারা গেলেন? তারা মেডিকেল রিপোর্ট দেখার আগেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন বিষ খেয়েছে কি না! অপারেটরের অনিয়ম দেখে হয়তো এই অপারেটরের শাস্তি হয়েও যেতে পারে, কিন্তু বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের পানি পাওয়ার বিষয়ে যে সমস্যা রয়েছে তা নিয়ে কোনো প্রতিবেদন হবে কি না সেটা জানি না। আমাদের সেই প্রতিবেদন পেতে হবে।
নির্দিষ্টভাবে দুই কৃষকের এই আত্মহত্যার ঘটনায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচের পানি সরবরাহের বিষয়টি বোঝা খুব জরুরি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই সেচ কর্মসূচি পরিচালিত হয়। অভিযোগ রয়েছে যে বিএমডিএর গভীর নলকূপের অপারেটররা কৃষকদের জিম্মি করে বোরো ধান চাষের জন্য বিঘাপ্রতি দেড় থেকে তিন হাজার টাকা নিচ্ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুই হাজার টাকার ওপরে নেওয়া হচ্ছে। কৃষকদের টাকা দিতে বাধ্য করা হয়, অন্যথায় পানি দেয়া হয় না। বোরো ধান চাষিরা বিএমডিএর কথা অনুযায়ী কার্ড করতেও বাধ্য হচ্ছেন, কিন্তু এই কার্ডের মাধ্যমেও অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠছে। গভীর নলকূপ দিয়ে সেচের পানি দেয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা যায়। সাংবাদিকদের কাছে কৃষকরা অভিযোগ করেছেন, কেউ ঘরে বসেই পানি পায় কেউ দিনের পর দিন ঘুরেও পানি পায় না। অভিনাথ ও রবি তেমনই বৈষম্যের শিকার হয়েছেন হয়তো। দিনের পর দিন এমন ঘটনায় হতাশ হয়েই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। সেচের পানি দেয়ার এই ব্যবস্থায় সেই বিষয়ে আশংকা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
১৯৯২ সালে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার সমগ্র ২৫টি উপজেলাকে অন্তর্ভূক্ত করে বিএডিসির কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধিনে বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডি) স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিশেবে গঠিত হয়েছিল। তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিত্যক্ত ও অকেজো নলকূপ চালু করতে সক্ষম হয় এবং দাবি করা হয় বরেন্দ্র এলাকা শস্য ভান্ডারে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে বিএমডিএর অধীনে ১৫ হাজার ৫০০-র অধিক গভীর নলকূপের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গে প্রায় লক্ষাধিক হেক্টর জমি সেচের আওতায় এনেছে (বিএমডিএ ওয়েবসাইট)। জাতীয় সংসদে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) বিল-২০১৮ আইন গঠন করে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের সকল জেলায় বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণের জন্য সুযোগ করে দেয়।
অন্যান্য এলাকার তুলনায় বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে থাকায় সাধারণ অগভীর বা শ্যালো নলকূপ দিয়ে সেচ দেয়া যায় না। অগভীর নলকূপ দ্বারা সর্বোচ্চ ২৫ ফুট নিচ থেকে পানি তোলা যায়। তাই বরেন্দ্র অঞ্চলে বিশেষ ধরনের গভীর নলকূপ উদ্ভাবন করা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চল সেচনির্ভর ফসলের উপযোগী এলাকা নয়। এখানে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে পরিবেশের ওপরও চাপ সৃষ্টি করছে। কৃষকরা জানাচ্ছেন, দিনে দিনে পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাচ্ছে। তাই যে পানি এক ঘন্টায় তোলা যেত তা তুলতে লাগছে তিন ঘন্টা। ফলে খরচ বাড়ছে।
এই সেচ ব্যবস্থাপনায় আছে অনেক জটিলতা। বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ সেচের বিনিময়ে কৃষকদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করে। এই অর্থ আদায়ের জন্য ২০০৫ সাল হতে প্রিপেইড মিটার কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। গভীর নলকূপ স্থাপন এর ক্ষেত্রে অপারেটরদের ভূমিকা থাকে। ফলে তারা কৃষকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কৃষকদের অভিযোগ অপারেটররা তাদের জিম্মি করে রাখে। তারা নিজ খুশি মতো কৃষকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে। বলাবাহুল্য, অপারেটরদের অধিকাংশই প্রভাবশালী এবং রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত বলে তাদের ক্ষমতাও বেশি। এমনকি অপারেটররা প্রিপেইড সিস্টেম থাকা সত্ত্বেও কৌশল খাটিয়ে সাধারণ কৃষকদের ভোগান্তিতে ফেলে। কৃষকরা দিনের পর দিন ঘুরেও পানি পান না। এদিকে সেচের পানির খরচ দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে বিঘাপ্রতি ২৫০০ টাকা লাগে। কার্ডে খরচ ঘণ্টায় ২৮০-৩০০ টাকা, কিন্তু পানির স্তর নেমে যাওয়ায় কয়েক ঘণ্টা পানি তুলতে হয়। ফলে খরচ হয়ে যায় ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা। পাশাপাশি সার-কীটনাশকের জন্যে খরচ করতে হয়, সব মিলিয়ে ধান উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ধানের দাম তো তার সাথে বাড়ছে না। অভিনাথ ও রবি আত্মহত্যা করে মরেছেন, কিন্তু সব ক্ষুদ্র কৃষকরাই খরচ জোগাতে না পেরে খরচের
চাপেই 'মারা' যাচ্ছে, তারা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। আর নাহলে জমিতে পানি না দিয়ে ফেলে রাখতে হচ্ছে। এটা কি মৃত্যুর চাইতে কোনো অংশে কম?
আধুনিক কৃষির মূল চরিত্র হচ্ছে উপকরণ-নির্ভরশীলতা । খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির নামে সব জায়গায় একাট্টা ফসলের প্রবর্তন করা হয়। এবং সেটা করতে গিয়ে মৌসুম ও স্থানের সাথে সামঞ্জস্য না থাকলেও উপকরণ, যেমন সার-কীটনাশক ও সেচের পানি দিয়ে তারা উৎপাদন করতে চায়। অনেকটা যেন গায়ের জোরে। বরেন্দ্র অঞ্চল উঁচু জায়গা। এখানে বৃষ্টিনির্ভর আমন ও আউশ চাষ করা যায়, কিন্তু বোরো ধান করার কোনো যৌক্তিকতা ছিল না। এখানে পানির সংকট সবসময় থাকে এবং এই সময় প্রচণ্ড খরা হয়।
গত বছরের (২০২১) পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচকাজের জন্য মাত্রাতিরিক্ত পানি তোলার কারণে সেখানে প্রতি বছর পানির স্তর ২ থেকে ৩ ফুট নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রায় ১৫০ ফুট নিচে পানি পাওয়া যাচ্ছে, যা আগে ৬০ থেকে ৭০ ফুটের মধ্যে পাওয়া যেত। আমরা এটাও জানি যে গভীর নলকূপ দিয়ে পানি তোলার ফলে ভূগর্ভের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আয়রন, আর্সেনিক ও লবণাক্ততার প্রমাণ মিলছে। তারপরও এই গভীর নলকূপ ব্যবহার করে সেচ দিয়ে কেন বোরো ধান করতে হবে, সেই প্রশ্ন উঠছে। সেচের পানি পাওয়ার সম্ভাবনা কমছে। তাহলে কি আরও আত্মহত্যা হতে থাকবে? এবং তদন্ত কমিটি হবে, কিন্তু আমাদের কৃষি ব্যবস্থার গোড়ায় যে গলদ রয়ে গেছে তা দেখা হবে না।
দুই কৃষকের আত্মহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে, এটা ভালো। দাবি উঠছে বিনামূল্যে সেচের পানি দেয়ার, ক্ষতিপূরণ দেয়ার ইত্যাদি। সেচের পানিতে কোনো মূল্য নির্ধারণ করা অনৈতিক, কারণ মেশিনের মালিক হয়ে পানির মালিক হওয়া যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ভূস্তরের গভীর থেকে গভীর নলকূপ বসিয়ে ধান উৎপাদন প্রাণ, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের দিক থেকে আত্মঘাতী পদ্ধতি। এর অবসান হওয়া উচিত। একাট্টা ফসল পদ্ধতির বিপরীতে পরিবেশবান্ধব প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর কৃষির দাবি তোলাই সঠিক গণমুখী দাবি। আত্মঘাতী সেচ ব্যবস্থাপনা বন্ধ করে কৃষকের পাশে দাঁড়ান। সার-কীটনাশক ও সেচনির্ভর আধুনিক কৃষির যুগ শেষ হয়ে আসছে। সেচনির্ভর কৃষি মোটেও কৃষকবান্ধব নয়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ক্ষমতা ও ব্যবসা। আধুনিক কৃষি পদ্ধতি দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির জোগান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কৃষকের জীবন-জীবিকা রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে।
বরেন্দ্র এলাকার উপযোগী ফসল অনেক আছে, বিশেষ করে আম, লিচু উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া পেঁয়াজ, বিশেষ করে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন, মুগডাল এবং ছোলাসহ অনেক স্থানীয় জাতের ফসল রয়েছে। সে পদ্ধতি আমাদের কৃষকদের বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষি ব্যবস্থায় রয়েছে। সরকারের উচিত সেচবিহীন ফসল উৎপাদনে কৃষকদের সহায়তা করা।
- লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী