বুচা-র আসল গল্প সম্ভবত কেউই জানতে চায় না
'যুদ্ধে সবার আগে নিহত হয় সত্য।' গ্রিক নাট্যকার অ্যাসকাইলাসের এই উক্তিটি বহুল ব্যবহৃত। জনপ্রিয়ও। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বলা কথাটা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধেও এ কথার প্রয়োগ দেখা গেছে।
কিয়েভ সরকার ও তার তথ্যযুদ্ধের পশ্চিমা উপদেষ্টারা খুব সম্ভব অ্যাসকাইলাসের কথাটিকে বেদবাক্য বানিয়ে নিয়েছে। তারই জলজ্যান্ত উদাহরণ দেখা গেছে ইউক্রেনের শহর বুচাতে।
বুচা ট্র্যাজেডির মূল উৎস একটি ভিডিও টেপ। ভিডিওটি ধারণ করেছে ইউক্রেনিয়ান ন্যাশনাল পুলিশ। তাতে দেখা যায় ডজনখানেক মরদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে বুচার সড়কে। দেখে মনে হচ্ছিল অনেকগুলো মৃতদেহের হাত-পা বাঁধা।
ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়। বিস্তর রাগ ও ক্ষোভের জন্ম দেয় দুনিয়াজুড়ে। পরিণামে সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হতে থাকে রাশিয়া ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
দেখে মনে হয়, ভিডিওটি প্রকাশ করার উদ্দেশ্য দর্শকদের 'নাড়া' দেওয়া। আসলেই যদি তা-ই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে ভিডিওটি যারা প্রকাশ করেছে—ইউক্রেনিয়ান ন্যাশনাল পুলিশ—তারা কল্পনার চেয়েও বেশি সফল হয়েছে। কিংবা তাদের উপদেষ্টাদের কল্পনার চেয়েও বেশি সফল হয়েছে বলা চলে।
মরদেহগুলোর সঙ্গে তৎক্ষণাৎ রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক স্থাপন করে দেয়া হয়েছে, কোনো ধরনের তথ্য যাচাই-বাছাই ছাড়াই। সব ধরনের গণমাধ্যমেই প্রচার করা হয়েছে, বুচা শহরের ওই মানুষগুলোকে হত্যা করেছে রুশ বাহিনীই। যারাই এ দাবি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের চেষ্টা করেছে, তাদের প্রত্যেককে 'রাশিয়ার দালাল' আখ্যা দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বুচা শহরের ঘটনা নিয়ে অনেকেই তৎক্ষণাৎ সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিলেও তারা খুব সম্ভবত ব্যাপারটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেননি। ইউক্রেনের বর্ণিত এই 'কাহিনি'র কতটুকু সত্য, কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়ে খুব একটা ভাবেননি তারা।
ইউক্রেন ও পশ্চিম আমাদের যে গল্প শোনাচ্ছে, সেই গল্পের ঘটনাপ্রবাহ অনেকটাই খাপছাড়া। এ তথ্য প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, রুশ বাহিনী বুচা ছাড়ে মার্চের ৩০ তারিখে। ইউক্রেনিয়ান ন্যাশনাল পুলিশ শহরটিতে প্রবেশ করতে আরম্ভ করে পরদিন ৩১ মার্চ। ওই দিনই বুচার মেয়র ঘোষণা করেন, শহরটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখন ইউক্রেনেইয়ান কর্মকর্তাদের হাতে।
ওই সময় বুচার মেয়র কিংবা অন্য কোনো ইউক্রেনিয়ান কর্মকর্তাই রুশ বাহিনীর হাতে সংঘটিত কোনো গণহত্যার ইঙ্গিতও দেননি। বিতর্ক উসকে দেওয়া ভিডিওটি ইউক্রেনিয়ান কর্মকর্তারা প্রকাশ করে এপ্রিলের ২ তারিখ। ভিডিওটি আরও আগেই ধারণ করা হয়েছে নাকি ওই দিনই, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কেবল নিশ্চিত হওয়া গেছে, ভিডিওতে দেখানো ছবি সঙ্গে মেয়রের আগের দেয়া বক্তব্যের সম্পূর্ণ উল্টো।
অন্যদিকে ইউক্রেনের সমস্ত অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে রাশিয়া। মস্কোর দাবি, রাশিয়ার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করা হচ্ছে কোনো প্রমাণ ছাড়াই। যেসব ভিডিও দেখানো হচ্ছে, তা ভুয়া বলেও দাবি মস্কোর।
রাশিয়া বলছে, পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম ব্যবহার করে উসকানিমূলক সংবাদ ছড়াচ্ছে ইউক্রেন। এছাড়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি সভা ডাকার অনুরোধও জানিয়েছে রাশিয়া। সেখানে 'ইউক্রেনের এই উসকানিমূলক সংবাদ প্রচার' নিয়ে আলোচনা করবে তারা।
নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সভাপতি গ্রেট ব্রিটেন। রাশিয়ার জরুরি সভা ডাকার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে ব্রিটিশ মিশন। কারণ হিসেবে বলেছে, ৪ এপ্রিল ইউক্রেনের পরিস্থিতি নিয়ে সভা হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানেই বুচা-বিষয়ক সব আলোচনা করা হবে।
অতীতে ইউক্রেনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আলোচনার জন্য স্বল্প সময়ের নোটিশে সভা ডেকেছে নিরাপত্তা পরিষদ। তাই রাশিয়ার অনুরোধে এবারও সাত-তাড়াতাড়ি সভা ডাকা হবে বলেই ভেবেছিল সবাই। কিন্তু ব্রিটিশ মিশন তা করেনি। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, যথাসম্ভব দ্রুত সত্য ও ন্যায়বিচার খুঁজে বের করা ব্রিটিশদের লক্ষ্য নয়—তাদের লক্ষ্য বুচার কথিত গণহত্যা নিয়ে বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালার জন্য আরও সময় আদায় করা এবং রাজনৈতিক বিবাদ আরও বাড়ানো।
এই কৌশলের একটি উদাহরণ হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতিক্রিয়া। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, 'বুচায় কী হয়েছে আপনারা দেখেছেন।' এছাড়া রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে 'যুদ্ধাপরাধী' বলেও অভিহিত করেন।
ইউক্রেনে আরও অস্ত্র সরবরাহ করার অজুহাত হিসেবে বুচা সংকটকে ব্যবহার করেছেন বাইডেন। তিনি বলেন, 'যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য ইউক্রেনকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সরবরাহ চালিয়ে যেতে হবে আমাদের। আর আমাদের সমস্ত তথ্য প্রমাণও জোগাড় করতে হবে, যাতে—যুদ্ধাপরাধের প্রকৃত বিচার হতে পারে।'
ভেবে দেখুন, এমন এক দেশের প্রেসিডেন্ট এই মন্তব্য করেছেন, যে দেশটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি!
প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও ইউক্রেন সরকারকে খুশি করতেই যেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ব্রিটিশ চিফ প্রসিকিউটর করিম খান চলতি বছরের মার্চে ঘোষণা দিয়েছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার হাতে সংঘটিত কথিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত করা হবে। করিম খান সম্ভবত অপরাধস্থলের নিয়ন্ত্রণ নিতে এবং ময়নাতদন্তের তত্ত্বাবধান ও ভুক্তভোগীদের মৃত্যুর সময় এবং কীভাবে মারা গেছেন, তা জানার জন্য ফরেনসিক টিম পাঠিয়েছেন। ভুক্তভোগীদের মরদেহ যেখানে পাওয়া গেছে, তারা আসলেই সেখানে মারা গেছেন নাকি অন্য কোথাও থেকে তাদের দেহ এনে সেখানে ফেলে রাখা হয়েছে, তা জানার দায়িত্বও ফরেনসিক টিমের।
ইউক্রেনিয়ান ন্যাশনাল পুলিশকে—যাদের সঙ্গে কুখ্যাত আজভ ব্যাটালিয়নসহ ইউক্রেনের কট্টর দক্ষিণপন্থীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে—জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষমতাও পাবেন করিম খান।
এ তদন্তের ফলাফলের সঙ্গে সম্ভবত ইউক্রেনিয়ান সরকার ও তার পশ্চিমা মিত্রদের গণমাধ্যমগুলোর দাবির সঙ্গে খুব একটা মিলবে না। মূলত এ কারণেই করিম খান এখনও সশরীরে বুচায় যেতে পারেননি। ধারণা করা যায়, বুচা হত্যাকাণ্ডের প্রমাণাদি যতক্ষণে করিম খানের হাতে তুলে দেওয়া হবে, ততক্ষণে ইউক্রেনিয়ান ন্যাশনাল পুলিশ সেসব প্রমাণাদি এমনভাবে নষ্ট করে ফেলবে যে সেগুলো কার্যত আর কোনো কাজেই আসবে না। কাজেই ইউক্রেনের অভিযোগ যে মিথ্যা, তা প্রমাণ করাও কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।
বুচায় আসলেই কী ঘটেছে, তা এখনও জানা যায়নি। দুর্ভাগ্যবশত, সত্যটা সম্ভবত কেউ জানতেও চাইছে না। প্রকৃত ঘটনা যদি এমন হয় যে, ওই ইউক্রেনিয়ান বেসামরিক নাগরিকরা ইউক্রেনিয়ান ন্যাশনাল পুলিশের হাতে নিহত হয়ে থাকেন—যার দায় এই মুহূর্তে চাপানো হচ্ছে রাশিয়ার ওপর—তাহলে সত্যিকারের ন্যায়বিচার দিতে হলে এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সরকারকেও দোষী সাব্যস্ত করতে হবে।
- সূত্র: আরটি থেকে অনূদিত, ঈষৎ সংক্ষেপিত
- স্কট রিটার: ইউএস মেরিন কর্পসের সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। 'স্করপিয়ন কিং: আমেরিকা'স সুইসাইডাল এমব্রেস অভ নিউক্লিয়ার ওয়েপনস ফ্রম এফডিআর টু ট্রাম্প' বইয়ের লেখক। রিটার সোভিয়েত ইউনিয়নে আইএনএফ চুক্তি বাস্তবায়নে পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ইরাকে জাতিসংঘের প্রধান অস্ত্র পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, সামরিক সম্পর্ক, রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে লেখালেখি করেন।