বাল্যবিবাহ: সামাজিক অনিরাপত্তার আশঙ্কায় হারিয়ে যায় অনেক জেসমিন
জেসমিন খাতুন, দশম শ্রেণির এই কিশোরীর খেলাধুলা এবং পড়াশোনার প্রতি ভীষণ ঝোঁক। তার বাবা–মায়ের ইচ্ছা ছিল, সে যেন বাড়ির কাজে মন দেয়, ঘর সংসার দেখে। কিন্তু জেসমিনের ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। স্কুলে সহপাঠিরা ক্লাস শুরু হওয়ার আগে আর টিফিনের সময় খেলাধুলা করতো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই খেলাই মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখে যেত সে।
একদিন ক্রিকেট খেলায় খেলোয়াড় কম পড়লে বন্ধুরা জোর করে জেসমিনকে মাঠে নামিয়ে দেয়। সেদিন জেসমিনের খেলা দেখে মুগ্ধ হয় তার সহপাঠীরা। এরপর থেকেই স্বপ্ন তার, খেলোয়াড় হবে। অথচ, এই স্বপ্নদ্রষ্টার স্বপ্নপূরণের পথে বাঁধা ছিল অসংখ্য। নবম শ্রেণীতে পা দেয়া মাত্র বাবা-মা যেন নাছোড়বান্দা হয়ে উঠলেন মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য। শেষ পর্যন্ত জেসমিনের জেদ এবং শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ সাহায্যে সেই বিয়েটা হয়নি। স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে চলেছে জেসমিন। আজ সে ৫০তম জাতীয় শীতকালীন বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অ্যাথলেটিকসে চাকতি নিক্ষেপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।।
জেসমিন খাতুনের এই গল্পটি উঠে এসেছিলো দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে জেসমিনের বিজয়গাঁথা উৎযাপন করতে করতেই মনে একটি আশঙ্কা এসে ভর করে আমাদের। এক জেসমিন তো বিজয়ী হলো, কিন্তু অন্য জেসমিনরা? তাদের কী হবে? ইউনিসেফের গবেষণা অনুসারে যে নারীদের বয়স এখন ২০-২৪ বছর তাদের মধ্যে ৫১ শতাংশেরই বিয়ে হয়েছিলো বাল্য বয়সে। তার মানে প্রতি একশো জন জেসমিনের মধ্যে পঞ্চাশ জনের স্বপ্নই খুন হয় অকালে। মনে প্রশ্ন জাগে- কেন এই স্বপ্নের অপমৃত্যু? কেন অতি অল্প বয়সেই এত বড় হয়ে যেতে হয় আমাদের জেসমিনদের?
জেসমিন খাতুনের মা প্রথম আলোকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- 'মেয়ে বড় হচ্ছে। মানুষ নানা কথা বলে, অনেক সময় খারাপ লাগে। তাই বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।'
জেসমিনের মায়ের কণ্ঠে কী ফুটে উঠেছিলো সেদিন? লজ্জা, গর্ব, নাকি ভয়াবহ কোন আশঙ্কা? এই আশঙ্কা সামাজিক অনিরাপত্তার। এই অনিরাপত্তা বোধটাই মেয়েদের অভিভাবকদের হয়তো ঠেলে দিচ্ছে বাল্যবিবাহের মতো প্রলয়ংকারী সিদ্ধান্তে।
সামাজিক অনিরাপত্তাবোধ কখনো ভীষণ মূর্ত, বাস্তব। আমাদের সমাজ যে নারীদের জন্য অনিরাপদ তা কল্পকথা নয়, সর্বৈব সত্য। যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, অপহরণ, জোরপূর্বক বিয়ে বা বিয়ের হুমকি- ইত্যাদি ঘটনা অহরহই ঘটছে আমাদের সমাজে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২১ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এক হাজারেরও বেশি। ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌনহয়রানির ঘটনা ঘটেছে আরো ২৮৬ জন নারীর সাথে। যে যাই বলুক না কেন, নারীর প্রতি নিপীড়নের এই সামাজিক বাস্তবতা সবাই ঠিকই জানে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি নিপীড়নের ধরা-বাধা সামাজিক সমাধান হলো- মেয়েকে ঘরে বন্ধ করে দিন, চলাফেরা সীমাবদ্ধ করে দিন, বা বিয়ে দিয়ে দিন। এর বেশি সমাজের কাছ থেকে কি-ই বা প্রত্যাশা করতে পারছেন আমাদের অভিভাবকরা?
কিছু অনিরাপত্তাবোধ অবশ্য নারী নিপীড়নের মতো মূর্ত বাস্তব নয়, তবে মগ্নমৈনাকের মতো মনের গহীনে তাদের সন্ধান পাওয়া যায়। নারীকে হেয় করা, দুর্বল ও অবলা মনে করা এবং নারীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে খুবই সহজ। তাই খুব সামান্য কারণে রত্মগর্ভা মায়েরা "কন্যাদায়গ্রস্থ" হয়ে ওঠে পাড়ার লোকেদের 'আকথা-কুকথায়'। মেয়ের বিয়ে হয়নি বা হচ্ছেনা- এই বিষয়টি আমাদের সমাজে লজ্জার ব্যপার। কেননা, তখনই নারীর চরিত্রহরণের বড় সুযোগ তৈরি হয়। মেয়ে কোথায় যায়, কার সাথে কথা বলে, প্রেম করে কিনা, অন্য কোন ছেলের সাথে পালিয়ে যেতে পারে কিনা- এই ভয়গুলো সমাজে যতটা আছে, তার চেয়ে বেশি আছে এই বিষয়গুলো নিয়ে কানাকানি হবার ভয়। এর চেয়ে ঢের ভালো মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়া।
বিআইজিডি'র সাসটেইনিং পাওয়ার ফর উইমেন'স রাইটস গবেষণায় একজন এনজিওকর্মী তার মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, পালিয়ে বিয়ে করা একেবারে অভাবিত নয়। তবে এমন ঘটনা খুব বেশি ঘটেনা। মূলত, এই 'মেয়ে নষ্ট হয়ে যাবে' অনিরাপত্তাবোধটাও সামাজিক ভাবে নির্মিত। পাড়া-প্রতিবেশীদের হুঁশিয়ারি ও ভয়-ভীতি, লোকলজ্জা ও কথা পাঁচকান হওয়ার ভয়ে কন্যাশিশুর অভিভাবকেরা এমন ঘটনা ঘটার সুযোগ না দিয়েই বাল্যবিবাহের মতো ভয়াবহ সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছেন।
আরো একটি অনিরাপত্তাবোধ আছে যা সম্পূর্ণরূপেই নির্মিত এবং অবাস্তব। "এমন ছেলে আর কি পাবেন? হাতছাড়া করবেন না। বয়স আঠারো হয়নি তো কি হয়েছে? হবে!" ঘটক, পাড়া-প্রতিবেশী ও তথাকথিত 'শুভাকাঙ্ক্ষীর' এমন বক্তব্য বারবার আমাদের গ্রাম, শহর ও উপশহরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। কন্যার অভিভাবকরাও এমন "সুযোগ্য" পাত্র হাতছাড়া করার ভয়ে ভীত। বিশেষ করে পাত্র যখন প্রতিষ্ঠিত, বিত্তশালী বা ক্ষমতাবান- হাতছাড়া কি আর করা যায়? তাদের ভয়- এরপর ভালো পাত্র আর পাওয়া যাবেনা। বলাই বাহুল্য- ভয়গুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অমূলক।
বাল্যবিবাহ সমস্যার উৎপত্তি সমাজ থেকেই। কাজেই, সামাজিক ভাবেই নিষ্পত্তি সম্ভব বাল্যবিবাহের মতো গুরুতর অভিশাপের। পুরুষতন্ত্রজাত সামাজিক সংস্কৃতিই বাল্যবিবাহের জন্য দায়ী। এই পুরুষতন্ত্র সৃষ্টি করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। যার ফলে নারীর জন্য সমাজ হয়ে উঠে অনিরাপদ। বাল্যবিবাহ তখনই কাটবে যখন মগ্নমৈনাকের মতো ডুব দিয়ে থাকা সামাজিক অনিরাপত্তাগুলো সমুদ্রের গহীনে চিরকালের জন্য বিলীন হবে, যখন সমাজ সোচ্চার হয়ে উঠবে এই অভিশাপগুলোর বিরুদ্ধে। তখন আর ম্লান হবে না একজন জেসমিনের হাসিও। কিন্তু, কবে ভাঙবে এই পুরুষতন্ত্রের অভিশাপ?
লেখক: ইন্টার্ন, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি)