রাষ্ট্র হিসেবে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সঙ্কটে যেভাবে শ্রীলঙ্কা তার নাগরিকদের প্রতি সন্ত্রাসকে ব্যবহার করছে
রাষ্ট্র হিসেবে শ্রীলঙ্কা আজ এক পরিপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের ভেতর তলিয়ে যাচ্ছে; যেহেতু যতই দিন যাচ্ছে ততই এই রাষ্ট্রের নাগরিকদের লড়াই করতে হচ্ছে অনাহার, মৃত্যু এবং গুরুতর নানা সমস্যা ও সঙ্কটের সাথে। সর্বোপরি আজ এই অসহায় নাগরিকদের লড়াই করতে হচ্ছে রাষ্ট্র আরোপিত নিষ্ঠুর সন্ত্রাসের সাথে। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, গত সপ্তাহে সরকার সমর্থক ও বিরোধীদলের মধ্যকার সঙ্ঘর্ষে অন্তত নয় ব্যক্তি নিহত, দুশো আহত হয়েছে এবং প্রচুর ঘরবাড়ি ও যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নয়নাভিরাম এই দ্বীপরাষ্ট্রটি স্বাধীনতার পর মন্দতম অর্থনৈতিক সঙ্কটকাল পার করছে এবং রাষ্ট্রের প্রত্যুত্তরে বোঝা যাচ্ছে যে আসলে সে তার নাগরিকদের রক্ষায় অক্ষম। তবে সামরিক বাহিনীর মোতায়েনের মাধ্যমেই অশান্তির অবসান হবে বলে মনে হয় না। ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষ সেদেশে যে পরিমাণ ক্রোধ ও হতাশা প্রদর্শন করেছেন এবং যা কিনা সরকারপক্ষীয় সমর্থকদের বিক্ষোভে আরো বেড়েছে, সামনে আরো বাড়তে পারে—এবং বিদ্যমান ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি আরো অবিসশ্বাস ও সন্দেহের আগুনে এতে বরং ঘৃতাহুতিই পড়বে।
নাগরিকদের উপর বলপ্রয়োগ
গেল সপ্তাহে সেনাবাহিনীকে 'আইন-ভঙ্গকারীদের' দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেহেতু শহরগুলোর রাস্তায় মানুষ ক্রমাগতই খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধ সঙ্কটে দিশেহারা হয়ে জড়ো হচ্ছিল। রাজনৈতিক এই অস্থিরতার মূল কারণ অর্থনৈতিক নানা সমস্যা, যেহেতু শ্রীলঙ্কার পক্ষে সম্ভাবনা আছে অচিরেই দেউলিয়া হয়ে যাবার। কেননা দেশটির বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ এখন বলতে গেলে শূন্য ও শুষ্ক।
সম্প্রতি যেমনটা আমি 'অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিট্যুট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স'-এ লিখেছি যে দেশটির ২ কোটি ২০ লাখ নাগরিকের এই ভোগান্তির পেছনে মূল কারণ হচ্ছে সরকারি দুর্নীতির ধারাবাহিকতা তথা উত্তরাধিকার, স্বজনপ্রীতি ও দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। বর্তমানে এই দ্বীপ চীণের কাছে দেনায় জর্জরিত এবং সরকার কর্তৃক শুল্ক ছাড়ের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ায় রাষ্ট্রটির পক্ষে আর অধিকতর রাজস্ব সংগ্রহ করাও কঠিন।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসে ২০১৯ সালের নভেম্বরে ক্ষমতা বা দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন মূলত জাতীয় নিরাপত্তা ও সিংহলি-বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী আবেগের উপর নির্ভর করে। সেই থেকে রাজাপাকসে পরিবার ক্রমান্বয়ে আরো বেশি মাত্রায় ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে; গোতাবায়া তার সহোদর মহিন্দা রাজাপাকসেকে (মহিন্দা নিজেও ছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি) প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন এবং অন্য আরো কিছু আত্মীয়কে মন্ত্রিপরিষদের বেশ কিছু পদে নিয়োগ দেন। দেশটিতে সাম্প্রতিক কিছু সাংবিধানিক পরিবর্তনবিরোধী কণ্ঠ অবরুদ্ধ করায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আরও বাড়িয়েছে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষমতা হ্রাস করিয়েছে এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোয় সংখ্যালঘু তামিল ও মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যকে দৃঢ়প্রোথিত করেছে।
একটি সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সঙ্কট
দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা অবশ্য শ্রীলঙ্কায় নতুন কিছু নয়, সেইসাথে আরো আছে দেশে মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক দেনা এবং খরচ রোধে সরকারগুলোর ধারাবাহিক ব্যর্থতা। তবে বর্তমান সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত দেশটিকে একদম দেউলিয়া হবার পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে সেই ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে এতটা মন্দ অর্থনৈতিক অবস্থা আর কখনোই শ্রীলঙ্কাকে পার করতে হয়নি।
রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসের গৃহীত নীতিমালার মধ্যে অন্যতম বিপর্যয় সৃষ্টিকারী একটি নীতি ছিল দেশটিতে রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করা। এর ফলে কৃষকদের জীবিকায় ধস নামে এবং ফসলের হার এত কমে যায় যে নানা জায়গায় চাষাবাদই বন্ধ হয়ে যায়। বহু কৃষক বেকার হয়ে পড়েন এবং খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়। এর ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে এবং চা ও রাবার শিল্পের মত রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো ধ্বংস হয়ে যেতে থাকে। ইতোমধ্যে, কোভিডের কারণে শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্পেও ধস নামে। অথচ এই পর্যটন শিল্পই ছিল শ্রীলঙ্কার জন্য অন্যতম রাজস্ব আয়ের খাত। এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় জ্বালানি সঙ্কট দেখা দেয় এবং বৈশ্বিক পর্যটন শিল্প বলতে গেলে অচল হয়ে পড়ে, যেহেতু রাশিয়া ও ইউক্রেন বৈশ্বিক পর্যটকদের ঘোরাফেরার দুটো বড় জায়গা।
যেহেতু 'সামরিকায়ন'ই শ্রীলঙ্কায় প্রথা
রাষ্ট্রের প্রবল কর্তৃত্ববাদ শ্রীলঙ্কায় একদমই নতুন কিছু নয়। তামিল ও মুসলিমরা এটা ভালোভাবেই জানে। ১৯৮৩ থেকে ২০০৯ অবধি চলমান গৃহযুদ্ধের আগে ও পরে এই উভয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীই বর্ণনাতীত মাত্রার আতঙ্কজনক সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। বিগত সপ্তাহে শ্রীলঙ্কায় নিরাপত্তা তথা সামরিক বাহিনীর মোতায়েন হয়তো সাম্প্রতিক সমস্যার মুখে সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত একটি ঝটিতি পদক্ষেপ, তবে শ্রীলঙ্কার সরকারি ব্যবস্থাপনায় 'সামরিকায়ন' বহু বছরের পুরনো একটি স্তম্ভ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।
ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কার 'প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়' ২০২২ সালের জন্য নির্ধারিত সরকারি ব্যয়ের মোট ১২.৩ শতাংশ ব্যয়ের অনুমতি পেয়েছে—বাজেটে যেকোনো মন্ত্রণালয়ের জন্য এ পর্যন্ত অনুমোদনপ্রাপ্ত সর্বোচ্চ বাজেট। গৃহযুদ্ধ শেষ হবার ১৩ বছর পরও সামরিক খাতে এতটা ব্যয় নিয়ে আর কী-ই বা বলার আছে?
মূলত শ্রীলঙ্কার উত্তর এবং পূর্বে অবস্থানরত তামিল সংখ্যালঘুরাই এই সামরিকায়নের সবচেয়ে বড় আঘাতের মুখোমুখি হয়ে এসেছে, যা তাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রাকেও অহরহ বিপর্যস্ত করে। সংখ্যালঘু তামিল অধ্যূষিত এলাকাগুলোয় সামরিক বাহিনীই যেন বেসামরিক জীবন পরিচালনা করে। স্কুল থেকে বিনোদন এবং এমনকি তামিলদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানও সামরিক বাহিনীর অঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হয়। শ্রীলঙ্কার উত্তর ও পূর্বের তামিল অঞ্চলগুলোয় প্রতি ছ'জন বেসামরিক নাগরিকের উপর নজরদারি করার জন্য এক জন সামরিক ব্যক্তি নিয়োজিত থাকেন।
এই একই সামরিক বাহিনী গৃহযুদ্ধের সময় লাখ লাখ তামিলকে হত্যা করেছে, যা আসলে ছিল গণহত্যারই তুল্য। জাতিসঙ্ঘ তামিল জনগোষ্ঠীর উপর শ্রীলঙ্কার সরকার ও সেনাবাহিনী কর্তৃক সঙ্ঘটিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক অপরাধের অভিযোগে তদন্তের দাবি জানিয়ে আসছে।
গৃহযুদ্ধ শেষ হবার পরেও শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক জোরপূর্বক তুলে নেওয়া বা গুমের শিকার হওয়া সাধারণ ছেলেমেয়েদের খোঁজ জানতে না পেরে এ পর্যন্ত অন্তত ১১৫ জন তামিল পিতা-মাতার মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যু হয়েছে মানসিক বেদনা থেকে। এমন এক বেদনাহত বৃদ্ধা মায়ের নাম থাঙ্গারাসা সেলভারানি। পঁচাত্তর বছর বয়সী এই বৃদ্ধা ছেলে হারানোর প্রতিবাদে গত পাঁচ বছর ধরে রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আসছিলেন। সম্প্রতি তিনি মারা গেছেন—তার ছেলের কোন খোঁজ না পেয়েই।
এরপরে কী হতে যাচ্ছে?
ইতিমধ্যে দেশব্যপী ছড়িয়ে পড়া সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের মুখে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। মাহিন্দা তার পরিবারসহ কলম্বোর বাসভবন ছেড়ে পালানোর অসমর্থিত খবর পেয়েই বিক্ষোভকারীরা জড়ো হয়েছিল ত্রিঙ্কোমালি বন্দরে—যেন কিছুতেই তিনি পালাতে না পারেন!
দ্বীপ জুড়েই সরকারবিরোধী এই বিক্ষোভ আরো বাড়বে ও অব্যাহত থাকবে, যেহেতু রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসে এখনো রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছেন এবং তার প্রিয় রাজনীতিবিদেরা জনরোষ এড়াতে কিছু 'নিরাপদ ভবনে' অবস্থান করছেন।
এখনো পর্যন্ত গোতাবায়া পদত্যাগ করতে রাজি হচ্ছেন না এবং বদলে একটি নতুন মন্ত্রিপরিষদকে নিযুক্ত করতে চাচ্ছেন। তবে নতুন একটি মন্ত্রিপরিষদ আসলে বিদ্যমান সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারবে না, এবং বেসামরিক নাগরিকদের উপর এই দমন-পীড়ন বরং সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাকে আরো ক্ষয় করবে।
- লেখক পরিচিতি: নীরো কান্ডস্বামী ইউনিভার্সিটি অফ সিডনি-র প্রভাষক এবং তামিল রিফিউজি কাউন্সিলের সদস্য। তার এই লেখাটি দ্য কনভার্সেশন-এ প্রকাশিত হয়েছে।
- অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী