চীন-তাইওয়ান: সহজপাঠ
যুক্তরাষ্ট্রের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরকে 'অত্যন্ত বিপজ্জনক' আখ্যা দিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে চীন।
গত ২৫ বছরের মধ্যে তাইওয়ান সফর করা সবচেয়ে সিনিয়র মার্কিন রাজনীতিবিদ পেলোসি।
তাইওয়ানকে চীন নিজের একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ বিবেচনা করা। চীনের মতে, তাইওয়ান শেষ পর্যন্ত বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
কিন্তু তাইওয়ান নিজেকে স্বাধীন দেশ হিসেবেই দেখে। তার নিজস্ব সংবিধান ও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারপ্রধান রয়েছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, তাইওয়ানের সঙ্গে চীনের 'পুনরেকত্রীকরণ সম্পন্ন করা হবেই'। চীনের সঙ্গে তাইওয়ানকে একীভূত করার জন্য প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের সম্ভাবনাও তিনি উড়িয়ে দেননি।
তাইওয়ান কোথায় অবস্থিত?
তাইওয়ান দক্ষিণ-পূর্ব চীনের উপকূল থেকে প্রায় ১০০ মাইল দূরে অবস্থিত একটি দ্বীপ।
দ্বীপটি কথিত 'ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইন'-এর অন্তর্ভুক্ত। ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইনে বেশ কিছু আমেরিকাবান্ধব অঞ্চল আছে যেগুলো মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কিছু পশ্চিমা বিশেষজ্ঞের মতে, তাইওয়ান দখল করে নিলে চীন পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আরও স্বাধীনভাবে ক্ষমতা প্রদর্শন পারবে এবং সম্ভবত গুয়াম ও হাওয়াই পর্যন্ত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোর জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারনে।
তবে চীন জোর দিয়ে বলেছে যে তার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ।
তাইওয়ান কি চিরকালই চীন থেকে আলাদা ছিল?
ঐতিহাসিক সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, ১৭ শতকে দ্বীপটি প্রথমবারের মতো চীনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে। তখন শাসনক্ষমতায় ছিল কিন রাজবংশ। এরপর ১৮৯৫ সালে চীন-জাপান যুদ্ধে চীন হেরে যায়। তাইওয়ানের দখল চলে যায় জাপানের হাতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হেরে যাওয়ার পর ১৯৪৫ সালে চীন আবার দ্বীপটি দখল করে নেয়।
কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৪৬ সালে চীনের মূল ভূখণ্ডে চিয়াং কাই-শেকের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী সরকারি বাহিনী ও মাও সেতুংয়ের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।
ওই গৃহযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্টদের সহায়তা দেয়, আর আমেরিকা মদদ দেয় জাতীয়তাবাদীদের। কমিউনিস্টদের হাতে কোণঠাসা হতে হতে জাতীয়তাবাদী কুমিনতাং সরকার শেষতক তাইওয়ান দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
অবশেষে ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্টরা এ যুদ্ধে জেতে এবং বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
তাইওয়ানে পালিয়ে যাওয়া চিয়াং কাই-শেক ও জাতীয়তাবাদী দল পরের কয়েক দশক ধরে দ্বীপটি শাসন করে।
এই ইতিহাসের উল্লেখ করে চীন করে বলে যে, তাইওয়ান শুরু থেকেই চীনা প্রদেশ ছিল। কিন্তু তাইওয়ানিজরাও একই ইতিহাসের উল্লেখ করে যুক্তি দেয় যে, তারা কখনোই আধুনিক চীনা রাষ্ট্রের অংশ ছিল না। উল্লেখ্য, আধুনিক চীন প্রথমে ১৯১১ সালে বিপ্লবের পরে গঠিত হয়। এরপর ১৯৪৯ সালে মাওয়ের অধীনে গঠিত হয় সেই চীনেরই আধুনিকতর রূপ পিপলস রিপাবলিক অভ চায়না (পিআরসি)।
কুমিনতাং তখন থেকেই তাইওয়ানের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল। ইতিহাসের বড় একটি সময়জুড়ে দ্বীপটি শাসন করে আসছে দলটি।
বর্তমানে শুধু ১৩টি দেশ (ও ভ্যাটিকান) তাইওয়ানকে সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
তাইওয়ানকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য বা স্বীকৃতি দেওয়ার মতো কোনো পদক্ষেপ ঠেকানোর জন্য চীন অন্যান্য দেশের উপর যথেষ্ট কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে।
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে।
তাইওয়ানের কি নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা আছে?
চীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার মতো অসামরিক উপায়ে 'পুনরেকত্রীকরণে'র প্রয়াস নিতে পারে।
তবে যেকোনো ধরনের সামরিক সংঘাত বাধলে চীনের সশস্ত্র বাহিনী তাইওয়ানের সেনাদের রীতিমতো ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পরই চীনের অবস্থান। নৌশক্তি থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, বিমান ও সাইবার আক্রমণ পর্যন্ত বিশাল পরিসরে সক্ষমতা অর্জন করতে পারে বেইজিং।
চীনের বেশিরভাগ সামরিক শক্তি অন্যত্র কেন্দ্রীভূত হলেও সামরিক শক্তির দিক থেকে দুই পক্ষের মধ্যে বিশাল ভারসাম্যহীনতা রয়েছে।
কিছু পশ্চিমা বিশেষজ্ঞের মতে, উন্মুক্ত সংঘাতে তাইওয়ান বড়জোর চীনের আক্রমণকে ধীর করে দেওয়ার লক্ষ্য নিতে পারে; আর বাইরের সাহায্যের অপেক্ষায় থাকাকালে চীনা বাহিনীর ওপর গেরিলা হামলা চালাতে পারে।
বাইরের সেই সাহায্য আসতে পারে তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রয়কারী যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে।
এখন পর্যন্ত ওয়াশিংটনের 'কৌশলগত অস্পষ্টতার' নীতির অর্থ হলো, আক্রমণের শিকার হলে তারা তাইওয়ানকে কীভাবে রক্ষা করবে কিংবা আদৌ রক্ষা করবে কি না, সেটি যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছা করেই স্পষ্ট করেনি।
কূটনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত 'এক-চীন' নীতি অবলম্বন করছে। যা কেবল একটি চীনা সরকারকে স্বীকৃতি দেয়—সেটি বেইজিং। আর তাইওয়ানের বদলে চীনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক রক্ষা করছে ওয়াশিংটন।
কিন্তু গত মে মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ওয়াশিংটনের অবস্থানকে আরও কঠোর করেন।
যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে সামরিকভাবে রক্ষা করবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বাইডেন বলেছিলেন: 'হ্যাঁ।'
হোয়াইট হাউস দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছে যে ওয়াশিংটন তার অবস্থান পরিবর্তন করেনি।
পরিস্থিতি কি খারাপ হচ্ছে?
২০২১ সালে চীন তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা সীমানায় সামরিক বিমান পাঠিয়ে চাপ বাড়িয়েছে। এই স্ব-ঘোষিত এলাকায় বিদেশি বিমানকে চিহ্নিত, পর্যবেক্ষণ এবং জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
তাইওয়ান ২০২০ সালে বিমানে অনুপ্রবেশের তথ্য প্রকাশ করেছে।
২০২১ সালের অক্টোবরে একদিনে বিমানের মাধ্যমে ৫৬টি অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে, যা একদিনে সর্বোচ্চ।
বাকি বিশ্বের জন্য তাইওয়ান কেন গুরুত্বপূর্ণ?
তাইওয়ানের অর্থনীতি সবার জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বের বেশিরভাগ দৈনন্দিন ইলেকট্রনিক সরঞ্জামে—ফোন থেকে ল্যাপটপ, ঘড়ি ও গেম কনসোল—তাইওয়ানে উৎপাদিত চিপ ব্যবহৃত হয়।
এক হিসাব অনুসারে, তাইওয়ানের একটি কোম্পানিই—তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (বা টিএসএমসি)—বিশ্বের মোট সেমিকন্ডাক্টরের অর্ধেকের বেশি উৎপাদন করে।
টিএসএমসি একটি কথিত 'ফাউন্ড্রি'—অর্থাৎ এমন এক কোম্পানি যা ভোক্তা ও সামরিক গ্রাহকদের দ্বারা ডিজাইন করা চিপ তৈরি করে। এটি একটি বিশাল শিল্প। ২০২১ সালে এই শিল্পের আকার ছিল প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার।
তাইওয়ান চীনের দখলে চলে গেলে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্পের ওপর বেশ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যেতে পারে বেইজিং।
তাইওয়ানের মানুষ কি উদ্বিগ্ন?
চীন ও তাইওয়ানের মধ্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনা সত্ত্বেও গবেষণায় দেখা গেছে, তাইওয়ানের অনেক মানুষই তুলনামূলকভাবে তেমন একটা উদ্বিগ্ন নয়।
২০২১ সালের অক্টোবরে তাইওয়ান পাবলিক অপিনিয়ন ফাউন্ডেশন তাইওয়ানিজদের প্রশ্ন করেছিল, শেষ পর্যন্ত চীনের সঙ্গে তাইওয়ান যুদ্ধে জড়াবে কি না।
জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ (৬৪.৩ শতাংশ) উত্তর দিয়েছেন, তারা তা মনে করেন না।
আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, তাইওয়ানের বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের তাইওয়ানিজ হিসেবে পরিচয় দেয়—অর্থাৎ তারা নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় গ্রহণ করেছে।
১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিক থেকে ন্যাশনাল চেংচি ইউনিভার্সিটি পরিচালিত সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে নিজেকে চীনা অথবা চীনা ও তাইওয়ানিজ উভয় হিসেবেই পরিচিত দেয়, এমন মানুষের আনুপাতিক হার কমে গেছে; বেশিরভাগ মানুষই এখন নিজেদেরকে তাইওয়ানিজ মনে করে।
- সূত্র: বিবিসি