তুর্কি বনাম ইরানি ড্রোন– ইউক্রেনের পর এবার ড্রোন দিয়ে সংঘাত মধ্য এশিয়ায়?
২০২০ সালে নগরনো-কারাবাখ যুদ্ধের পর আবারো সংঘাতে জড়িয়েছে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান। তাতে শতাধিক সেনা নিহত হয়েছে উভয়পক্ষে। ককেশাস পর্বতমালার চির বৈরী এ দুই দেশের প্রতিবেশী তুরস্ক ও ইরান। এরমধ্যে ইরান আর্মেনিয়ার এবং তুরস্ক আজারবাইজানের ঘনিষ্ঠ মিত্র।
তাই আর্মেনিয়ার বিপদের দিনে পাশে দাঁড়াচ্ছে তেহরান। চাপ সৃষ্টি করতে আজারবাইজানের সীমান্তের দিকে ইরানের সাঁজোয়া বহর যাওয়ার একটি ভিডিও চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। বহরটি ইরানের অভিজাত বাহিনী রেভ্যুলেশনারী গার্ড কোরের বলে কিছু সূত্র দাবি করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে কিছু গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, পশ্চিম ইরানে উত্তরের আজেরি সীমান্তের দিকে গেছে ট্যাংক, আর্মার্ড কমব্যাট ভিহাইকেল ও বড় ক্যালিবারের গোলন্দাজ কামান। এছাড়াও, আজেরি-ইরানি সীমান্তে নিয়মিত টহল দিচ্ছে ইরানি ড্রোন।
অবশ্য ইরানের কোন অঞ্চলে ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে– সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
আজারবাইজান- আর্মেনিয়া সংঘাত:
মিত্রতা ছাড়াও আর্মেনিয়-আজেরি সংঘাত নিয়ে মাথাব্যথার যথেষ্ট কারণ আছে তেহরানের। ২০২০ সালের নগরনো-কারাবাখ যুদ্ধের সময় ইরানের ভূখণ্ডেও এসে পড়েছে রকেট ও মর্টার শেল। বেগতিক দেখে তখন কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছিল তেহরান।
ইরান ও আজারবাইজান দুই দেশই শিয়া মুসলিম প্রধান। ইরানের উত্তর প্রদেশে বাস করে প্রায় ২ কোটি আজেরি জনগোষ্ঠী। তারা আজারবাইজানের সাথে গভীর সহমর্মিতা বোধ করে। ধর্ম ও জাতিগত নৈকট্য একে আরও আন্তরিক রূপ দিয়েছে।
কিন্তু, ইরান তার আজেরি জনসংখ্যার মনোভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। আজারবাইজান শক্তিশালী হলে ইরানের আজেরি জনগোষ্ঠীও বাকুর রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাইতে পারে, যা ইরানের অখণ্ডতার জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
একারণে, সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর থেকেই তেহরান ও বাকুর মধ্যে সম্পর্কে সব সময় উত্তেজনা বিরাজ করেছে। বাকুর অভিযোগ, ইরান তার নিজস্ব শিয়া মতবাদ আজারবাইজানে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে, তেহরানের অভিযোগ– ইরানে আজেরি জাতীয়তাবাদ রপ্তানি করছে আজারবাইজান।
তাছাড়া, বহু বছর ধরেই ইরানের প্রধানতম বৈরী রাষ্ট্র– যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছে আজারবাইজান। এই দুটি দেশ আজেরি ভূখণ্ড ব্যবহার করে ইরানে গোয়েন্দা অপারেশন চালায় বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ তেহরানের। আজারবাইজান ইসরায়েলি অস্ত্রেরও বড় ক্রেতা।
তেহরানের অভিযোগ আরও গুরুতর। এতটাই যে ইরান আজারবাইজানকে শায়েস্তা করতে যুদ্ধেও যেতে পারে। যেমন গত বছর ইরানের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ মোস্তফা কোশচাশম অভিযোগ করেন, ২০১৮ সালে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির নথি চুরির মিশন আজারবাইজান থেকেই শুরু করেছিল ইসরায়েল। আজেরি ভূখণ্ডে থাকা নিজস্ব গোপন ঘাঁটি থেকে ড্রোন উড়িয়ে ইরানের ওপর নজরদারিও করছে তেল আবিব। এরমধ্যে একটি ইসরায়েলি হারমিস ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে ইরান।
ইরানের বর্তমান আর্থ-সামাজিক দূরাবস্থা জনগণকে অশান্ত করে তুলছে, তার সাথে আছে আজেরি জাতীয়তাবাদের ডাক– সব মিলিয়ে তেহরানের কর্মকর্তাদের কপালে দুভার্বনার ছাপ পরাটা সঙ্গত। বাকু একা নয়, ইরানের আজেরি জনগোষ্ঠীকে বিদ্রোহ করার উস্কানি দিতে পারে ইসরায়েলও। তাতে সৃষ্টি হবে চরম বিশৃঙ্খলা।
তাই ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভৌগলিক নৈকট্য থাকার পরও যোজন যোজন দূরত্বে বাস ইরান, আজারবাইজানের। সে তুলনায় অর্থোডক্স খৃষ্টান জনসংখ্যা প্রধান আর্মেনিয়ার সাথে তেহরানের সম্পর্কে উষ্ণতার কমতি নেই।
এমনকী লেবানন ও সিরিয়াতে বাসকারী আর্মেনিয়রা- তেহরানের প্রক্সি– হিজবুল্লাহর মিত্র। ইরানের সামরিক বাহিনীর একটি অংশ মদ্য চোরাচালানেও জড়িত, আর এই ব্যবসায় আধিপত্য করে আর্মেনিয়রা।
সংঘাতের শিকড় আরও গভীরে
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র তো আছেই– ইরানের আরেক ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্কের সাথেও বাকুর সম্পর্ক বেশ শক্তিশালী ও হৃদ্যতাপূর্ণ। অথচ পারসিক শাসকরা সুন্নি তুর্কিদের চিরকাল আঞ্চলিক প্রতিযোগী হিসেবে দেখেছে। আধুনিক রাষ্ট্র ইরানের সাথেও তুরস্কের এই আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের দ্বৈরথ চলমান।
২০২০ সালে তুরস্ক ও ইসরায়েলের তৈরি ড্রোন ব্যবহার করেই যুদ্ধে জয় পায় বাকু। এরমধ্য উল্লেখযোগ্য ছিল তুরস্কের বাইকার কোম্পানির তৈরি বায়রাক্তার টিবি-২ এবং ইসরায়েল থেকে কেনা আত্মঘাতী বা কামিকাজি ড্রোন। এগুলি দিয়ে বহুসংখ্যক আর্মেনীয় ট্যাংক, কামান ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয় আজেরি সেনারা।
তুর্কি নিউজ চ্যানেল টিআরটি হাবের- এ সম্প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ বলেছিলেন, 'আজেরি সামরিক বাহিনীর হাতে থাকা অত্যাধুনিক ড্রোনের কল্যানেই এই যুদ্ধে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপকভাবে কমেছে'।
তুরস্ক ও আজারবাইজান 'দুই রাষ্ট্রে বাসকারী এক জাতি' এই নীতিতে বিশ্বাস করেন বায়কার টেকনোলজিসের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা সেলজুক বায়রাক্তার। টিবি-২ ড্রোন ব্যবহার করে– আজারবাইজান নগরনো-কারাবাখের বিপুল এলাকা আর্মেনিয়ার দখলমুক্ত করায় তিনি বেশ গর্বিত বলে একটি সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলেন।
সেলজুক বলেন, 'তরুণ বয়স থেকেই আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করে এসেছে কারাবাখে (আর্মেনিয়ার) অবৈধ দখলদারিত্ব। তাই একজন প্রকৌশলী হিসেবে, আমাদের আজেরি ভাই ও বোনদের তাদের হৃতভূমি উদ্ধারে সহায়তা করতে পেরে দারুণ সম্মানিত বোধ করছি'।
বিপুল সংখ্যক সংখ্যালঘু আজেরি ইরানের অধিবাসী হওয়ায় নগরনো-কারাবাখ সংঘাতকালে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিতে বাধ্য হয় ইরান। তার সঙ্গে তেহরান আজারবাইজানের আর্মেনিয়ার চেয়ে সামরিক শক্তিতে এগিয়ে থাকার বিষয়টিও অনুধাবন করেছিল।
ইরানের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি-ও আজেরি বংশদ্ভুত। তিনি যুদ্ধের সময় বলেন, 'আর্মেনিয়ার দখলে থাকা আজেরি ভূখণ্ড স্বাধীন করে তা আজারবাইজানকে ফিরিয়ে দিতে হবে'। একইসঙ্গে তিনি নগরনো-কারাবাখে বসবাসকারী আর্মেনিয়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানান।
কিন্তু, যুদ্ধ শেষ হওয়ার এক বছরের মাথায় ইরানের ক্ষোভের কারণ জন্ম দেয় বাকু। এসময় কারাবাখে ইরানের পণ্যবাহী যান চলাচলে 'সড়ক কর' আরোপ করে এবং এই বিধিভঙ্গের দায়ে দুজন ইরানি ট্রাকচালককেও গ্রেপ্তার করে। অথচ এই পথ দিয়েই ইরান থেকে সড়কপথে আর্মেনিয়ায় পণ্য ও জ্বালানি রপ্তানি করা হয়। এটি ব্যাহত হওয়ায় আর্থিক ক্ষতি হয় তেহরানের ব্যবসাবাণিজ্যে।
এই ঘটনার পর আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ তুরস্কের আনাদলু এজেন্সিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেন, ইরানি ট্রাক আর্মেনিয়া যাবে– সেটি গোপন করে আজারবাইজানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করা হয়।
এ ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় ইরান। এবং ২০২১ সালের অক্টোবরে আজেরি সীমান্তের কাছে 'খাইবার বিজেতা' নামক বৃহৎ এক মহড়া চালায় ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী (আইআরজিসি)। এতে পদাতিক সেনার পাশাপাশি যোগ দেয় আর্টিলারি ইউনিট, সাঁজোয়া যান ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ইউনিট। ৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ে এই বাহিনী আজেরি সীমান্তের কাছে শক্তি প্রদর্শন করে।
তুর্কি বায়রাক্তার বনাম ইরানি ড্রোন:
ইরান ও তুরস্কের মধ্যে একটি বিষয়ে মিল রয়েছে– তারা উভয়েই ড্রোন নির্মাণে উদীয়মান সুপারপাওয়ার হয়ে উঠছে। নগরনো-কারাবাখ যুদ্ধে আজারবাইজানের তুর্কি ড্রোনের সফল ব্যবহার দেখে ইরানেও আর্মেনিয়ায় ড্রোন রপ্তানি করতে পারে।
গত আগস্টে 'ফ্যালকন হান্টিং' নামক এক সামরিক টুর্নামেন্টের আয়োজন করে ইরান। এতে রাশিয়া, বেলারুশ ও আর্মেনিয়ার ৭০ সেনা সদস্য অংশ নেয়। এতে ছিল– ২৪ ঘণ্টা ড্রোন দিয়ে নজরদারি এবং সে তথ্যের ভিত্তিতে নির্ভুলভাবে কামানের গোলা নিক্ষেপের দিক-নির্দেশনা দেওয়ার প্রতিযোগিতা।
ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য রাশিয়া ইরান থেকে ড্রোন কিনবে– এমন অভিযোগ যখন ওঠে তার মধ্যেই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
উল্লেখ্য, ইউক্রেন যুদ্ধে শুরু থেকেই প্রধান ভূমিকা পালন করছে ড্রোন শক্তি। আগ্রাসনের শুরুতে রুশ বাহিনীর বেশ কয়েকটি সেনাবহরকে সমূলে ধ্বংস করে দেয় ইউক্রেনীয় বাহিনীর টিবি-২ ড্রোন।
টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার অল্পকিছুদিনের মধ্যেই ইরানি ড্রোনের প্রথম চালান রাশিয়ায় পৌঁছায় বলে জানান মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা। তাদের মতে, ইরান দু ধরনের ড্রোন– মোহাজের-৬ এবং শাহিদ সিরিজের ড্রোন পাঠিয়েছে– যা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ও লক্ষ্যবস্তু শনাক্তে ব্যবহার করা যাবে।
মোহাজের-৬ এর সর্বোচ্চ পাল্লা ২০০ কিলোমিটার। সে তুলনায় বায়রাক্তার টিবি-২ এর পূর্ণাঙ্গ পাল্লা প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। আর এটি টানা ২৭ ঘণ্টা উড়তে পারে।
মার্কিন গোয়েন্দারা সাম্প্রতিক সময়ের কিছু স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করেছেন। ছবিগুলি ইরানের কাশান বিমানঘাঁটির। ছবিতে দেখা যায়, রুশ কর্মকর্তারা সেখানে শাহিদ-১২৯ ও শাহিদ-১৯১ ড্রোন পরিদর্শন করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই ড্রোনগুলি পেয়েছে রাশিয়া।
শাহিদ-১৯১ ও শাহিদ-১২৯ তুরস্কের টিবি-২ এর চেয়ে আরও বেশি দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে; তাদের পাল্লা যথাক্রমে ৪৫০ এবং ২,০০০ কিলোমিটার।
তবে ইরানি দুটি ড্রোনের চেয়ে দীর্ঘসময় আকাশে উড়তে পারে টিবি-২। সে তুলনায় শাহিদ-১২৯ উড়তে পারে ২৪ ঘণ্টা এবং শাহিদ-১৯১ সাড়ে চার ঘণ্টা। আর মোহাজের ড্রোনের উড্ডয়ন স্থায়িত্ব মাত্র ১২ ঘণ্টা।
শাহিদ-১২৯ ও মোহাজের- ৬ ড্রোনের চেয়ে আরও উঁচুতে উড়তে পারে বায়রাক্তার টিবি-২। ইরানি ড্রোন দুটি যথাক্রমে ২৩ হাজার ৯৫০ ও ১৮ হাজার ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় উড়তে পারে। বায়রাক্তার উড়তে পারে ২৫ হাজার ফুট উচ্চতায়।
অস্ত্রসজ্জার দিক থেকে, বায়রাক্তার প্রায় ১৫০ কেজি ওজনের ক্ষেপণাস্ত্র বা গাইডেড বোমা ব্যবহার করতে পারে। শাহিদ-১২৯ আরও বেশি বা প্রায় ৪০০ কেজি ওজনের পেলোড বহন করে। সে তুলনায় মোহাজের-৬ মাত্র ৪০ কেজি বহনে সক্ষম।
রাশিয়াকে কোন কনফিগারেশনের মোহাজের-৬ ড্রোন দেওয়া হয়েছে এবং তার সাথে ব্যবহারের জন্য কী অস্ত্র ইরান দিয়েছে– সে সম্পর্কে ইরান বা রাশিয়া কোনো দেশই আনুষ্ঠানিক তথ্য দেয়নি।
তবে মোহাজের-৬ নজরদারি, পর্যবেক্ষণ ও তার মাধ্যমে শত্রুর অবস্থান শনাক্তকরণ এবং শত্রুবাহিনীর গতিবিধির তথ্য সংগ্রহে সক্ষম। এই মনুষ্যহীন আকাশযানটি সর্বোচ্চ দুটি গাইডেড বোমা বহন করতে পারে।
তবে তুর্কি ড্রোনগুলি উন্নতমানের উপকরণ ও প্রযুক্তিতে তৈরি। রয়েছে উন্নত ও নিরাপদ ডেটালিংক-সহ রাডার সংকেত কমায় এমন কম্পোজিট উপকরণের ব্যবহার। যুদ্ধক্ষেত্রে এই বৈশিষ্ট্যগুলিই টিবি-২ ড্রোনকে এগিয়ে রাখে।
- সূত্র: ইউরেশিয়ান টাইমস