আরেকটি কৌশলগত রাশিয়ান পিঠটান, সামনে খেরসনে লম্বা লড়াইয়ের ইঙ্গিত
ইউক্রেনীয় ড্রোন অপারেটরের চোখ সামনের কম্পিউটারের পর্দায় অনেকক্ষণ ধরে আটকে আছে। এখান থেকে মোটামুটি মাইল তিনেক দূরে মার্কিন এম৭৭৭ হাউটজার কামান থেকে রাশিয়ান বাহিনীর ওপর নিরবচ্ছিন্ন গোলাবর্ষণের আওয়াজ আসছে।
ইউক্রেনের এ বিশেষ বাহিনীর ইউনিট কমান্ডার কর্নেল রোমান কস্তেঙ্কো। এর আগে ইউক্রেনীয় বাহিনী দক্ষিণ খেরসন ও মিকোলাইভ অঞ্চলের আরও কিছু অংশ পুনর্দখল করেছে।
তবে উত্তর-পূর্ব খারকিভে যেভাবে সফলতার সঙ্গে রাশিয়ান বাহিনীকে পিছু হটিয়েছে ইউক্রেন, খেরসনে তাদের প্রতিহত করতে বেশ বেগ পেতে হবে বলেই মনে করছে দক্ষিণাঞ্চলীয় রণক্ষেত্রে অবস্থান করা ইউক্রেনীয় বাহিনী। কারণ, রাজনৈতিক ও সামরিক; উভয় দিক থেকেই খেরসন রাশিয়ানদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
কস্তেঙ্কো বলেন, 'এটা খারকিভ নয়। সেখানে রাশিয়ান বাহিনী তাদের সব গোলাবারুদ ও সামরিক যান ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখানে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার সময় তারা সবকিছু সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছে এবং নতুন করে পরিখা খনন করতে শুরু করেছে।'
খেরসনের কিছু গ্রাম ও শহর থেকে রাশিয়ানদের সুশৃঙ্খলভাবে পিছু হটার কারণ হতে পারে তারা খেরসন ও প্রতিবেশী শহর নোভা কাখোভকা'র চারপাশের ফ্রন্টলাইনে নতুন করে আরও শক্তিশালী আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কাখোভকা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে রাশিয়ার ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়ায় পানি সরবরাহ করা হয়। ইউক্রেন এ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। কেন্দ্রটি দখল করে ক্রিমিয়ায় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা রাশিয়ার আক্রমণের প্রথমদিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল।
খেরসনের ভেতরে ও বাইরে রাশিয়ান বাহিনী এখন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে আছে। এই অঞ্চলের জমি সমতল হওয়া রাশিয়ানদের পক্ষে এখানে ইউক্রেনের আক্রমণের জবাব দেওয়া কঠিন হচ্ছে। খেরসনের তিন দিক থেকে রাশিয়ান বাহিনীকে ঘিরে ধরেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। ফলে খেরসনের নিজেদের দখলে থাকা ছোট একটি অংশের ভেতরে আটকে পড়া সম্ভাবনা রয়েছে রাশিয়ান বাহিনীর।
তাই সতর্ক সামরিক কৌশলের দিক থেকে খেরসন থেকে রাশিয়ার কৌশলগত পিছু হটাই গ্রহণযোগ্য। তবে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দাবি করা অঞ্চলের রাজধানী খেরসন। তাই খুব সম্ভবত নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকে লড়াই চালিয়ে যাবে রাশিয়ান বাহিনী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পশ্চিমা কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা মনে করি না রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় রাশিয়ান নেতারা খেরসন থেকে সম্পূর্ণ পিছু হটতে সেনাদের অনুমতি দেবেন।' রাশিয়ানরা খেরসনে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন বলেও মনে করেন তিনি।
দ্রুত পিছু হটা খারকিভে রাশিয়ানরা স্থানীয় আধাসামরিক বাহিনী ও ন্যাশনাল গার্ড পাঠিয়েছিল। কিন্তু খেরসনে প্যারাট্রুপার ও মেরিনদের মতো সুপ্রশিক্ষিত বাহিনীকে মোতায়েন করেছে রাশিয়া। এদের বিপরীতে যুদ্ধ করাটা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য। তবে ইতোমধ্যে যথেষ্ট সেনা হারিয়ে বিপর্যস্ত দক্ষ এ রাশিয়ান বাহিনীগুলোও।
রাশিয়ান বাহিনী এখন জোড়াতালি দিয়ে তাদের বহর চালাচ্ছে বলে দাবি করেছেন ইউক্রেন বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন অ্যান্ড্রি পিডলিসনি। তিনি জানান, তার বাহিনীর হাতে ধরা পড়া একজন রাশিয়ান বন্দি জানিয়েছেন, রাশিয়ান ট্যাংকগুলো সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট থেকে আসা লোক দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে।
ওই প্যারাট্রুপার বন্দি আরও জানিয়েছেন, তার তিনজনের ট্যাংকদলে ড্রাইভার ছিলেন তিনি, কমান্ডার ছিলেন একজন ওয়াগনার মার্সেনারি, আর গানার ছিলেন লুহানস্ক থেকে আসা অন্য ইউনিটের এক সেনা।
ক্যাপ্টেন পিডলিসনি মনে করেন, যদি রাশিয়ান বাহিনীর ট্যাংক পর্যায়ে এমন পরিস্থিতি হয় তাহলে কোম্পানি, ব্যাটালিয়ন, ব্রিগেড পর্যায়ে পরিস্থিতি আরও বেশি জগাখিচুড়ি।
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নতুন করে সেনা, অস্ত্র, ও রসদ সমাবেশ করছেন ফ্রন্টলাইনে। রাশিয়ার এ স্থানান্তরনের সময়ের সুবিধা নিতে চাচ্ছে ইউক্রেন।
ইউক্রেনের প্রতি-আক্রমণকারী বাহিনী এখন এত দ্রুত সামনের দিকে এগোচ্ছে যে রণক্ষেত্রে থাকা সৈনিকেরা এ দ্রুতির সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
কর্নেল রোমান কস্তেঙ্কো ইউক্রেনের পার্লামেন্টে একজন সদস্য। তিনি মাঠে যুদ্ধ করেন, আবার কিয়েভেও সময় দিতে হয় তাকে। ইউক্রেনের জন্য আরও অস্ত্র পেতে তদবির করতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সফরেও যান তিনি।
তার নিজের বাড়িও খেরসনে। তাই নিজের এলাকা থেকে রাশিয়ানদের বিদায় করা তার জন্য ব্যক্তিগতভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। তবে কস্তেঙ্কো নিজেও জানেন কাজটা সহজ হবে না। অবশ্য খারকিভে ইউক্রেনীয় বাহিনীর সাম্প্রতিক সফলতা তিনিসহ পুরো ইউক্রেনকে নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে।
সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট