১৪১ কোটির দেশ হয়েও চীনে কেনো জনসংখ্যা কমার উদ্বেগ?
চীনের সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ট্যাং হুয়াজুন। রাজধানী বেইজিংয়ের উপকণ্ঠেই তার অ্যাপার্টমেন্ট। কাজ শেষে নিজের দুইবছর বয়সী সন্তানের সঙ্গে খেলতে ভালবাসলেও তিনি জানান, ভবিষ্যতে আর সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা নেই তার। রয়টার্স অবলম্বনে।
ট্যাং-এর মতো অসংখ্য মানুষের এই সিদ্ধান্ত কেবল চীনের জনসংখ্যা নয়, বরং পুরো বিশ্বের গতিপথই বদলে দিতে চলেছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, আগামীকাল মঙ্গলবার (১৫ নভেম্বর) ৮ বিলিয়নে পৌঁছাবে বিশ্বের জনসংখ্যা।
৩০ বছর বয়সী ট্যাং জানান, তার অনেক বিবাহিত বন্ধুরই একটি মাত্র সন্তান রয়েছে এবং তারাও ট্যাংয়ের মতোই আর কোনো সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন না। চীনের অল্পবয়সীরা সন্তান নেওয়া তো দূরের কথা, এমনকি বিয়ে করতেই আগ্রহী নয় বলে জানান ট্যাং।
সন্তান লালনের উচ্চ ব্যয়ের পাশাপাশি ব্যস্ত নগরজীবনে সন্তানের দেখভালের জন্য দাদা-দাদী কিংবা নানা-নানীর সাহায্য নেওয়াও প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে, মূলত এ কারণেই বিশ্বের জনবহুল দেশখ্যাত চীনে এখন সন্তান জন্ম দিতে অনাগ্রহী বেশিরভাগ মানুষ।
"আরেকটি কারণ হলো, আমাদের মধ্যে অনেকেই দেরিতে বিয়ে করেন; এমন বয়সে বিয়ে করেন যখন গর্ভধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আমি মনে করি, দেরিতে বিয়ে করা অবশ্যই সন্তান জন্মদানের ওপর প্রভাব ফেলবে," বলেন ট্যাং।
গত কয়েক দশক ধরে গোপনে সন্তান জন্মদান রুখতে অনেক কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে চীন সরকার। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ১৯৮০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এক সন্তান নীতি চালু ছিল দেশটিতে। চীনের বর্তমান জনসংখ্যা ১৪১ কোটি ২০ লাখের মতো।
তবে জাতিসংঘ বলছে, সামনের বছর থেকে কমতে শুরু করবে দেশটির জনসংখ্যা। চীনের জায়গায় সম্ভবত ভারত হতে চলেছে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ।
২০২১ সালে চীনে উর্বরতার হার ছিল ১.১৬, যা স্থিতিশীল জনসংখ্যার জন্য ওইসিডি নির্ধারিত ২.১ মানদণ্ডের অনেক নীচে এবং বিশ্বে সর্বনিম্ন।
জনসংখ্যাবিদরা বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাব এবং এটি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেওয়া কঠোর পদক্ষেপও চীনের অনেক মানুষের সন্তান জন্ম দেওয়ার ইচ্ছার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
চলতি বছরে চীনের জন্মহার সর্বনিম্ন রেকর্ড গড়তে চলেছে। জনসংখ্যাবিদরা বলছেন, গত বছরের ১০.৬ মিলিয়নের তুলনায় এ বছর নতুন জন্ম ১০ মিলিয়নের নিচে নেমে গেছে। এই হিসেবে দেশটিতে ২০২০ সালের তুলনায় এ বছর নতুন জন্মের সংখ্যা সাড়ে ১১ শতাংশ কম।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বেইজিং গতবছর থেকে তিন সন্তান পর্যন্ত জন্ম দেওয়ার অনুমতি দেয়। বলা হয়, 'উপযুক্ত' জন্মহার বৃদ্ধিতে কাজ করছে সরকার।
পুরানো মানুষই যখন হয়ে ওঠে 'নতুন সমস্যা'
পরিকল্পনাবিদদের মতে, চীনের এই সংকুচিত জনসংখ্যাই সম্পূর্ণ একটি নতুন সমস্যা তৈরি করেছে।
চীনের হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেন জিয়ানফা বলেন, "আমরা ধারণা করছি, দেশে বৃদ্ধ জনসংখ্যা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। এতে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে চীন, যা ২০ বছর আগের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন।"
চীনে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী জনসংখ্যার অংশ এখন প্রায় ১৩ শতাংশ; তবে দ্রুতই বৃদ্ধি পেতে চলেছে এ সংখ্যা। এতে ক্রমবর্ধমান হারে কমতে থাকবে শ্রমশক্তি, এবং একইসঙ্গে বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীকে দেখাশোনার জন্যও প্রয়োজন হবে অতিরিক্ত মানুষ। ফলে জনসংখ্যা সংকটের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে চীন।
জনসংখ্যায় বয়স্কদের অনুপাত সম্পর্কে অধ্যাপক শেন বলেন, "কয়েক বছর ধরে এই সংখ্যা অনেক বাড়বে। তাই দেশকে আসন্ন বার্ধক্যের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।"
সমাজে বার্ধক্য নেমে আসার উদ্বেগে দম্পতিদের এখন সন্তান নিতে উৎসাহিত করছে চীন। কর কমানো ও নগদ অর্থ দেওয়ার পাশাপাশি মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধি, চিকিৎসা বীমা এবং আবাসন ভর্তুকি দিয়ে দম্পতিদের আরও বেশি সন্তান নিতে উত্সাহিত করার চেষ্টায় নেমেছে চীন সরকার।
কিন্তু জনসংখ্যাবিদরা বলছেন, সরকারের এই পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। উচ্চ শিক্ষা ব্যয়, কম মজুরি ও দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, কোভিড রোধে সরকারের কঠোর নীতিসহ সামগ্রিক অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে জনগণের হতাশার কথা উল্লেখ করেছেন তারা।
এ ব্যাপারে হংকংয়ের ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক স্টুয়ার্ট গিটেল ব্যাস্টেন বলেন, তরুণদের জন্য চাকরির সুযোগও এখানে একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
"আপনি কেনো আরও সন্তান নেওয়ার বিষয়ে ভাববেন, যখন আপনি ভালোভাবে জীবনধারণের জন্য একটি চাকরি যোগাড় করতে পারবেন না?," প্রশ্ন রাখেন অধ্যাপক স্টুয়ার্ট।