সামনের দিনগুলোয় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্র যেভাবে বদলাবে
গত সপ্তাহে দক্ষিণের ইউক্রেনীয় শহর খেরসন থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয় রুশ সেনারা। তখন থেকেই যুদ্ধেলিপ্ত উভয় পক্ষের জেনারেলরা তাদের পরবর্তী রণকৌশলের ছক কষছেন। সমর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরপর দক্ষিণে আজভ সাগর তীরের শহরগুলো এবং পূর্বাঞ্চলে জোরালো হবে লড়াই। খবর ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের
সবচেয়ে তীব্র সংঘাত হবে– দক্ষিণে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর মেলিতোপোল ও মারিওপোলে; পূর্বে ডনবাস অঞ্চলের বাখমুত ও আভদিভকা শহরের কাছাকাছি এলাকায় মরণপণ লড়াই হওয়ার ধারণাও করছেন তারা। এরমধ্যেই শহরদুটির আশেপাশে উভয় পক্ষের সেনারা 'ক্লোজ-কোয়ার্টার কমব্যাট' বা একেবারে কাছাকাছি দূরত্বের লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছে। দুই তরফেই চলছে তীব্র গোলাবর্ষণ।
রণাঙ্গনে ইউক্রেনীয় বাহিনীর অগ্রগতি এপর্যন্ত ভালো হলেও, পশ্চিমা একজন কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেছেন, '২০২৩ সালে আমরা এটি (অগ্রগতি) থমকে যাওয়ার আশঙ্কা করছি। আমাদের অনুমান, যুদ্ধে অচলাবস্থা তৈরি হবে, অর্থাৎ দুই পক্ষের সেনারা তাদের নিজ নিজ অবস্থান খুব একটা বদলাতে পারবে না'।
এদিকে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দক্ষিণ থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার পর পূর্বাঞ্চলে শক্তিবৃদ্ধি করবে রাশিয়া। গত বসন্তে কিয়েভ অভিযান থেকে পিছু হটার পরেও রাশিয়া পূবদিকে আক্রমণের ধার বাড়ায়। যুদ্ধকৌশল বদলের কারণ হিসেবে তখন রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়, ডনবাসকে ইউক্রেন থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করার লক্ষ্যে এ অভিযান চালানো হচ্ছে। ২০১৪ সাল থেকেই ডনবাসের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে কিয়েভের বিরুদ্ধে গোপন লড়াই শুরু করে মস্কো।
পোল্যান্ড ইউক্রেনের প্রতিবেশী। রুশ আগ্রাসন মোকাবিলায় কিয়েভকে জোর সমর্থন দিচ্ছে দেশটি। ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতির ওপর ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখছে পোল্যান্ডভিত্তিক এমন একটি নিরাপত্তা পরামর্শক সংস্থা– রোচান কনসালটিং।
সংস্থাটির বিশেষজ্ঞ কনরাড মুজিকা বলেন, খেরসন থেকে সেনা প্রত্যাহার ক্রেমলিনের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। এতে করে, সাম্প্রতিক সময়ে মোবিলাইজেশনের মাধ্যমে সংগ্রহ করা ৩ লাখ সেনার পাশাপাশি– দক্ষিণ থেকে সম্পদ (জনবল, রসদ, সরঞ্জাম ইত্যাদি) সরিয়ে নিয়ে পূবদিকের রণাঙ্গনের সামনের সারিতে মোতায়েন করতে পারবে ক্রেমলিন।
মুজিকা এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে লিখেছেন, 'ফেব্রুয়ারিতে আগ্রাসন শুরুর সময় রুশ সেনা ঘনত্ব ছিল কম। তারপরও একাধিক দিকে অপারেশন শুরু করে। এই কৌশলের মাধ্যমে মস্কো আশা করে, একসাথে উত্তর, দক্ষিণ ও পূবদিকের হামলায় পর্যদুস্ত হবে কিয়েভ'।
'কিন্তু, এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় রণক্ষেত্রের বিভিন্ন এলাকায় প্রয়োজনীয় জনবলের ঘাটতি দেখা দেয়'।
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, এখন রাশিয়ার দখলীকৃত এলাকার পরিসর কমেছে। এতে করে, অধিকৃত বাদবাকি অঞ্চল রক্ষায় সেনা ঘনত্ব বাড়ানো যাবে। ফলে মার্চের শুরুর দিকের পর প্রথমবারের মতো কিলোমিটারপ্রতি রুশ সেনা উপস্থিতি বাড়তে চলেছে'।
পশ্চিমা একজন কর্মকর্তা প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে জানান, ডনবাসে নতুন করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রক্ষণাত্মক কাঠামো গড়ে তুলেছে মস্কো। খেরসন থেকে প্রত্যাহার করা ৫০ শতাংশ রুশ সেনাকে সেখানে মোতায়েন করা হতে পারে।
খেরসনে লড়াই শেষ হওয়ায়– দক্ষিণ থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ কিয়েভ-ও পাবে। ইউক্রেনীয় বিমান বাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ওলিস্কি মেলনিয়াক। বর্তমানে তিনি কিয়েভ-ভিত্তিক চিন্তক সংস্থা- রাজুমকভ সেন্টার- এ কর্মরত। তিনি বলছেন, 'রাশিয়ানদের সাফল্য রুখতে হলে সঙ্গতকারণেই ইউক্রেনকে দনেৎস্ক প্রদেশে বাড়তি সেনা সমাবেশ করতে হবে'।
এরমধ্যেই ডনবাস অঞ্চলের দনেৎস্ক থেকে রুশ সেনাদের হঠাতে হিমশিম খাচ্ছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। আভদিভকা শহরের কাছে চলছে প্রচণ্ড লড়াই। একই অবস্থা বাখমুতের কাছাকাছি এলাকায়। সামরিক রসদ, জনবল পরিবহনে বাখমুত বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শহরটি প্রধান একটি মহাসড়কের পাশে অবস্থিত। এর দখল রুশ সেনাদের ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্যান্য বড় শহরে সহজে যাতায়াতের সুবিধা দেবে।
শত্রুবাহিনীর অভ্যন্তরে গিয়ে হামলাসহ বিপজ্জনক অনেক কাজ করে বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা। বাখমুতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলা লড়াইয়ে প্রতিদিন বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। ইউক্রেনীয় স্পেশাল ফোর্সের এক সৈনিক এ লড়াইকে 'নরক' বলে বর্ণনা করেন। ।
সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, 'দেখে মনে হয়- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনো রণভূমি। যেন ডি-ডে'র (ইউরোপকে মুক্ত করতে মিত্র বাহিনীর উভচর অভিযান) আগের লড়াই'। সম্পূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে অসংখ্য পরিখা, বাঙ্কার, ট্যাংক ট্র্যাপ, রেজর ওয়্যার ও গোলার আঘাতে সৃষ্ট গর্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার কথা জানান তিনি।
লে. কর্নেল মেলনিয়াক অবশ্য মনে করেন, আপাতত দক্ষিণাঞ্চলেই বেশি জোর দেবে কিয়েভ। 'ইউক্রেনের জন্য পূর্ব রণাঙ্গন বেশ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ মারিওপোল ও মেলিতোপোলের ফ্রন্ট– কারণ এখানে প্রচণ্ড আঘাত হেনে ক্রিমিয়ার রসদ সরবরাহ থেকে রুশ বাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে'।
খেরসনের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে দনিপ্রো নদী। নদীর পূব পাড় থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে রুশ সেনাদের। এই বাধা দূর হলেও নিকট ভবিষ্যতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ইউক্রেনীয় সেনারা নদীটি পার হবে না বলে মনে করছেন পশ্চিমা সামরিক কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা। তবে তাদের ধারণা, রুশ অধিকৃত এলাকা এখন ইউক্রেনের হাইমার্স রকেটের পাল্লার মধ্যে চলে আসায়– খেরসন প্রদেশের আরও ভেতরের দিকে সরবরাহ লাইন সরিয়ে নেবে রাশিয়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পূব ও দক্ষিণের ফ্রন্টে নতুন আক্রমণ অভিযান পরিচালনার লক্ষ্যে সেনা সমবেত করতে পারে ইউক্রেন। দক্ষিণের মেলিতোপোল, বার্দিয়ানস্ক ও মারিওপোল শহর শত্রুর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে পারলে, ইউক্রেনীয় সেনাদের ক্রিমিয়া উপদ্বীপে প্রবেশের পথ তৈরি হবে। তবে একাজটি আদৌ সম্ভব কিনা– তা নিয়ে ইউক্রেন ও পশ্চিমা কর্মকর্তাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
কৌশলটি অনুমান করেছে রাশিয়াও। গত সপ্তাহে ইউক্রেনের জেনারেল স্টাফ জানায়, মেলিতোপোলের কাছে সেনাদের জড়ো করছে রাশিয়া।
রাশিয়া এখন ক্ষেপনাস্ত্র হামলা বাড়াবে বলে মনে করছেন ইউক্রেনের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আঁন্দ্রি জাগোরদনিউক। গত মঙ্গলবারও ইউক্রেন লক্ষ্য করে ঝাঁকে ঝাঁকে মিসাইল ছুঁড়েছে রাশিয়া। আঁন্দ্রি বলেন, 'রাশিয়া জানে, শীতকালে জরুরি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা সামলানো বছরের উষ্ণ সময়ের তুলনায় অনেক কঠিন হবে'।
বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন,আগামী মাসগুলোতে যুদ্ধের ময়দানে এক ধরনের অচলাবস্থা থাকবে উভয় পক্ষের। কিন্তু, ইউক্রেন যদি আরও বেশি অগ্রগতি করে- তাহলে গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করে সংঘাতকে ছড়িয়ে দিতে পারেন পুতিন। তিনি ইতঃপূর্বে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকিও দিয়েছেন।
রাশিয়া যেন কোনো পরিস্থিতিতেই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার না করে– সেজন্য দেশটিকে বার বার হুঁশিয়ার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একইসঙ্গে, আলোচনার চেষ্টাও করছে। গত সোমবার তারই অংশ হিসেবে, তুরস্কের আঙ্কারায় রুশ গুপ্তচর প্রধানের সাথে বৈঠক করেন সিআইএ পরিচালক বিল বার্নস। যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কর্মকর্তাদের মধ্যে এটাই প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক– যার কথা জানা গেছে।
বৈঠকের বিষয়ে হোয়াইট হাউস জানায়, 'আমরা আগেও বলেছি, ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাশিয়ার সাথে যোগাযোগের চ্যানেল খোলা রাখা হবে। বিশেষত, পারমাণবিক হুমকি ও কৌশলগত স্থিতিশীলতার জন্য' এই যোগাযোগ থাকবে।