রাশিয়ার ইলেকট্রনিক জ্যামার ইউক্রেনের ৯০ শতাংশ ড্রোন ধ্বংস করেছে!
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে দুপক্ষই কমবেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, দু পক্ষই চেষ্টা করছে অপরপক্ষে হটিয়ে যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার। তবে একদিক থেকে রুশরা ইউক্রেনের তুলনায় বেশ খানিকটা এগিয়ে রয়েছে, আর তা হলো এর ইলেকট্রনিক যন্ত্রগুলো। খবর ফোর্বসের।
ফেব্রুয়ারির শেষদিকে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের পর রাশিয়া কয়েক সপ্তাহ সময় নেয় তাদের জ্যামিং ব্যবস্থা নির্মাণের জন্য। তবে একবার সেটি চালুর পরই তারা ইউক্রেনের কমান্ডারদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র ড্রোনগুলোকে তারা সহজেই নাজেহাল করে ফেলেছে।
যুদ্ধের শুরুর দিকে কিয়েভের হাতে সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল তাদের আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকল (ইউএভি) ড্রোনগুলো। এই ড্রোনগুলোর সাহায্যে তারা সহজেই রাশিয়ার বিশাল কামান আর রকেট লঞ্চারের অবস্থান নিখুঁতভাবে শনাক্ত করে এগুলোর বিরুদ্ধে নিজেদের ছোটোখাটো আর্টিলারি দিয়েই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছিলো।
কিন্তু রাশিয়ার ইলেকট্রনিক জ্যামারগুলো ড্রোনগুলোকে ঠিকভাবে কাজ করতে দিচ্ছে না, ফলে ইউএভিগুলো ঠিকভাবে রাশিয়ার যুদ্ধাস্ত্রগুলোকে ঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারছে না। লন্ডনের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনিস্টিউটের নিখায়লো জাব্রোদস্কি, জ্যাক ওয়াটলিং, ওলেকজান্ডার ড্যানিলুক এবং নিক রেনল্ডস ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে ইউক্রেনের এই নিখুঁত অবস্থান শনাক্ত করার ক্ষমতা গুঁড়িয়ে দেওয়া রাশিয়ার জয়ের আশাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
যুদ্ধ বিশেষজ্ঞরা ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই রুশ দখলকৃত পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার জ্যামিং সিস্টেমের দিকে নজর রেখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে এসবি-৬৩৬ এসভেত-কেইউ সিগনালস-ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম, যেটি ইউক্রেনের ড্রোনগুলোর অবস্থান তাদের রেডিও সিগনাল ট্রেস করে নিখুঁতভাবে শনাক্ত করতে পারে। এছাড়াও রয়েছে আরবি-৩৪১ভি লিয়ার-৩স সিস্টেম, যার মধ্যে রয়েছে সেলুলার-জ্যামিং পেলোড বহন করা অরলান-১০ ড্রোন এবং কামাজ-৫৩৫০ ট্রাকের ওপর থাকা কমান্ড পোস্ট। আর-৯৩৪বি সিনিৎসা রেডিও জ্যামার এবং স্যাটেলাইট সিগনাল আটকে দেওয়া আর-৩৩০জেডএইচ ঝিতসেলও রাশিয়ার এই জ্যামিং সিস্টেমের অংশ।
রাশিয়ার এই ইলেকট্রনিক-ওয়্যারফেয়ার যন্ত্রগুলো এতটাই সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে যে ওএসসিই (অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন ইন ইউরোপ) তাদের নিজেদের ড্রোনই আকাশে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। ওএসসিই তাদের ইউএভি ওড়ানোর সময় সিগনালে বাধা পাওয়ার পরিসংখ্যান: ফেব্রুয়ারিতে ১৬ শতাংশ, মার্চে ২৮ শতাংশ এবং এপ্রিলে ৫৮ শতাংশ।
রাশিয়ার ইডব্লিউ সিস্টেম সবচেয়ে ভালো কাজ করে যখন তাদের অপারেটররা পুরো সিস্টেম ঠিকভাবে সেটাপ করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়। এ কারণেই পূর্ব ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে রাশিয়ার ইডব্লিউ সিস্টেম প্রতিপক্ষের জন্য আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে।
একই কারণে প্রথম কয়েক সপ্তাহেও রাশিয়ার জ্যামিং সিস্টেম ভালোভাবে কাজ করেনি। রাশিয়ার সৈন্যরা এগোলেও খুব দ্রুত পিছিয়ে এসেছে, যে কারণে তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি ইডব্লিউ-এর সৈন্যরা। ফলে জ্যামিং সিস্টেম ভালোভাবে কাজ করেনি।
তবে মার্চ আর এপ্রিল মাসে অবস্থার পরিবর্তন হয়, যখন রুশ বাহিনী মধ্য ইউক্রেন থেকে সরে এসে পূর্ব অংশে ঘাঁটি গাঁড়ে।
ইউক্রেন বিমান বাহিনীর ফাইটার বিমানের পাইলটরা প্রথম রাশিয়ান জ্যামিং সিস্টেমের কার্যকারিতা টের পায়। যখনই ইডব্লিউ সিস্টেম কাজ শুরু করে ইউক্রেনের পাইলটরা বুঝতে পারে তাদের এয়ার-টু-গ্রাউন্ড এবং এয়ার-টু-এয়ার যোগাযোগব্যবস্থা জ্যাম হয়ে গিয়েছে, তাদের নেভিগেশন যন্ত্র বন্ধ হয়ে গিয়েছে এবং রাডারগুলো বিকল হয়ে পড়েছে।
পূর্বাঞ্চলে ধীরে ধীরে রাশিয়ান জ্যামারগুলোর পরিমাণ বাড়তে থাকে। দনবাস অঞ্চলে রাশিয়া প্রতি ১৩ মাইলে ১০টি করে ইডব্লিউ কমপ্লেক্স তৈরি করে রেখেছে। একসাথে এই জ্যামারগুলো ফ্রন্টলাইনে থেকে আর্টিলারির অবস্থান শনাক্ত করা এবং ইউক্রেনের যুদ্ধবিমান ও ইউএভি জ্যাম করতে থাকে।
ইউক্রেনের ব্রিগেডগুলো রুশদের অবস্থান শনাক্তের জন্য মূলত দুই ধরনের ড্রোন ব্যবহার করে: ছোট কোয়াডকপ্টার কিংবা অক্টোকপ্টার এবং তুরস্কের তৈরি বায়রাক্তার টিবি-২-এর মতো বড় ফিক্সড-উইং ইউএভিগুলো। যখনই রাশিয়ান জ্যামারগুলো কাজ করতে থাকে, তখনই জিপিএস এবং রেডিও সংযোগ বন্ধ হয়ে যায় এবং ড্রোনগুও মাছির মতো নিচে পড়তে থাকে।
জাব্রোদস্কি, ওয়াটলিং, ড্যানিলুক এবং রেনল্ডস জানান, 'একেকটি কোয়াডকপ্টার সাধারণত তিন বার ওড়ানো যায়, অন্যদিকে ফিক্সড-উইং ইউএভিগুলো ওড়ানো যায় ছয়বার। সবমিলিয়ে, এক-তৃতীয়াংশ ইউএভি মিশন সফল ধরে নেওয়া যায়।'
ইউক্রেন যে হাজার হাজার ড্রোন ব্যবহার করেছে যুদ্ধের প্রথম দিক থেকে, তার ৯০ শতাংশই গ্রীষ্মের মধ্যে ধ্বংস করে দিয়েছে রুশরা। এখন কিয়েভের কর্তৃপক্ষ এগুলোর প্রতিস্থাপনের জন্য তাদের বিদেশির মিত্রদের সাহায্য চাচ্ছে।
ইউক্রেনের ড্রোনের ওপর এই ধ্বংসযজ্ঞ ইউক্রেনের আরকমণকে অনেকটাই অকার্যকর করে দিয়েছে, তাদের আর্টিলারিগুলো নিখুঁতভাবে অবস্থান শনাক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং রুশ সৈন্যদের সময় দিচ্ছে পুনরায় তাদের শক্তি বাড়িয়ে পুনঃআক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে।
রুশ সেনাবাহিনী ব্যর্থ হলেও ইডব্লিউ জ্যামারগুলো তাদের কাজ ঠিকভাবেই করতে সক্ষম হয়েছে: পুরো আকাশ ইলেকট্রনিক নয়েজে ভরিয়ে দেওয়া। যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেন তাদের ড্রোনগুলো কাজে লাগাতে পারলেও রুশ ইডব্লিউগুলো তাদের এই কৌশল সম্পূর্ণ ভেস্তে দিয়েছে। এখন এগুলো এড়িয়ে তারা কীভাবে নতুন কৌশল সাজাবে তা সময়ই বলে দেবে।