ড্রোন তৈরিতে আফ্রিকান নারীদের নিয়োগ দিচ্ছে রাশিয়া
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত বিজ্ঞাপনগুলোতে বিনামূল্যে প্লেনের টিকিট, নগদ অর্থ এবং ইউরোপে একটি রোমাঞ্চকর ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, আপনাকে শুধু একটি কম্পিউটার গেম শেষ করতে হবে এবং ১০০ শব্দের রাশিয়ান শব্দভাণ্ডারের একটি পরীক্ষা দিতে হবে।
কিন্তু এই বিজ্ঞাপনের সাড়া দেওয়া কয়েকজন আফ্রিকান তরুণী রাশিয়ার তাতারস্তান অঞ্চলে পৌঁছে বুঝতে পেরেছিলেন, তাদের জন্য অন্য বাস্তবতা অপেক্ষা করছে। তারা যে রোমাঞ্চের আশা করেছিলেন, তার বদলে তাদের যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কারখানায় কাজ করতে হয়, যেখানে তারা ইউক্রেনে হামলা চালানোর জন্য ইরানি নকশার ড্রোন তৈরি করেন।
এপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব নারীরা তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তারা দীর্ঘ সময় কাজ করার কথা বলেছেন এবং তাদের সবসময় নজরদারিতে রাখা হতো। তাদের মজুরি এবং পড়াশোনার বিষয়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো ভঙ্গ করা হয়েছে এবং তাদের ত্বক ক্ষতিকারক রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসার ফলে ত্বকে দাগ এবং চুলকানি দেখা দিয়েছে।
দেশের শ্রম সংকট মোকাবিলায় রুশ সরকার আফ্রিকার উগান্ডা, রুয়ান্ডা, কেনিয়া, দক্ষিণ সুদান, সিয়েরা লিওন এবং নাইজেরিয়ার মতো দেশ থেকে কম বয়সী নারী কর্মী নিয়োগ করছে। পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা থেকেও লোক আসছে। এই নিয়োগ কার্যক্রম এখন এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকায়ও প্রসারিত হচ্ছে।
এপি'র তদন্ত অনুসারে, "আলাবুগা স্টার্ট" নামে একটি অনলাইন নিয়োগ প্রচারণার মাধ্যমে প্রায় ২০০ আফ্রিকান নারীকে রাশিয়ার অস্ত্র উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ করা হয়েছে। এই নারীরা রাশিয়ার ১৬ বছর বয়সী ভোকেশনাল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাতারস্তানের আলাবুগা স্পেশাল ইকোনমিক জোনের (বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল) একটি কারখানায় কাজ করছেন, যেটি মস্কো থেকে প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত।
ফাঁদে পা দেওয়া
যিনি নিজের পুরোনো চাকরি ছেড়ে রাশিয়ার চাকরির প্রস্তাব গ্রহণ করা এক নারী সোজাসাপ্টা ভাষায় বলেন, "আমি আসলে ড্রোন বানাতে জানি না।"
তিনি হানান, তিনি রাশিয়ায় যাওয়ার জন্য বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলেন। বিমানবন্দরে সেলফি তুলেছিলেন, বিমানভ্রমণের সময় খাবারের ছবি তুলেছিলেন এবং ইন-ফ্লাইট মানচিত্রের "ইউরোপ" কথাটির দিকে ক্যামেরা ফোকাস করেছিলেন।
কিন্তু আলাবুগায় পৌঁছানোর পর তিনি বুঝতে পারলেন, এটা আসলে একটি "ফাঁদ" ছিল। তিনি বলেন, "এই প্রতিষ্ঠান কেবল ড্রোন বানায়, আর কিছুই না। আমি আফসোস করি এবং অভিশাপ দিই, যেদিন আমি এসব জিনিস বানাতে শুরু করেছিলাম।"
চাকরির প্রকৃত বিষয়টি সম্পর্কে একটি ইঙ্গিত ছিল তাদের দেওয়া শব্দভাণ্ডার পরীক্ষায়। সেখানে "কারখানা" এবং "হুক করা" ও "আনহুক করা"-এর মতো ক্রিয়াপদ ছিল।
কর্মীদের ওপর সবসময় নজরদারি চলত, কাজের সময় ছিল দীর্ঘ, আর বেতন ছিল প্রত্যাশার চেয়ে কম। কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের চাকরি ছাড়ার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করত। যদিও কেউ কেউ রাশিয়ায় অন্যত্র কাজ খুঁজে নিয়েছিল বা চাকরি ছেড়েছিল বলে জানা গেছে; তবে এ তথ্য স্বাধীনভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
ড্রোন কারখানার সম্প্রসারণ
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ শুরু করার পর, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইরানের সঙ্গে ১.৫ বিলিয়ন ইউরোর একটি সামরিক চুক্তি করেন। সেই বছরের শেষের দিকে মস্কো যুদ্ধে ইরানি ড্রোন ব্যবহার শুরু করে।
প্রথমে ইরান থেকে শাহেদ-১৩৬ ড্রোনের যন্ত্রাংশ রাশিয়ায় পাঠানো হতো। তবে এখন এটির উৎপাদন আলাবুগা এবং সম্ভবত আরও একটি কারখানায় স্থানান্তরিত হয়েছে।
আলাবুগার এই কারখানাটি এখন রাশিয়ার প্রধান ড্রোন উৎপাদন কেন্দ্র, যেখানে ২০২৫ সালের মধ্যে বছরে ৬ হাজার ড্রোন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। এই তথ্য ফাঁস হওয়া নথি এবং ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি-এর প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে।
জাতিসংঘের সাবেক অস্ত্র পরিদর্শক ডেভিড অ্যালব্রাইট জানান, কারখানাটি নির্ধারিত সময়ের আগেই এগোচ্ছে এবং ইতোমধ্যেই ৪ হাজার ৫০০ ড্রোন তৈরি করেছে।
তবে পর্যাপ্ত কর্মী পাওয়া একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়ায় বেকারত্বের হার কম এবং অনেক রুশ নাগরিক হয় সামরিক খাতে কাজ করছেন, ইউক্রেনে যুদ্ধ করছেন বা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। ফলে কারখানাটি পেশাদার ছাত্র এবং স্বল্প ব্যয়ে বিদেশি কর্মী নিয়োগ করতে শুরু করেছে।
অ্যালব্রাইটের মতে, "আলাবুগা স্টার্ট" প্রোগ্রামের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া প্রায় ৯০ শতাংশ বিদেশি নারী ড্রোন তৈরিতে নিযুক্ত, বিশেষত যেসব কাজে কম দক্ষতার প্রয়োজন জন্য।
ফাঁস হওয়া নথি অনুযায়ী, ২০২৩ সালে কারখানাটির কর্মী সংখ্যা ছিল প্রায় ৯০০ এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সংখ্যাটি ২,৬০০ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
টিকটক গেমস
এই বছরের প্রথম ছয় মাসে মূলত মধ্য ও পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলো থেকে ১৮২ জন নারীকে নিয়োগ দেওয়া হয় আলাবুগা স্টার্ট প্রোগ্রামের মাধ্যমে। এ নিয়ে ফেসবুকে প্রচারণা চালানো হয়। এ প্রোগ্রামটি "ক্যারিয়ার শুরু করার" সুযোগ দেওয়ার কথা বলে দক্ষিণ আমেরিকা এবং এশিয়া থেকেও নারী কর্মী সংগ্রহ করছে।
উগান্ডা এবং ইথিওপিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই প্রোগ্রামকে অর্থ উপার্জন এবং নতুন দক্ষতা অর্জনের একটি সুযোগ হিসেবে প্রচার করেছে। উগান্ডায় নিয়োগের ইভেন্টও আয়োজন করা হয়; এমনকি এতিমখানাগুলোতেও প্রোগ্রামটি প্রচার করা হয়েছে বলে আলাবুগার টেলিগ্রাম চ্যানেলের বিভিন্ন বার্তা থেকে তথ্য পাওয়া যায়। রুশ কর্মকর্তারা মস্কোর ২৬টিরও বেশি দূতাবাসে গিয়ে প্রোগ্রামটি প্রচার করেছেন।
আগে এটি একটি 'ওয়ার্ক-স্টাডি' (শিক্ষার পাশাপাশি কাজ) প্রোগ্রাম হিসেবে প্রচারিত হলেও, পরে আলাবুগা স্টার্ট তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে তোলে। নতুন পোস্টগুলোতে উল্লেখ করা হয়, এটি 'একটি শিক্ষা প্রোগ্রাম নয়'। যদিও একটি পোস্টে এখনও স্কুল ইউনিফর্ম পরা তরুণীদের দেখা যাচ্ছে।
মে মাসে সিয়েরা লিওনের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইয়োংগাও আলাবুগা পরিদর্শন করেন এবং তার দেশের পাঁচজন অংশগ্রহণকারীর সাথে দেখা করেন। তিনি মনে করেছিলেন, এটি একটি শিক্ষা প্রোগ্রাম এবং আশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, "ভবিষ্যতে সিয়েরা লিওনের ৩০ জন শিক্ষার্থী আলাবুগাতে পড়াশোনা করতে পারলে সেটি একটি চমৎকার বিষয় হবে।"
আলাবুগা স্টার্ট একটি বড় ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে, যেখানে সুন্দরভাবে এডিট করা ভিডিওগুলোতে আফ্রিকান নারীদের তাতারস্তানের সাংস্কৃতিক স্থানগুলোতে ঘুরে বেড়াতে এবং খেলাধুলা করতে দেখা যায়। ভিডিওতে তাদের মেঝে পরিষ্কার করতে, ক্রেন পরিচালনা করতে এবং রঙ বা কেমিক্যাল প্রয়োগের সময় সুরক্ষা সরঞ্জাম পরিহিত অবস্থায় হাসি মুখে কাজ করতে দেখা যায়।
তবে এই ভিডিওগুলোতে রাশিয়ার ড্রোন উৎপাদনের সাথে এই কারখানার ভূমিকার কোনো উল্লেখ নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পেজগুলো আফ্রিকানদের চাকরির অনুরোধে পূর্ণ হয়ে গেছে।অনেকেই বলছেন, তারা চাকরির আবেদন করলেও এখনও কোনো উত্তর পায়নি।
গত মাসে আলাবুগা স্টার্ট-এর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পেজে বলা হয়, "আমাদের দর্শক উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ঘোষণা করতে পেরে আমরা উত্তেজিত।"
এটি সম্ভবত টিকটক ও ইনস্টাগ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে কাজ করার কারণে হয়েছে, যাদের মধ্যে বাসি নামের একজন দক্ষিণ আফ্রিকানও আছেন, যার টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে প্রায় ৮ লাখ অনুসারী রয়েছে।
ড্রোনের কার্যকারিতা
বিদেশি শ্রমিকদের সাহায্যে রাশিয়া তার ইরানি ডিজাইন করা শাহেদ ড্রোনের বহর উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে। অ্যালব্রাইটের সংস্থার মতে, ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ইউক্রেনের বিরুদ্ধে প্রায় ৪ হাজার ড্রোন উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। তবে এই বছরের প্রথম সাত মাসেই রাশিয়া প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক ড্রোন উৎক্ষেপণ করেছে।
যদিও আলাবুগা কারখানার উৎপাদন নির্ধারিত সময়ের আগে চলছে, ড্রোনগুলোর গুণগত মান নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে এবং উৎপাদনের সমস্যাগুলো ম্যালফাংশন (ত্রুটি) সৃষ্টি করছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
২,০০০ শাহেদ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিয়ে ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর নথির ওপর ভিত্তি করে করা এপি'র একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রায় ৯৫ শতাংশ ড্রোন স্পষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারেনি। বরং, সেগুলো নদী ও মাঠে পড়েছে, ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশ লাটভিয়ায় প্রবেশ করেছে অথবা রাশিয়া বা বেলারুশে নেমে পড়েছে।
উচ্চ ব্যর্থতার হার ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষার উন্নতির কারণে হতে পারে। তবে আলব্রাইট বলেছেন, এটি কম দক্ষ শ্রমিক ব্যবহারের ফলে কারণে খারাপ নির্মাণের ফলাফলও হতে পারে।
এছাড়াও, রাশিয়া শাহেদ ড্রোনের একটি সংস্করণ ব্যবহার করছে, যেটি বিস্ফোরক ওয়ারহেড বহন করে না। এটি সম্ভবত ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষাকে চমকে দিতে অর্থাৎ বাস্তবে 'ডামি ড্রোন' হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে।
পুড়ে যাওয়া এবং নজরদারি
বিদেশি শ্রমিকরা তাদের আবাস থেকে কারখানায় যাওয়ার জন্য বাসে সফর করেন, যেখানে তাদের লাইসেন্স প্লেট স্ক্যান করার পর একাধিক নিরাপত্তা চেকপোস্টে যাতায়াত করতে হয়। অন্য যানবাহনগুলো আরও কঠোর চেকিং-এর মুখোমুখি হয়।
তারা হোস্টেলে থাকেন এবং রান্নাঘর ভাগাভাগি করেন, যা "২৪ ঘণ্টা রক্ষিত" থাকে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কিছু পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের আবাসের প্রবেশাধিকার 'ফেসিয়াল রিকগনিশন'-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং তাদের নজরদারি ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয়। হোস্টেলে পোষা প্রাণী, মদ এবং মাদক নিষিদ্ধ।
বিদেশি শ্রমিকরা আসার সময় তাদের ফোনের জন্য স্থানীয় সিম কার্ড পান, তবে সেটি কারখানায় নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নেই কারণ সেটি একটি সেনা সংবেদনশীল স্থান।
এক নারী জানিয়েছেন, তিনি শুধু তার ব্যবস্থাপকের অনুমতি নিয়ে একজন এপি প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছেন। অন্য একজন জানিয়েছেন, তার বার্তা নজরদারি করা হয়। তৃতীয় একজন কর্মী বলেছেন, বাইরের লোকের সঙ্গে তাদের কাজ সম্পর্কে আলোচনা না করার জন্য বলা হয়। এবং চতুর্থ একজন বলেছেন, ব্যবস্থাপকরা তাদেরকে একে অন্যের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করতে উৎসাহিত করেন।
একজন ড্রোন নির্মাতা এপিকে বলেছেন, তাদেরকে ড্রোন তৈরির এবং একটি ক্ষতিকারক পদার্থ দিয়ে সেটি আবরণ করার পদ্ধতি শেখানো হয়, যার ঘনত্ব অনেকটা দইয়ের মতো অনুভূত হয়। তিনি বলেন, অনেক শ্রমিকের নিরাপত্তার সরঞ্জাম নেই। এই তরল তার মুখে ছোট ছোট সূঁচ দিয়ে গেঁথে যাওয়ার অনুভূতি তৈরি করে এবং তার গালে "ছোট ছিদ্র" দেখা দিয়েছে, যার কারণে তীব্র চুলকানি হয়েছে।
তিনি বলেন, "ও ঈশ্বর, আমি নিজেকে ইচ্ছেমতো চুলকাতে পারি। আমি কখনোই চুলকিয়ে ক্লান্ত হই না। অনেক মেয়েই এ কষ্ট ভোগ করছে।"
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়