পুতিনকে কি যুদ্ধাপরাধের দায়ে সত্যিই বিচার করা সম্ভব?
সাধারণত যুদ্ধশেষের পরেই যুদ্ধের নিয়ম-নীতি ভাঙার জন্য অভিযোগ দায়েরসহ অন্যান্য বিচারকাজ শুরু হয়। তবে ইউক্রেন এর অপেক্ষা করেনি। যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই ধরা পড়া রুশ সৈন্যদের বিচারের আওতায় এনেছে তারা। তবে চেইন অফ কমান্ডের শীর্ষে থাকা সামরিক কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রে কী হবে? ইউক্রেনের বেসামরিক ব্যক্তি ও ভবনের ওপর হামলার কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ রুশ প্রেসিডেন্ট এবং তার অধস্তনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছে। যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করার পর একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল পুতিনের বিরুদ্ধে ১৭ মার্চ গ্রেপ্তারের ওয়ারেন্ট জারি করেছে। তবে, পুতিনসহ অন্যান্য রুশ নেতাদের কি আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব?
১। যুদ্ধাপরাধ কী?
১৮৬৪ সাল থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যবর্তী বিভিন্ন সময়ে চুক্তি হওয়া শর্তের ওপর ভিত্তি করে যুদ্ধের শর্তাবলী সাজানো জেনেভা কনভেনশনের নিয়ম ভঙ্গ করাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই যুদ্ধাপরাধের অধীনে রয়েছে ইচ্ছাকৃত হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, অনাহারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার, আত্মসমর্পণ করা প্রতিপক্ষকে হত্যা, রাসায়নিক এবং জৈবিক অস্ত্রের মতো নিষিদ্ধ অস্ত্রের ব্যবহার এবং ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক ব্যক্তিদের ওপর আক্রমণ। ইউক্রেনে রুশ সৈন্যদের ওপর করা এই অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছে ক্রেমলিন।
২। পুতিনের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ করা হয়েছে?
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত পুতিন এবং তার শিশু অধিকার সম্পর্কিত উপদেষ্টা আলেক্সেইভনা এল্ভোভা-বেলোভার বিরুদ্ধে ইউক্রেন থেকে রাশিয়ায় অবৈধভাবে শিশুদেরকে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ এনেছে। ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী যুদ্ধ শুরুর পর প্রায় ১৬ হাজার শিশুকে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এদিকে রুশ কর্মকর্তারা জানিয়েছে যুদ্ধের সময় মানবিকতার খাতিরেই শিশুদেরকে নিয়ে গিয়েছে তারা।
৩। এর আগে কীভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে?
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধের বিচার হিসেবে এর আগে দ্বিতীয় বিসশ্বযুদ্ধের সময় বেশ কিছু জার্মান ও জাপানি সৈন্যকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। মিত্রপক্ষ নিজেদেরকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থেকে মুক্ত বলে কার্যকর করায় ওই বিচারগুলোকে 'বিজয়ীদের বিচার' বলে সমালোচনা করা হয়েছিল। এই দ্বন্দ্ব এড়ানোর জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ স্বাধীন, আন্তর্জাতিক এক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, যেটি নব্বইয়ের দশকে রুয়ান্ডা ও বলকান গণহত্যার বিচার করেছে। গণ-অমানবিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারকার্য পরিচালনার জন্য এরপরেই একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালত প্রতিষ্ঠার কথা ভাবা হয়। অবশেষে ২০০২ সালে রোম আইনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন করা হয়। ১২৩টি সদস্য দেশ এই আদালতের সদস্য হওয়ার জন্য এই আইনকে অনুমোদন করেছে। অনুমোদন না করা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে রাশিয়া, চীন, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় বড় নাম, যাদের দাবি অনুযায়ী এই আইনের স্বীকৃতি দেওয়া মানে তাদের সংবিধানে থাকা অধিকারের লঙ্ঘন।
৪। ইউক্রেন কীভাবে এগোচ্ছে?
যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু দেশের সমর্থনে ইউক্রেন শুরু থেকেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হওয়ার প্রমাণ সংগ্রহ করে আসছে। ডিসেম্বরের শুরু পর্যন্ত তারা ৫০ হাজারেরও বেশি প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। প্রথম বিচারেই ইউক্রেনের এক আদালত একজন অস্ত্রবিহীন বেসামরিক ইউক্রেনীয় নাগরিককে হত্যার দায়ে একজন রুশ সৈন্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে। দ্বিতীয় আরেকটি বিচারে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আর্টিলারি আক্রমণ করায় দুইজন রুশ সৈন্যকে ১১.৫ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। এদিকে দ্য কনভার্সেশনে প্রকাশিত হওয়া ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অফ জুরিস্টসের প্রেসিডেন্ট রবার্ট গোল্ডম্যানের মন্তব্য অনুযায়ী, ইউক্রেনের পদ্ধতি অনুমোদনযোগ্য হলেও এটি কোনো বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত নয়। তিনি জানান যে, ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ দ্য রেড ক্রস এ ধরনের বিচার কাজ পরিচালনার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে, কারণ এর ফলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিচারকদের শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব থাকায় অভিযুক্তরা ঠিকভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রস্তুতি নিতে পারেন না।
৫। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) কী করছে?
আইসিসি ইতিমধ্যেই তাদের অধীনে থাকা এমন মামলার তদন্তের জন্য ৪২ সদস্যের একটি দল ইউক্রেনে পাঠিয়েছে। যদিও ইউক্রেন আইসিসির কোন সদস্য নয়, তারপরেও নিজেদের ভূখণ্ডে ঘটা ঘটনাগুলোর তদন্তের ভার আইসিসির ওপর ছেড়ে দিয়েছে দেশটি।
যুদ্ধাপরাধ ছাড়াও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইউক্রেনে মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার তদন্ত করছে। কোনো বেসামরিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রক্রিয়াগতভাবে অথবা একাধারে হত্যা, কারাদণ্ড, নির্বাসন, ধর্ষণ, ধরে নিয়ে যাওয়ার মতো বিষয়গুলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অন্যদিকে ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী, জাতি, জাতীয়তা, বর্ণ এবং ধর্মের ওপর ভিত্তি করে কোনো জনগোষ্ঠীর ওপর আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংসযজ্ঞ চালানোই গণহত্যা। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেন্সকি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ করে বলেছেন, তিনি [পুতিন] একটি দেশ হিসেবে ইউক্রেনের অস্তিত্ব শেষ করে দিতে চান।
৬। পুতিন বা অন্যান্য রুশ কর্মকর্তাকে আইনের আওতায় আনার সম্ভাবনা কতটুকু?
অভিযুক্তের উপস্থিতি ছাড়াই বিচারকাজ পরিচালনা করার অনুমতি দেয় না আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং পুতিন বা তার কোনো অধস্তনকে ধরতে পারবে না আইসিসি তা একপ্রকার নিশ্চিত। আইসিসি কোন অভিযুক্তকে ধরার জন্য তার কোনো সদস্য রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে, এবং অভিযুক্ত রুশ কর্মকর্তারা আইসিসির কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার মতো সম্ভাবনা থাকা সদস্য দেশগুলোকে আপাতত এড়িয়েই চলবেন তা বলাই যায়। এখনো পর্যন্ত আইসিসি যে ২৪ জনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছে, তার এক-তৃতীয়াংশই এখনো ধরা পড়েননি। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তারাও কোনো সশস্ত্র দলের নেতা, কোন রাজনৈতিক বা সামরিক কর্মকর্তা নয়; কেবল চারজন ছাড়া: লিবিয়ার এক জেনারেল, সুদানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির এবং তার দুই মন্ত্রী। এই চারজনের কাউকেই আইসিসির কাছে পাঠানো সম্ভব হয়নি। বলকান এবং রুয়ান্ডা গণহত্যার সময় বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হলেও সে ট্রাইব্যুনালগুলো গঠন করেছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, যেখানে রাশিয়ার ভেটো ক্ষমতা রয়েছে।
সূত্র: ব্লুমবার্গ