যেভাবে রাশিয়ান জ্যামার মার্কিন স্মার্ট বোমার লক্ষ্যে আঘাত হানা ব্যর্থ করে দিচ্ছে
ইউক্রেনকে দেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্যাটেলাইট-গাইডেড বোমাগুলো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে ব্যর্থ হচ্ছে। জয়েন্ট ডিরেক্ট অ্যাটাক মিউনিশন (জেড্যাম) নামক এ বোমাগুলো রাশিয়ার ইলেকট্রনিক-ওয়ারফেয়ার জ্যামিং ব্যবস্থার কারণে লক্ষ্যবস্তু পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না। খবর পপুলার মেকানিক্স-এর।
আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য গতানুগতিক বোমার গায়ে জেড্যাম নামক একটি কিট সংযুক্ত করার মাধ্যমে বোমাগুলোকে প্রিসিশন-গাইডেড অস্ত্রে পরিণত করা যায়।
গত এক বছর ধরে ইউক্রেনের বিমানবাহিনীর পুরোনো হয়ে যাওয়া যুদ্ধবিমানগুলোতে অত্যাধুনিক মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ করতে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন দুই দেশই। গত সেপ্টেম্বরে মিগ-২৯ ও সুখোই-২৭ যুদ্ধবিমানের মাধ্যমে আমেরিকার তৈরি আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য এজিএম-৮৮ হাই-স্পিড অ্যান্টি-রেডিয়েশন মিসাইল (হার্ম) ব্যবহারের কথা প্রকাশ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ইউক্রেনের বিমান বাহিনী।
এরপর ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে ইউক্রেনে স্যাটেলাইট-গাইডেড জেড্যাম পাঠাবে এটি। গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) স্যাটেলাইট সিগন্যাল দ্বারা পরিচালিত এ বোমাগুলো পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেন যেন প্রিসিশন-গাইডেড বোমার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। কিন্তু চার মাস পর এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, তাদের জিপিএস বোমাগুলো রাশিয়ার জ্যামিং ব্যবস্থার কাছে পরাস্ত হচ্ছে।
জেড্যাম আদতে এক ধরনের প্রযুক্তিগত কিট। এতে থাকে জিপিএস রিসিভার, কম্পিউটার চিপ, ও আকাশে বোমার গতিপথ ঠিক রাখার জন্য ব্যবহৃত ডানা। গতানুগতিক বোমাগুলো সাধারণত বিমান থেকে ফেলার পর অভিকর্ষের টানেই মাটিতে পড়ে। ফলে অনেক সময়ই এগুলো লক্ষ্যবস্তুতে ঠিকমতো আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়।
জেড্যাম এ ধরনের গতানুগতিক আন-গাইডেড বোমাকে স্মার্টবোমায় পরিণত করে। এসব বোমার দামও কম। এগুলোর গায়ে জেড্যাম কিটটি জুড়ে দেওয়া হয়। ৫০০ পাউন্ডের এমকে-৮২, ১,০০০ পাউন্ডের এমকে-৮৩ এবং ২,০০০ পাউন্ডের এমকে-৮৪ ইত্যাদি বোমায় জেড্যাম সংযুক্ত করা হয়।
সাধারণ পদ্ধতি ব্যবহার করেই জেড্যাম বোমাকে যুদ্ধবিমানে সংযুক্ত করা হয়। আকাশে ওড়ার পর পাইলট ভূমিতে অবস্থিত লক্ষ্যবস্তুর জিপিএস কোঅর্ডিনেট জেড্যাম-এর চিপে প্রবেশ করাতে পারেন। জেড্যাম বহনকারী বিমান আকাশের যথেষ্ট উঁচুতে উঠে তারপর বোমা নিক্ষেপ করে।
বিমান যত বেশি ওপরে থাকে, জেড্যাম বোমা ততবেশি দূরে গ্লাইড করতে পারে। বিমান থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বোমাটি লক্ষ্যবস্তুর জিপিএস কোঅর্ডিনেটকে উদ্দেশ্য করে সরলরৈখিকভাবে এগোতে থাকে। প্রয়োজনে জেড্যাম কিটের ডানা নাড়াচাড়া করে গতিপথ ঠিক করে নেয়। পরিশেষে লক্ষ্যবস্তুর ১৫ ফুট এলাকার মধ্যে বিস্ফোরিত হয় এটি।
ইউক্রেনযুদ্ধ নিয়ে ফাঁস হওয়া মার্কিন নথির তথ্য অনুযায়ী, জেড্যাম বোমাগুলো তাদের লক্ষ্যবস্তুতে ঠিকমতো আঘাত হানতে পারছে না। ওই নথিগুলোতে এ ব্যর্থতার জন্য রাশিয়ার ইলেকট্রনিক-ওয়ারফেয়ারকে, বিশেষ করে রেডিও জ্যামিং ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়েছে।
যুদ্ধে জ্যামিং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে রাশিয়া অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। রাশিয়ান বাহিনী পশ্চিমাদের প্রিসিশন-গাইডেড, বিশেষত স্যাটেলাইট গাইডেড অস্ত্রের কথা জানত, আর তাই এ হুমকিকে মোকাবিলা করতে তারা পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
রাশিয়া এর জন্য জিপিএস জ্যামিং প্রযুক্তি তৈরি করেছে। এছাড়া রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর পাঁচটি ইলেকট্রনিক-ওয়ারফেয়ার ব্রিগেড রয়েছে যেগুলোর কাজ হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে জ্যামিং অপারেশন পরিচালনা করা।
রাশিয়ার ভেতরে, প্রতিবেশী দেশসমূহে এবং বহির্বিশ্বে যেসব জায়গায় রাশিয়ান বাহিনী অভিযান পরিচালনা করেছে — সেসব জায়গায় দেশটির জিপিএস জ্যামিং প্রযুক্তি একটি সাধারণ বিষয়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে জিপিএস ব্যবস্থা জ্যাম করে দেওয়া হয় যাতে ইউক্রেনের ড্রোন রাশিয়ার অভ্যন্তরস্থ বিমানঘাঁটিগুলোত হামলা চালাতে না পারে।
সিরিয়াতে নিজেদের সামরিক ঘাঁটিসমূহ রক্ষা করার জন্য রাশিয়া জ্যামিং প্রযুক্তি ব্যবহার করার ফলে জিপিএস সেবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তুরস্ক, লেবানন, ইসরায়েল এবং সাইপ্রাস পর্যন্ত। ২০১৮ সালে ইউক্রেনে এক সফরের সময় ড্রোন হামলা থেকে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তার গাড়িবহরকে রক্ষা করেছিল এ জ্যামিং ব্যবস্থা।
রাশিয়ার জ্যামিং ব্যবস্থা জেড্যাম বোমার ওপর কীভাবে কাজ করতে পারে তার একটি ধারণা দিয়েছে পপুলার মেকানিক্স: ইউক্রেন বিমানবাহিনীর মিগ পাইলট ভূমির লক্ষ্যবস্তুর জিপিএস কোঅর্ডিনেট জেড্যাম বোমায় প্রবেশ করান। তার বিমান রাশিয়ান ফ্রন্ট লাইনের কাছাকাছি আসার পর রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা রাডার মিগটিকে শনাক্ত করে কাছাকাছি অবস্থিত ইলেকট্রনিক-ওয়ারফেয়ার ইউনিটের কাছে খবর পৌঁছায়।
এরপর ইলেকট্রনিক-ওয়ারফেয়ার দল তাদের শক্তিশালী ক্রাসুখা-৪, পোল ২১-ই, অথবা আর-৩৩০জেডএইচ জিটেল জ্যামারগুলো চালু করে। এ জ্যামার স্যাটেলাইটের রেডিও সিগন্যালকে অকার্যকর করে দেয়। এতে জিপিএস সিগন্যাল না পেয়ে জেড্যাম সাধারণ বোমায় পরিণত হয়, এবং লক্ষ্যবস্তু থেকে সরে যায়।
তবে জেড্যাম বোমাগুলোর একটি ব্যাকআপ ইনার্শিয়াল নেভিগেশন সিস্টেম (আইএনএস) রয়েছে। এটির মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তুর ৯০ ফুট কাছাকাছি এলাকায় ৫০ শতাংশ নির্ভুলতায় পৌঁছাতে পারে জেড্যাম। এ দূরত্ব খুব কাজের নয়, আবার এতে যে কিছু লক্ষ্য ধ্বংস হয় না, তাও নয়। যেমন, এ দূরত্বে জ্বালানি ও গোলাবারুদের ডিপো, আর্টিলারি, ও হালকা সাঁজোয়া যান ও অস্ত্র ধ্বংস করতে পারে জেড্যাম।
জেড্যাম ইউক্রেনে ব্যর্থ হওয়ার কয়েকটি সম্ভাবনা থাকতে পারে। একটি হতে পারে, ইউক্রেন বাহিনী রাশিয়ার ট্যাংক, বাঙ্কারের মতো সাঁজোয়া লক্ষ্যবস্তুর ওপর জেড্যাম ব্যবহার করছে। এ ধরনের লক্ষ্য ধ্বংসের জন্য সরাসরি আঘাতের প্রয়োজন হয়, কিন্তু আইএনএস অতটা নিখুঁত নয়।
আবার এমনও হতে পারে যে, ইউক্রেনে পাঠানো জেড্যাম বোমাগুলোতে কোনো ব্যাকআপ আইএনএস রাখেনি যুক্তরাষ্ট্র। আরেকটি সম্ভাবনা হতে পারে, হয়তো ইউক্রেনের যুদ্ধবিমানগুলো এত নিচু হয়ে ওড়ে যে, জেড্যাম জিপিএস সিগন্যাল হারানোে পর যাত্রাপথ ঠিক করার জন্য পর্যাপ্ত সময় ধরে ওড়ার সুযোগ পায় না।
জিপিএস জ্যামিং ঠেকাতে নতুন জেড্যামগুলোতে জিপিএসের পাশাপাশি লেজার গাইডেন্স ব্যবস্থাও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এ পদ্ধতি কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় লেজার ডেজিগনেটর নেই ইউক্রেনের যুদ্ধবিমানগুলোতে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের এখন নতুন কোনো অস্ত্র দরকার, অথবা রাশিয়ার জ্যামার ধ্বংস করার পদ্ধতি বের করা দরকার। মার্কিনীদের শক্তিশালী যুদ্ধ-সক্ষমতাগুলোকে অকার্যকর করতে অনেক বিনিয়োগ করেছে রাশিয়া, তার সুফল পাচ্ছে দেশটি।