ইউক্রেনের সৈন্য ও দামি অস্ত্রকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে সস্তা রাশিয়ান ড্রোন
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের ১৭তম মাস চলছে। যুদ্ধে কম খরচের আত্মঘাতী ড্রোনের ব্যবহার বাড়িয়ে তুলেছে রাশিয়া। দাম কম হলেও এ ড্রোনগুলো ইউক্রেনের অনেক দামী অস্ত্র ধ্বংস করছে, অন্যদিকে এগুলোকে প্রতিহত করতেও বেগ পেতে হচ্ছে কিয়েভকে।
ইউক্রেনের সৈন্যরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে রাশিয়ার ল্যান্সেট ড্রোন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাশিয়াপন্থী চ্যানেলগুলোতে প্রকাশিত অনেক ভিডিওতে ল্যান্সেট ড্রোনকে ইউক্রেনের পশ্চিমা অনেক অস্ত্র ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে দেখা গেছে। এ তালিকায় আছে পশ্চিমা যুদ্ধাস্ত্র লেপার্ড ২ ট্যাংক এবং সিজার সেল্ফ-প্রপেলড হাউটজারও।
ইউক্রেনের চারটি আর্টিলারি দলের সেনারা রয়টার্সকে বলেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর একটি এ ল্যান্সেট ড্রোনগুলো।
অনেক সৈন্য জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রাশিয়া এ ড্রোনের ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছে।
'এর আগে বসন্তের সময় তারা এখনকার মতো এত পরিমাণে ল্যান্সেট ব্যবহার করেনি,' বলেন ৩৫ বছর বয়সী আর্টিলারি গানার বোহড্যান।
সেন্টার ফর আ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি'র অ্যাডজাঙ্কট সিনিয়র ফেলো স্যামুয়েল বেনডেট বলেন, 'কম খরচে পশ্চিমা গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রের ওপর হামলা চালানোর জন্য রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ল্যান্সেট ড্রোনের উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে।'
তিনি বলেন, প্রকাশিত বিভিন্ন রাশিয়ান সূত্র অনুযায়ী, একটি ল্যান্সেট ড্রোনের জন্য খরচ পড়ে আনুমানিক তিন মিলিয়ন রুবল বা ৩৫ হাজার ডলারের মতো।
অন্যদিকে, রাশিয়ার এস-৩০০ মিসাইলের কেবল একটির জন্যই খরচ করতে হয় কয়েক লাখ মার্কিন ডলার। আর একটি লেপার্ড ২ ট্যাংকের দাম কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অবশ্য কম খরচে রাশিয়ান লক্ষ্যবস্তুতে হামলার জন্য শক্তিশালী ড্রোন সক্ষমতা তৈরি করেছে ইউক্রেনও।
আক্রমণকারী ড্রোনগুলো লক্ষ্যবস্তুতে বিস্ফোরক (পেলোড) নিক্ষেপ করতে পারে, অথবা এগুলো 'লয়টারিং মিউনিশন' হিসেবে আত্মঘাতী হামলা চালাতে পারে।
বেনডেট বলেন, ইউক্রেনের ড্রোন হামলার সাফল্যের পর এখন রাশিয়াও ড্রোন হামলার মাধ্যমে জবাব দিতে চাইছে।
রাশিয়া ইউক্রেনের প্রথম দিকের কিছু কৌশল ব্যবহার করছে বলে জানা গেছে। যেমন এটি বড় বড় লক্ষ্যবস্তুকে খোলা স্থানে এনে তারপর আত্মঘাতী ড্রোন হামলা চালাচ্ছে, বলেন বেনডেট।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা ইউরি স্যাক স্বীকার করেছেন, রাশিয়ার ল্যান্সেট ড্রোনের ব্যবহার বাড়িয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি কঠিন করে তুলেছে। ইউক্রেন প্রতিদিন কমপক্ষে এক থেকে দুটি ল্যান্সেট ভূপাতিত করছে বলেও জানান তিনি।
স্যাক জানান, ল্যান্সেট ড্রোনগুলোতে তুলনামূলক ছোট আকারের দেড় থেকে পাঁচ কেজির বিস্ফোরক থাকে।
তবে গতানুগতিক আর্টিলারি গোলা ও বেশিরভাগ রকেটের চেয়ে কম শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও ধ্বংস করার ক্ষেত্রে কম যায় না এ ড্রোনগুলো।
ল্যান্সেট ড্রোন একজন পাইলট পরিচালনা করেন। এদিক থেকে এটি ইরানের তৈরি শাহেদ-১৩৬ ড্রোন থেকে ভিন্ন। কারণ শাহেদ-১৩৬ ড্রোনের গন্তব্য আগে থেকেই প্রোগ্রাম করে দেওয়া হয় এবং যাত্রাপথে এগুলোর দিক পরিবর্তন করা যায় না।
ল্যান্সেট-এর সর্বশেষ মডেল ল্যান্সেট ৩ ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে বলে জানিয়েছেন বেনডেট। ফলে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনের অনেক ভেতরে প্রবেশ করে এ ড্রোন আঘাত হানতে পারছে।
এ ড্রোনটি আকাশে অপেক্ষা করতে পারে। এছাড়া দরকার মতো তেড়ে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম এটি। ফলে ইউক্রেনের ট্যাংক, সেল্ফ-প্রপেলড আর্টিলারি, রকেট লঞ্চ সিস্টেমের মতো উচ্চমূল্যের যুদ্ধাস্ত্রগুলোর জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে ল্যান্সেট।
ইউক্রেনের বিএম-২১ গ্র্যাড নামক রকেট লঞ্চার বিস্তৃত এলাকায় ৪০টি পর্যন্ত রকেট নিক্ষেপ করতে পারে। সোভিয়েত যুগের এ ট্রাকচালিত রকেট উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা এখন রাশিয়ার ল্যান্সেটের বড় লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
ইউক্রেনের একটি গ্র্যাড লঞ্চার সিস্টেমের একজন ক্রু ভরন। তিনি মে মাসের গোড়ার দিকে ল্যান্সেটের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়টার্স-এর কাছে প্রকাশ করেছেন।
রাশিয়ান অবস্থানে হামলা চালানোর পরমুহূর্তেই তার গ্র্যাড লঞ্চার সিস্টেমের ওপর এস-৩০০ মিসাইল নিক্ষেপ করে রাশিয়ান বাহিনী। লঞ্চারকে আঘাত না করে মোটামুটি ১৫০ মিটার দূরে এসে পড়ে এস-৩০০।
কিন্তু তারপরই একটি ল্যান্সেট ড্রোন আকাশে উদয় হয় এবং ভরনের রকেট সিস্টেমকে তাড়া করতে শুরু করে।
'আমরা পালানোর সিদ্ধান্ত নেই… প্রায় ৫০ মিটার যাওয়ার পর এটি আমার ডান পাশে এসে পড়ে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ এটি আমাদের ওপর এসে পড়েনি,' ২৭ বছর বয়সী ভরন বলেন।
ল্যান্সেটের মতো যেসব ড্রোন নিচ দিয়ে এবং ধীরগতিতে ওড়ে, সেগুলো চিরায়ত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করে দেয়। কারণ ওসব আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে দ্রুতগামী বড় হিট সিগনেচারসমৃদ্ধ লক্ষ্যবস্তুকে প্রতিহত করার জন্য।
স্যাক জানান, জাল বা ধাতুর তৈরি খাঁচা ল্যান্সেট বিস্ফোরণের ক্ষতি কিছুটা কমাতে পারে। কিন্তু তার মতে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রতিরক্ষা হলো, রাডারসংযুক্ত স্বয়ংক্রিয় অ্যান্টি-ড্রোন কামান ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ব্যবস্থা।
এসব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় ইউক্রেনের সৈন্যরা প্রায় ল্যান্সেট ড্রোন ছোট অস্ত্র দিয়ে গুলি করে ভূপাতিত করার চেষ্টা করতে বাধ্য হন।
কিন্তু ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে চলা কোনো বস্তুকে রাইফেল দিয়ে গুলি করে ভূপাতিত করা কঠিন বলে মন্তব্য করেন স্যাক।