যেভাবে সমতল পৃথিবীতে বিশ্বাসীকে বোঝাবেন পৃথিবী আদতে গোলাকার
পৃথিবী গোল বা ডিম্বাকৃতির নয়, বরং সমতল — একুশ শতকের বিজ্ঞানের এ অগ্রগতির যুগেও এমন বিশ্বাসের কিছু মানুষ আছেন। মানুষ এতভাবে প্রমাণ করেছে পৃথিবীর আকার গোল, তাও চ্যাপ্টা পৃথিবীতে বিশ্বাসীদের সেসবে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
আমাদের মাথার ওপরে পাঁচ হাজারের বেশি স্যাটেলাইট রয়েছে যেগুলোর তোলা ছবিতে পৃথিবী স্পষ্ট গোল হয়ে ধরা পড়ে। তবে সমতল পৃথিবীতে বিশ্বাসী (ফ্ল্যাট-আর্থার) বলবেন, এসব ছবি ভুয়া। ব্যাপারটা যেন অনেকটা এরকম — আপনার চোখের সামনে একটি কমলালেবু পড়ে আছে, কিন্তু একজন ফ্ল্যাট-আর্থার দাবি করছেন, ওই কমলালেবু আদতে চ্যাপ্টা, আপনি যা দেখছেন সেই দেখায় কোথাও গন্ডগোল আছে।
স্যাটেলাইট আবিষ্কার হওয়ার আগে, পৃথিবীর চারপাশ ঘুরে আসারও অনেক আগে থেকে মানুষ জানত পৃথিবী গোলাকার। এ জ্ঞানের বয়স দুই হাজার বছরের বেশি। গণিতের পাকা হিসেবেও পৃথিবী গোলাকার।
তাও যদি কেউ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন পৃথিবী সমতল, তাহলে তার ভুল ধারণা ভেঙে দেওয়ার জন্য তাকে কিছু সহজ ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করা যেতে পারে।
ব্যাখ্যা ১
সবাই জানে, আমরা যত ওপরে উঠি, তত বেশি দূর দেখতে পাই। পৃথিবী যদি সমতল হতো, তাহলে বিষয়টি এমন হতো না। সেক্ষেত্রে দূরের জিনিস দেখার জন্য আপনাকে উঁচু কোনো স্থানে উঠতে হতো না, পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে দাঁড়িয়েই আপনি অনায়াসেই পৃথিবীর 'শেষ মাথা' দেখতে পেতেন।
সমতল পৃথিবীতে শক্তিশালী দুরবিন ব্যবহার করে নিউ ইয়র্ক থেকে মাদ্রিদ বেশ ভালোভাবেই দেখা যেত। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হয় না পৃথিবীপৃষ্ঠের বক্রতার কারণে।
আর এ কথাটা সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ জানত। সেজন্যই তো বড় বড় টাওয়ারের শীর্ষে লাইটহাউসগুলো স্থাপন করা হয়েছিল যাতে অনেকদূর থেকেই সেগুলো দেখা যায়।
আবার আরেকটি বিষয় ভাবুন, আপনি একটি বন্দরে দাঁড়িয়ে থেকে কোনো জাহাজের আগমন দেখছেন। প্রথমে আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে একটি মাস্তুল, জাহাজের সবচেয়ে উঁচু অংশ। এরপর ধীরে ধীরে আপনি জাহাজের পাল তারপর পুরো কাঠামোটা দেখতে পাবেন। পৃথিবী সমতল হলে তো পুরো জাহাজটাই একবারে একসঙ্গে দেখতে পেতেন।
ব্যাখ্যা ২
বিশ্বের সব স্থানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় ভিন্ন ভিন্ন। সমতল পৃথিবী হলে এমনটা সম্ভব হতো না। এছাড়া আগের ব্যাখ্যার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে বলা যায়, কোনো স্থানে কোন সময়ে সূর্য অস্ত যাবে তা নির্ভর করে আপনি কত উঁচু থেকে বিষয়টি দেখছেন তার ওপর।
মুসলমান জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এ বিষয়টি নিয়ে বিশদ গবেষণা চালিয়েছেন। বিশ্বের প্রায় সকল স্থানের সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় ছকাকারে এখন অনলাইনে পাওয়া যায় যাতে করে মানুষ জানতে পারে ঠিক কখন রোজা ভাঙতে হবে।
দুবাইয়ের বুর্জ খলিফায় নিচতলা আর সবচেয়ে উঁচুতলার মধ্যে সূর্য ডোবার সময়ের পার্থক্য তিন মিনিটের। অর্থাৎ ওই ভবনের নিচ থেকে একজন যে সময়ে সূর্যকে অস্তাচলে নামতে দেখবেন, ভবনটির শীর্ষস্থানে থাকা কেউ তার তিন মিনিট পর সূর্য ডুবতে দেখবেন। সমতল পৃথিবীতে এটি কখনোই ঘটত না।
ব্যাখ্যা ৩
সমতল ও অঘূর্ণনশীল পৃথিবীতে পানি সরাসরি বেসিনের মাঝখানে চলে যেত। কিন্তু বাস্তবে পানিভর্তি কোনো বেসিন যখন খালি করা হয়, তখন ছিদ্রপথে পানি বের হওয়ার সময় একটি ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হয়।
এমনটা হওয়ার কারণ কোরিওলিস প্রভাব, যা কেবল গোলাকার পৃথিবীর ঘূর্ণন দিয়েই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তবে কোনো ফ্ল্যাট-আর্থার যদি দাবি করেন, সমতল পৃথিবীও এর অক্ষকে কেন্দ্র করে ঘোরে, তাহলে গোলাকার পৃথিবীর মতো দুই বিপরীত ঘূর্ণনমেরু না থাকার কারণে ঘূর্ণায়মান সমতল পৃথিবীতে পানির এমন আবর্ত তৈরি হতো না।
ব্যাখ্যা ৪
রাতের আকাশের গতিবিধি দিয়েও বোঝা যায় পৃথিবী আদতে গোলাকৃতির। উত্তর গোলার্ধে আকাশ ধ্রুবতারার কাছে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘোরে।
অন্যদিকে দক্ষিণ গোলার্ধে আকাশ সাউদার্ন ক্রস নক্ষত্রমণ্ডলীকে ঘিরে বিপরীত দিকে ঘোরে। সমতল পৃথিবীতে এমনটা ঘটার জন্য প্রতি গোলার্ধে একে অপরের বিপরীতে ঘূর্ণায়মান দুটো করে জ্যোতিষ্কমণ্ডলের প্রয়োজন হতো।
অনুবাদ: সুজন সেন গুপ্ত