টিভি উপস্থাপিকার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বরখাস্ত হওয়ার নেপথ্যে!
চীনের বরখাস্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবাহিত কিন গ্যাং দেশটির জনপ্রিয় টেলিভিশন উপস্থাপিকা ফু জিয়াওতিয়ানের সাথে বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। একইসাথে তারা দুজনে যুক্তরাষ্ট্রে সারোগেসির মাধ্যমে এক সন্তানও জন্ম দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত মঙ্গলবার দ্য ফাইনান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু সূত্রের বরাত দিয়ে এমন তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এতে করে চীনের জ্যেষ্ঠ এ কূটনীতিকের আচমকা নিখোঁজ এবং অপসারণের বিষয়ে যেন আরও ঘোলাটে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
৪০ বছর বয়সী ফু জিয়াওতিয়ান হংকং ভিত্তিক চীনা ব্রডকাস্টার ফোনিক্স টিভির একটি টক শো-এর উপস্থাপক ছিল। চীনের ৫৭ বছর বয়সী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে তার সম্পর্ক থাকার বিষয়টি সংবাদমাধ্যমটিকে জনপ্রিয় এই তারকার ঘনিষ্ঠ ছয় ব্যক্তি নিশ্চিত করেছেন।
রিপোর্টে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্র জানায়, গত বছর জিয়াওতিয়ান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকটা গোপনে সারোগেসির মাধ্যমে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তবে সেখানে সন্তানের বাবার নাম উল্লেখ করা হয়নি।
চাঞ্চল্যকর সব তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর যেন আরও বহু প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। কিছুদিন আগেই শি জিনপিং সরকারের বেশ ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন কিন। তবে গত জুলাই মাসে হুট করেই যেন দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যান তিনি। এর কিছুদিন পর জানা যায়, তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে কিনকে কেন্দ্র করে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়নি। বরং সংবাদ সম্মেলনে বিদেশি সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তর বরাবরই এড়িয়ে গিয়েছেন দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গরা।
গতকাল (বুধবার) চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে কিনের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে এক মুখপাত্র বলেন, "এটা কোনো কূটনীতিক প্রশ্ন নয়।"
সিএনএন-এর পক্ষ থেকে কিন কিংবা জিয়াওতিয়ানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সেটি সম্ভব হয়নি। এদিকে জনপ্রিয় উপস্থাপক জিয়াওতিয়ান গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট উইচ্যাটে পোস্ট করা বন্ধ করে দেন। তার ঘনিষ্ঠ এমন দুইজন ব্যক্তি সিএনএনকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
চীনে তদন্ত চলাকালীন জনপ্রিয় ব্যক্তি, ব্যবসায়ী কিংবা কর্মকর্তাদের কয়েক সপ্তাহ কিংবা মাসের জন্য নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা বেশ অহরহই শোনা যায়। ঠিক একইভাবে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের রিপোর্টে চীনা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানানো হয় যে, দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ তদন্তে দেখা যায় যে, কিন ওয়াশিংটনে চীনা দূত হিসেবে থাকাকালীন বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়েছিল।
সেখানে কিন ও তার প্রেমিকার এক সন্তানেরও জন্ম হয়েছিল। তবে সেখানে ঠিক কোন নারীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছেন ও সন্তানের পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের রিপোর্ট মতে, কিনের এমন কর্মকাণ্ড চীনের জাতীয় নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে কি-না, সেই বিষয়ে অধিকতর তদন্ত করা হচ্ছে।
চীনা সরকারের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, কিন বহু আগেই বিয়ে করেছেন। তার সেই ঘরে এক ছেলে সন্তানও রয়েছে।
ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টার থিংক ট্যাংকের চীনা প্রোগ্রামের ডিরেক্টর ইউন সান জানান, চীনে রাজনীতিবিদদের এমন প্রেমের সম্পর্কের ঘটনা নতুন নয়। তবে এমনটা খুব কমই শোনা যায় যে, প্রেমের সম্পর্ক থেকেই তারা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।
উইন সান বলেন, "কিনকে যদি সত্যিকার অর্থেই প্রেমের সম্পর্ক থাকার কারণে বরখাস্ত করা হয়, সেক্ষেত্রে এটি বেশ অনন্য নজির হবে। কেননা জাতীয় পর্যায়ে শুধু প্রেমের সম্পর্ক থাকার কারণে কাউকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা আমার জানা নেই।"
অবশ্য কিন ও জিয়াওতিয়ানের মধ্যকার সম্পর্কের গুঞ্জনটি চীনের সেন্সরড সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে বহু আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বিশেষ করে গত জুন মাসে সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিখোঁজ হলে গুঞ্জনটি যেন আরও সামনে চলে আসে।
জিয়াওতিয়ান মূলত ফোনিক্স টিভিতে 'টক উইথ ওয়ার্ল্ড লিডারস' প্রোগ্রামের মাধ্যমে বেশিরভাগ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। যেখানে তিনি কিনসন বহু বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।
জিয়াওতিয়ানের সাথে ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি ফাইনান্সিয়াল টাইমকে জানান, জনপ্রিয় এই টিভি উপস্থাপক ২০১০ সালের দিকে লন্ডনে কিনের সাথে পরিচিত হন। পরবর্তীতে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করেন এবং ফোনিক্স টিভির লন্ডন শাখায় যোগ দেন। একই সময়ে কিন আবার চীন সরকারের হয়ে যুক্তরাজ্যে কর্মরত ছিলেন।
পরবর্তীতে এক দশকে বেইজিংয়ে কিন ও জিয়াওতিয়ান নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখেছিলেন বলে রিপোর্টে দাবি করা হয়। তবে গত বছরের ডিসেম্বরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে কিন জনপ্রিয় এই টিভি উপস্থাপকের সাথে যোগাযোগ কিছুটা কমিয়ে দেয়।
গত মার্চ মাসে কিন চীনা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র পদ, স্টেট কাউন্সিলর হিসেবে নিয়োগ পান। ঠিক সেদিনই জিয়াওতিয়ান নিজের এক মিলিয়নেরও বেশি ফলোয়ার থাকা উইবো অ্যাকাউন্টে নিজের সন্তানের ছবি পোস্ট করে লিখেন, "এক্বটি জয়ী সমাপ্তি।"
ঐ একই দিনে আরেকটি পোস্টের মাধ্যমে জিয়াওতিয়ান জানান, তার সন্তানের বাবা আমেরিকান কেউ নন। তিনি শীঘ্রই চীনে ফিরবেন।
অন্যদিকে জিয়াওতিয়ানের বিলাসী জীবনযাপন যেন সন্দেহের মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। উইবোতে পোস্ট করা ছবিতে দেখা যায়, তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় সমুদ্রের তীরে বেশ বিলাসবহুল বাড়িতে বসবাস করতেন। একইসাথে অনেক সময় প্রাইভেট জেটে যাতায়াত করতেন। বহুদিন সাংবাদিকতায় জড়িত থাকলেও এতটা ব্যয়বহুল জীবনযাপন করা সম্ভব কি-না, সেটা নিয়ে অনেকের মাঝেই প্রশ্ন রয়েছে।
পাবলিক রেকর্ডস থেকে জানা যায়, জিয়াওতিয়ানের ক্যালিফোর্নিয়ায় বাড়িটির ২০২১ সাথে প্রতি মাসে ভাড়া ছিল ৫৫ হাজার মার্কিন ডলার। সেখানে ৮ টা বেডরুম ও ৯ টির চেয়েও বেশি বাথরুম রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় বিশাল অঙ্কের অর্থ প্রদানের গুঞ্জনও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
জিয়াওতিয়ান সর্বশেষ গত ১১ এপ্রিল উইবোতে পোস্ট করেছিলেন। একই সময়ে তিনি চীনে ফেরত এসেছিলেন।
কূটনৈতিক মহলে ততটা পরিচিত না হলেও ২০২১ সালে কিনকে রাষ্ট্রদূত করে ওয়াশিংটনে পাঠানো হয়। সেখানে বিভিন্ন সময় জনসংযোগে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় কিনকে। আমেরিকান সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বেসবল ম্যাচে দর্শক হিসেবে দেখা যায় তাকে। এমনকি ইলন মাস্কের সাথে টেসলার একটি গাড়িতে চড়তেও দেখা গেছে তাকে।
ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তাইওয়ান ইস্যুতে কিন মধ্যপন্থী মন্তব্য করেন। রাশিয়ার পরিকল্পনা জানা থাকলে চীন ক্রেমলিনকে ইউক্রেন আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখত বলে মন্তব্য করেন কিন। এমনকি তাইওয়ানের সাথে যুদ্ধের ঝুঁকি কমিয়ে আনার কথাও বলেছিলেন তিনি।