'হত্যাকাণ্ড চালিয়ে ইসরায়েল কখনোই আরও নিরাপদ হবে না': নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনি দূত
ফিলিস্তিনিদের ওপর হত্যাকাণ্ড চালিয়ে ইসরায়েল কখনোই আরও নিরাপদ হবে না; এমনটাই মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘে ফিলিস্তিন স্থায়ী পর্যবেক্ষক রিয়াদ মনসুর। একইসাথে তিনি অনতিবিলম্বে রক্তপাত বন্ধের আহ্বান জানান।
গত বুধবার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ বন্ধে একটি খসড়া প্রস্তাব তোলা হয়। তবে যুক্তরাস্ট্রের ভেটোর পর সেটি নাকচ হয়ে যায়। উল্টো দেশটি গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার নিন্দা করে।
একইসাথে ভেটো প্রদানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত যুক্তি দেন যে, "ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে।" অন্যদিকে রিয়াদ মনসুর অভিযোগ করে যে, কোনো কোনো দেশ এখনও এমন একটি শক্তির আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বলে যারা ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক দেশত্যাগ এবং ধ্বংস করতে চায়।
এদিকে চলমান যুদ্ধে গত মঙ্গলবার গাজার আল-আহলি হাসপাতালে হামলার কয়েকশ রোগী এবং বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। নির্মম এই ঘটনায় বিশ্বজুড়ে সমালোচনা আর তীব্র নিন্দার ঝড় ওঠে। এই ঘটনার ঠিক একদিন পর তীব্র উত্তেজনার মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদে এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
হাসপাতালে হামলার পেছনে ফিলিস্তিনের পক্ষ থেকে সরাসরি ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েল এই অভিযোগ পুরপুরি নাকচ করে দিয়েছেন।তাদের দাবি, গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠীর ছোড়া রকেট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে এই ঘটনা ঘটেছে।
তবে শুধু গত বুধবার নয়, এর আগে গত সোমবারও রাশিয়ার পক্ষ থেকে যুদ্ধ বন্ধে নিরাপত্তা পরিষদে খসড়া প্রস্তাব তোলা হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। তাদের অভিযোগ ছিল, রাশিয়ার প্রস্তাবে হামাসের কথা উল্লেখ করে গোষ্ঠিটির প্রতি নিন্দা প্রকাশ করা হয়নি।
ঐ প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে মনসুর বলেন, "কাউন্সিল যদি দুই দিন আগেও যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাত, তবে তা শত শত মানুষের জীবন বাঁচতে পারত।"
জাতিসংঘের মহাসচিব, বিশ্বের ধর্মীয় নেতাদের যেমন পোপ, আরব রাষ্ট্র, মুসলিম দেশ ও বিশ্বের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের কথা উল্লেখ করে এখনি রক্তপাত বন্ধ আহ্বান জানিয়েছেন মনসুর।
অন্যদিকে গালফ কো-অপারেশন পক্ষ থেকে ওমানের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আল-হাসান নিরাপত্তা পরিষদকে বলেন, সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে না পারার ব্যর্থতার ফলে প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে।
মোহাম্মদ আল হাসান আরও বলেন, "কয়েক দশক ধরে নিরাপত্তা পরিষদ আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে ফিলিস্তিন প্রশ্নের একটি দীর্ঘস্থায়ী, ন্যায্য সমাধান খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়েছে। যার মধ্যে কাউন্সিলের গৃহীত প্রস্তাবগুলিও রয়েছে। ফলে উভয় পক্ষ ভুক্তভোগী হচ্ছে এবং নাগরিকেরা সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন অবস্থায় রয়েছে।"
মোহাম্মদ আল হাসান মনে করেন, দ্বিমুখী নীতির মাধ্যমে ইসরায়েল নিরাপত্তা কাউন্সিল এবং এর রেজুলেশনকে অমান্য করেছে। একইসাথে ইসরায়েল অসংখ্যবার ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে।
আল হোসাইন বলেন, "আল-আহিল হাসপাতালের হত্যাকাণ্ড খুবই বিপজ্জনক ঘটনা। এটি আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন।"
অন্য রাষ্ট্রদূতদের উদ্দেশ্য করে আল হোসাইন বলেন, "ইসরায়েল বিশ্বের চোখের সামনে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের মেরে ফেলছে। এটা কি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন নয়?"
আল হোসাইন মনে করেন, "ইসরায়েল দুর্ভিক্ষ ঘটানো থেকে শুরু করে সামষ্টিক শাস্তি প্রদানের মতো অপরাধগুলো করছে, নাৎসিরাও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একই কাজ করেছিল। আজকের বিশ্বে এর কোনো স্থান নেই।"
আল-হোসাইন আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রাখার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের কাউন্সিলের প্রতি আহ্বান জানান। একইসাথে তিনি বলেন, "আমাদের কাছে প্রমাণ করুন যে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, এমনকি সেটা যদি ইসরায়েল হয়, তবু্ও।"
অন্যদিকে জাতিসংঘে আরব গ্রুপের পক্ষ থেকে বক্তব্য প্রদানকালে জর্ডানের রাষ্ট্রদূত মাহমুদ হামুদ বলেন, "আরব দেশগুলি আল-আহলি হাসপাতালে নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের ইসরায়েলের সেনাবাহিনী দ্বারা গণহত্যার কঠোরতম নিন্দা জানায়। এই জঘন্য যুদ্ধাপরাধের জন্য একমাত্র ইসরাইল দায়ী।"
বর্তমানে আরব গ্রুপের প্রেসিডেন্সির দায়িত্ব পালন করছে জর্ডান। সেই সুবাদে রাষ্ট্রদূত মাহমুদ হামুদ নিরাপত্তা পরিষদকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির জন্য পদক্ষেপ নিতে এবং গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ করতে আহ্বান জানায়।
মাহমুদ হামুদ মনে করেন, ইসরায়েলি দখলদারিত্ব চলমান সংঘাতের পেছনে মূল কারণ। তাই তিনি শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে ১৯৬৭ সালের সীমানার উপর ভিত্তি করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়, যার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম।
অন্যদিকে জাতিসংঘে মিশরের স্থায়ী প্রতিনিধি ওসামা আবদেলখালেক মনে করেন, আল-আহলি হাসপাতালে হামলা 'ফিলিস্তিনি জনগণকে নির্মূল করার এবং তাদের নিজ ভূখণ্ড থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার' প্রচেষ্টা।
আবদেলখালেক বলেন, চলমান যুদ্ধ গত ৮ই অক্টোবর শুরু হয়নি। বরং তারও অনেক আগে শুরু হয়েছে যখন ইসরায়েলি দখলদারিত্ব শুরু করে।"
আবদেলখালেক সতর্ক করেন যে, "এভাবে দখলদারিত্ব চলতে পারে না। ইসরায়েলের অপরাধ উপেক্ষা করা যাবে না।"
অন্যদিকে জাতিসংঘে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান কাউন্সিলের সদস্যদের পাল্টা জিজ্ঞাসা করেন, "এখানে হচ্ছেটা কী? ১০ দিন আগে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বর্বর সন্ত্রাসী হামলা, ৯/১১-এর চেয়েও যে বড় হামলা হয়েছে, সেটা কাউন্সিল কি ইতিমধ্যে ভুলে গেছে। তবে আমি আপনাদের অবশ্যই সেটি মনে করিয়ে দিতে চাই।"
গিলাদ এরদান জানান, হামাস হলোকাস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের হত্যা করেছে যারা নাৎসিদের কাছ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল শুধু তাদের জীবন বাঁচাতে। একইসাথে তিনি দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের আহ্বান নাকচ করে দেন।
গিলাদ এরদান বলেন, "ক্যান্সার নিরাময়ের একমাত্র সমাধান হল প্রতিটি ক্যান্সার কোষকে নির্মূল করা। যেমনটি, আইএসআইএস এবং আল-কায়েদার সাথে করা হয়েছিল।"
একইসাথে গিলাদ এরদান অভিযোগ করেন যে, নিরাপত্তা পরিষদের কাউন্সিল হামাসের 'নৃশংস সন্ত্রাসী হামলার' নিন্দা করেননি। এটা অকল্পনীয় যে, এই মৌলিক বিষয় নিয়েও সকলে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি।
হাসপাতালে হামলার বিষয়ে গিলাদ এরদান বলেন, "প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদের রকেটে হাসপাতালটি ধ্বংস হয়েছে। কোনো রকম সন্দেহ ছাড়া সেটি প্রমাণের জন্য ইসরায়েলের কাছে সেই ফুটেজও রয়েছে।"