অর্থ সহায়তার অনিশ্চয়তার মাঝে মার্কিন সিনেটের সাথে জেলেনস্কির ব্রিফিং হঠাৎ বাতিল
ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল নিয়ে অচলাবস্থার মধ্যে মার্কিন সিনেটের সাথে একটি হাই-প্রোফাইল ব্রিফিং বাতিল করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। গতকাল (মঙ্গলবার) ভার্চুয়াল ব্রিফিংটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছিল। তবে শেষ মুহুর্তে সেটি বাতিল করা হয়েছে। খবর বিবিসির।
তবে জেলেনস্কি কেন ব্রিফিংটি বাতিল করেছে সেটি খোলাসা করেননি সিনেট লিডার চাক শুমার। তিনি জানান, ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট 'শেষ মুহূর্তে' একটি বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবে সেই ব্যস্ততার কারণ ঠিক কোনটি, তা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি।
এদিকে গতকাল (মঙ্গলবার) জেলেনস্কির চিফ অফ স্টাফ আন্দ্রি ইয়ারমাক হুঁশিয়ারি দিয়ে জানান, মার্কিন সামরিক সহায়তা অনুমোদন না করলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যুদ্ধে হেরে যাওয়ার বড় ধরণের আশঙ্কা রয়েছে।
জেলেনেস্কির ব্রিফিং বাতিলের কয়েক ঘন্টা আগে ওয়াশিংটন ডিসিতে ইউএস ইন্সটিটিউটে দেওয়া এক বক্তৃতায় এই সামরিক কর্মকর্তা বলেন, "যুদ্ধে বর্তমান অবস্থান ধরে রাখা এবং মানুষের পক্ষে লড়াই করে বেঁচে থাকা সত্যিই কঠিন হবে।"
ব্রিফিংটি বাতিলের বিষয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত ইউক্রেন দূতাবাসের কাছে জানতে চাওয়া হলে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এদিকে মার্কিন কংগ্রেস ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থায়নে সহায়তার জন্য এখনো নতুন কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি।
এ সম্পর্কে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট নেতাদের কাছে গত সোমবার পাঠানো এক চিঠিতে হোয়াইট হাউজের বাজেট ডিরেক্টর শালন্দা ইয়াং বলেন, "আমাদের অর্থ ফুরিয়ে গেছে। একইসাথে আমাদের হাতের সময়ও প্রায় শেষ।"
অবশ্য শালন্দা ইয়াং সতর্ক করেন যে, চলতি বছর শেষের আগে ইউক্রেনে আরও সামরিক সহায়তা অনুমোদনে কংগ্রেসের ব্যর্থ হলে সেটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন লড়াইকে আত্মসমর্পণ করাবে। তবে এটি করার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলও অবশিষ্ট নেই।
এদিকে গত সোমবার হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভের রিপাবলিকান স্পিকার মাইক জনসন ইউক্রেনে আরও কয়েক বিলিয়ন ডলার তহবিল প্রদানের সর্বশেষ আবেদনের অনেকটা বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
নিজের সোশ্যাল মিডিয়ায় মাইক জনসন বলেন, "বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনে একটি সুস্পষ্ট কৌশল কিংবা সংঘাত সমাধানের পথ দেখাতে পারেনি। একইসাথে মার্কিন করদাতাদের প্রদত্ত সহায়তার পর্যাপ্ত জবাবদিহিতা নিশ্চিত এবং যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের সৃষ্ট উদ্বেগ যথেষ্টভাবে সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে।"
এমন একটি সময়ে তহবিল প্রদানের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যখন ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনের যুদ্ধও কার্যত অনেকটা অচলাবস্থায় পৌঁছেছে। একইসাথে দক্ষিণে ইউক্রেনের বহুল প্রত্যাশিত পাল্টা আক্রমণের গতি কমে গেছে বলে মনে হচ্ছে। এমতাবস্থায় বিস্তীর্ণ ডিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীরের পাদদেশ দখলে রাখার জন্য ইউক্রেনীয় সেনারা লড়াই করছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যুদ্ধ শুরুর পর থেলে ইউএস কংগ্রেস ইউক্রেনকে প্রায় ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়েছে। বাইডেন প্রশাসন গত কয়েক মাস ধরেই সতর্ক করছিল যে, তাদের হাতে থাকা বেশিরভাগ অর্থই ইতিমধ্যে বরাদ্দ হয়ে গিয়েছে।
ইউএস মিলিটারি একাডেমীর সাবেক অধ্যাপক ফ্রেডরিক কাগানের মতে, তহবিল বিলম্বের প্রভাব ইতিমধ্যে ইউক্রেনীয় যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে বর্তমান পাল্টা-আক্রমণে ধীর গতি এসেছে এবং হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধারের জন্য ভবিষ্যতের অভিযানগুলিও অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।
ফ্রেডরিক কাগান বলেন, "ইউক্রেনীয়দের এখানে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি তারা আত্মবিশ্বাসী না হয় যে, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও অর্থ সহায়তা পেতে যাচ্ছে, তাহলে তাদের যা আছে সেটিই সংরক্ষণ করতে হবে।"
ফ্রেডরিক কাগান মনে করেন, ইউক্রেনের সামরিক ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রয়োজন ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া কর্মীদের যানবাহন, ফাইটার প্লেন, ড্রোন এবং দূরপাল্লার অস্ত্র। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ যারা দ্রুত এবং আগামী বছরে কিয়েভকে তা প্রয়োজনীয় পরিমাণে সরবরাহ করতে পারবে।
এদিকে ইউএস সিনেটে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটরা বর্তমানে ১০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ ব্যায়ের প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা করছে। যার মধ্যে ইউক্রেনকে সহায়তা ছাড়াও রয়েছে ইসরায়েল ও তাইওয়ানের জন্য সামরিক সহায়তা এবং মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্তে নিরাপত্তার জন্য তহবিল বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো।
এদিকে রিপাবলিকান সিনেটর টম কটন গত রবিবার এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, "ইউক্রেনের জন্য অতিরিক্ত তহবিল প্রদানের বিনিময়ে আমাদের সীমান্ত নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এবং যথেষ্ট সংস্কার করতে হবে।"
অন্যদিকে চাক শুমার জানান, চলতি সপ্তাহে তিনি ভোটাভুটির জন্য একটি সামরিক সহায়তা বিল তুলবেন। তবে অভিবাসন ব্যবস্থার বিষয়ে প্রত্যাশিত চুক্তি ছাড়া এটি যথেষ্ট রিপাবলিকানদের সমর্থন পাবে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
মন্টানার রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ম্যাট রোসেনডেল বিবিসিকে গতকাল (মঙ্গলবার) বলেন, "মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চলতি বছর ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের ঘাটতি অতিক্রম করতে যাচ্ছে। তাহলে ইউক্রেনকে দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ কেন চীনের কাছ থেকে অর্থ ধার করবে? সেটা তো আমাদের স্বার্থে নয়!"
হোয়াইট হাউজ ধারণা করছে যে, যেহেতু নির্বাচনী বছর আসছে তাই কংগ্রেসের সদস্যরা কীভাবে তাদের কাজের মাধ্যমে নিজ এলাকার স্থানীয় অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করা যায় তার উপায় খুঁজছেন। তাই সরকারের তৃতীয় বছরে এসে ইউক্রেনের তহবিল ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক তৈরির বিষয়টি নিয়ে মোটেও বিস্মিত নন কাগান।
ফ্রেডরিক কাগান বলেন, "মার্কিন জনগণ তাদের প্রতিনিধিদের দ্বারা নিজেদের স্বার্থ বোঝার এবং বিপুল পরিমাণ অর্থের বণ্টন নিয়ে কার্যত বিতর্ক করার যোগ্য। প্রাথমিকভাবে ইউক্রেনীয়রা কী করতে পারে তার উপর নির্ভর করে চলমান যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হবে। তবে এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী করতে চায় সেটিও দ্বিতীয় ও বড় ফ্যাক্টর।"