লোহিত সাগরে কী ঘটছে? বিশ্ববাণিজ্যের জন্য কত বড় হুমকি?
বিশ্ববাণিজ্যের বড় অংশ হয় সমুদ্রপথে। পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খলে তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু, গাজায় ইসরায়েলের চলমান গণহত্যার ঘটনায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। গাজায় নির্বিচার বোমা হামলার প্রতিবাদে, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী লোহিত সাগর ও সুয়েজ খাল দিয়ে ইসরাইলগামী জাহাজে হামলা করছে। বা যেসব জাহাজের ইসরায়েলি মালিকানা রয়েছে বলে মনে করছে, সেগুলো লক্ষ্য করে মিসাইল ছুঁড়ছে।
এসব ঘটনায় এ সমুদ্রপথে চলাচলকারী জাহাজগুলোর ক্ষয়ক্ষতি সামান্য হলেও– এই হুমকির কারণে লোহিত সাগরের নৌপথে বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম।
লোহিত সাগর এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
পেট্রলপাম্পে জ্বালানি তেলের দাম থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের সরবরাহ– বলতে গেলে বলতে গেলে প্রায় সব পণ্যেরই অবাধ জোগান নির্ভর করে– জিবুতি ও ইয়েমেনের মধ্যেকার মাত্র ২০ কিলোমিটার চওড়া বাব-এল- মান্দেব প্রণালির ওপর। আর এই জলপথে চলাচলকারী জাহাজ লক্ষ্য করেই হামলা চালাচ্ছে হুথিরা।
আয়তনের তুলনায় জাহাজ চলাচলের সংখ্যার দিক থেকে বাব-এল- মান্দেব প্রণালি বিশ্বের ব্যস্ততম এক জলপথ, এবং লোহিত সাগরের দক্ষিণদিকের প্রবেশদ্বার। লোহিত সাগরের সাথেই আবার সংযুক্ত সুয়েজ খাল।
সুয়েজ খাল বিশ্ববাণিজ্যের এক মূল ধমনী। আজ থেকে দেড়শ বছর আগে সুয়েজ খাল যখন চালু করা হয়, তখন এটি এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপ, আমেরিকা যাত্রাপথে এক সংক্ষিপ্ত পথ তৈরির মাধ্যমে বিশ্ববাণিজ্যে এক বিপ্লব এনেছিল। বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্যের অন্তত ১২ শতাংশ হয় লোহিত সাগরের জলপথ হয়ে, ৩০ শতাংশ কনটেইনারবাহী জাহাজও রয়েছে তারমধ্যে।
প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি ডলারের পণ্য ও কাঁচামাল লোহিত সাগর পাড়ি দেয়। যাত্রাপথে যেকোন প্রকার দেরির চড়া মূল্য দিতে হয় বিশ্বের সরবরাহ চক্রকে। এতে ব্যাহত হয় সময়মতো পণ্য সরবরাহ।
হুথিরা যা করছে…
বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রণী এই বাণিজ্যিক রুটে জাহাজ চলাচল কতোটা সহজে ইরানের সমর্থিত হুথি গোষ্ঠী ব্যাহত করতে পারে, তা দেখেশুনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।
ইয়েমেনের রাজধানী সানায় রয়েছে হুথিদের ঘাঁটি, যেখান থেকে বাব-এল- মান্দেব প্রণালি হয়ে সুয়েজ খালে যেতে লোহিত সাগরে প্রবেশকারী জাহাজে তাঁরা এসব হামলা চালাচ্ছে।
হুথিরা প্রথমে বলেছিল, শুধু ইসরায়েলগামী জাহাজেই তারা হামলা করা হবে। কিন্তু, পরে ভুলবশত হোক বা জেনেশুনে, তারা অন্যান্য দেশের পতাকাবাহী জাহাজেও আক্রমণ করেছে, যাদের সাথে ইসরায়েলের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করা হচ্ছে।
জবাবে হুথিদের ড্রোন ও মিসাইল ভূপাতিত করেছে ফরাসী, ব্রিটিশ ও মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলো। এছাড়া, সোমবার যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ লোহিত সাগরে টহল দেওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশকে নিয়ে একটি জোট গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এই জোটের যুদ্ধজাহাজগুলো বাণিজ্যিক জাহাজে যেকোনো হামলা ঠেকাতে একযোগে কাজ করবে।
এই ঘোষণার পর হুথিদের একজন নেতা মোহাম্মদ আল-বুখাইতি আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে গঠন করা যেকোনো জোটকে লোহিত সাগরে মোকাবিলা করা হবে।
বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল ব্যাহত হওয়ার প্রভাব কী?
হুথিদের হামলার ঘটনায়, সুয়েজ খাল ও লোহিত সাগরে যাতায়াত করা জাহাজের বিমা ব্যয় বাড়ছে।
উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা দিয়ে চলাচল করতে হলে জাহাজগুলোকে বিমা কোম্পানিকে জানাতে হয়, এবং এজন্য বিমার চড়া প্রিমিয়ামও দিতে হয়। ডিসেম্বরের শুরুতে ঝুঁকির প্রিমিয়াম ছিল জাহাজের মোট দামের মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, যা সাম্প্রতিক দিলগুলোয় বেড়ে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ থেকে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে গেছে।
সোমবার জাহাজের বিমাদাতা কোম্পানিগুলোর একটি জোট লোহিত সাগরে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত এলাকার আওতা বাড়িয়ে নির্ধারণ করেছে। যার ফলে আরও বেশি জাহাজকে ঝুঁকি প্রিমিয়াম দিতে হবে।
এতে করে, লোহিত সাগর হয়ে পণ্য বহনের খরচ এক সপ্তাহের মধ্যে লাখ লাখ ডলার বেড়ে গেছে।
এরপরও বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালনাকারী বৃহৎ সংস্থাগুলো ঝুঁকির মাত্রা খুবই বেশি বলে মনে করছে। গত সপ্তাহে মায়েরস্ক, হেপাগ লয়েড ও এমএসসি'র মতো সুবৃহৎ শিপিং কোম্পানিগুলো লোহিত সাগরের জলপথ ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তক সংস্থা– আটলান্টিক কাউন্সিলের তথ্যমতে, বিশ্বের বড় ১০টি শিপিং কোম্পানির মধ্যে ৭টি-ই লোহিত সাগরে তাঁদের জাহাজ চলাচল বন্ধ রেখেছে। এই অবস্থায়, তাঁদের কিছু জাহাজ দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ঘুরে যাচ্ছে। এতে যাত্রাকাল অন্তত দুই সপ্তাহ বেড়ে গেছে।
গত সোমবার বহুজাতিক জ্বালানি কোম্পানি বিপি-ও একই সিদ্ধান্ত নেয়, এবং লোহিত সাগর দিয়ে তাদের সকল তেল ও গ্যাসের চালান আনা বন্ধ রাখে।
ভোক্তাদের ওপর কী প্রভাব পড়ছে?
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস আমদানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বিকল্প সরবরাহকারী হিসেবে ঝোঁকে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি সমৃদ্ধ দেশগুলোর দিকে। এই প্রেক্ষাপটে, বিপির ওই ঘোষণার পর প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বেড়ে গেছে। জ্বালানির দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শিপিং কোম্পানিগুলোর সামনে এখন উপায় তেমন নেই। হয় তাদের উচ্চ বিমা প্রিমিয়াম দিয়ে লোহিত সাগর দিয়ে জাহাজ চালাতে হবে, নাহলে এই পথ এড়িয়ে ব্যবহার করতে হবে ভিন্ন জলপথ, যাতে খরচ আরও বাড়বে। উভয়ক্ষেত্রেই জাহাজে পণ্যবহনের ভাড়া বাড়বে। বিকল্প পথ ব্যবহার করলে গন্তব্যে পণ্য সরবরাহেও দেরি হবে। এর প্রভাব পড়বে পুরো সরবরাহ শৃঙ্খলে।
আটলান্টিক কাউন্সিল বলেছে, এখনও করোনা মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির অভিঘাত পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিশ্ব অর্থনীতি, তারমধ্যে এই চলাচল ব্যাহত হওয়ার ঘটনা চরম প্রতিকূল অবস্থা তৈরি করবে।
এক বছরের বেশি সময় ধরে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি কার্যকর করে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধানরা যখন মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াইয়ে জয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখন তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি– এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হওয়ার ঘটনা এই সফলতা পুরোপুরি আসার আগেই তা ধূলিসাৎ করে দিতে পারে।