যেসব সংশোধনীর পর জাতিসংঘের প্রস্তাবে সম্মতি জানাল যুক্তরাষ্ট্র
সপ্তাহব্যাপী কূটনীতিক প্রচেষ্টার পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের গাজায় মানবিক সহায়তা বিষয়ক একটি প্রস্তাবে সম্মত হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে দেশটিকে রাজি করানোর জন্য প্রস্তাবের বেশ কিছু বিষয়ে সংশোধন আনা হয়েছে। কাতারভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আলজাজিরা এ প্রস্তাবের যে বিষয়গুলোতে সংশোধন আনা হয়েছে, সেগুলো তুলে ধরেছে।
যুক্তরাষ্ট্র কেন মূল প্রস্তাবে আগ্রহ দেখায়নি?
গত ১৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের কাছে মূল প্রস্তাবটি উত্থাপন করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। প্রস্তাবে সংঘাতরত পক্ষের মধ্যে শত্রুতা বন্ধ ও মানবিক সহায়তা বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়।
এতে আরো বলা হয়, বাইরে থেকে গাজায় যে মানবিক সহায়তা প্রবেশ করছে তা জাতিসংঘকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সেই সাথে এতে সব জিম্মিদের 'তাৎক্ষণিক ও নিঃশর্ত মুক্তি'র আহ্বানও জানানো হয়।
প্রাথমিকভাবে প্রস্তাবটিতে 'বিরতি' শব্দটি নিয়ে আপত্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। কারণ, দেশটি এই মুহূর্তে যুদ্ধবিরতির পক্ষে ছিল না। এ আপত্তির কারণে প্রস্তাবটি থেকে 'বিরতি' শব্দটি বাদ দিয়ে এর পরিবর্তে 'শত্রুতা বন্ধের' বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
এরপরও প্রস্তাবে সম্মত হচ্ছিল না যুক্তরাষ্ট্র। এ কারণে নিরাপত্তা পরিষদের ভোটাভুটিও পিছিয়ে যাচ্ছিল। এর পর জাতিসংঘের গাজায় মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ নিয়ে তৈরি হয় আরেক জটিলতা।
পাসব্লু নামে স্বাধীন একটি সংস্থা এক্স (সাবেক টুইটার) বার্তায় জানায়, ইসরায়েল খসড়া প্রস্তাবটি দেখার আগ পর্যন্ত মার্কিন কূটনীতিকরা জাতিসংঘের সহায়তা পর্যবেক্ষণের বিষয়ে সম্মত ছিলেন।
আলজাজিরার রামি আয়ারি এক্স বার্তায় জানান, গতকাল বৃহস্পতিবারের (২১ ডিসেম্বর) আগে আরব ও অর্গানাইজেশন অব ইসলামি কো-অপারেশনের (ওআইসি) সদস্যরা জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে প্রস্তাবনার ভাষার পরিবর্তন এনে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে উত্থাপন করে।
এই সময়ের মধ্যে এ প্রস্তাবের বিষয়ে জাতিসংঘে ভোটাভুটি তিন দিনে সাতবার স্থগিত করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবারেও প্রস্তাবটির ওপর ভোট হয়নি। আজ শুক্রবার এ প্রস্তাবে ভোট হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবটিতে যে পরিবির্তন এনেছে
আবর রাষ্ট্রগুলোর সাথে আলোচনার পর যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবনাটির বেশ কিছু বিষয়ে সংশোধন আনে। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড বলেন, 'আমরা এ প্রস্তাবে ভোট করতে প্রস্তুত। আর এটি এমন প্রস্তাব যা অভাবীদের জন্য মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করবে।'
মূল প্রস্তাবটিতে 'শত্রুতা বন্ধের' বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল। সংশোধিত প্রস্তাবে এর পরিবর্তে গাজায় 'নিরাপদ ও অবাধ মানবিক সহায়তা এবং দীর্ঘমেয়াদে শত্রুতা বন্ধের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে শত্রুতা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়।'
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র খসড়া প্রস্তাবের সংশোধনীতে যুদ্ধবিরতি সম্পর্কিত বিষয়গুলো বাদ দেয়। এর পরিবর্তে দেশটি 'অবাধ ও নিরাপদ মানবিক সহায়তার জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের বিষয়টি উল্লেখ করে। সেই সাথে দীর্ঘমেয়াদে শত্রুতা বন্ধের জন্য শর্তাবলী নির্ধারণেরও আহ্বান জানায়।'
মূল প্রস্তাবে জাতিসংঘের সহায়তা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের বিষয়ে বলা হয়েছিল, যুদ্ধের পক্ষপাতী নয় এমন দেশগুলো থেকে 'স্থল, সমুদ্র এবং আকাশপথের মাধ্যমে গাজায় যে মানবিক সহায়তা সরবরাহ করা হবে সেগুলো জাতিসংঘ পর্যবেক্ষণ করবে।
সংশোধিত প্রস্তাবে এক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনা হয়। সংশোধিত প্রস্তাবে বলা হয়, সংঘাতের পক্ষ নয় এমন দেশগুলো থেকে গাজায় সহায়তা ত্বরান্বিত করতে একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে একজন জ্যেষ্ঠ মানবিক ও পুনর্গঠন সমন্বয়কারী নিয়োগ করার আহ্বান জানানো হয়।
মূল প্রস্তাবে জল, স্থল ও আকাশপথে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য গাজায় প্রবেশের সবগুলো রাস্তা খুলে দিতে হামাস ও ইসরায়েলের প্রতি দাবি জানানো হয়। এখানেও আপত্তি ওঠে। সবগুলো রাস্তার পরিবর্তে কেবল দুয়েকটি সড়কের কথা বলা হয়।
কূটনীতিকরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে গাজায় সহায়তা কার্যক্রম পৌঁছানোর বিষয়ে ইসরায়েলকে এক প্রকার নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে গাজায় সহায়তা পৌঁছানোর জন্য মিসরের সাথে রাফাহ ক্রসিং ও ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত কারেম আবু সালেম (কারেম শালোম) ক্রসিং খোলা রয়েছে।
প্রস্তাবটি কি পাশ হবে?
প্রস্তাবটি পাসের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে অন্তত ৯টি রাষ্ট্রের সমর্থন প্রয়োজন হবে। সেই সাথে প্রস্তাবটিতে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, চীন, যুক্তরাজ্য কিংবা রাশিয়া- এ দেশগুলোর কোনো একটি দেশের পক্ষ থেকেও ভেটো প্রদান করা চলবে না।
যদিও থমাস-গ্রিনফিল্ড প্রস্তাবটি সমর্থন করতে পারেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তবে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দেবে নাকি ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকবে, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
প্রস্তাব নিয়ে রুদ্ধদ্বার আলোচনা চলাকালে রাশিয়া ও নিরাপত্তা পরিষদের আরো কিছু সদস্য রাষ্ট্র সংশোধনীর বিষয়ে অভিযোগ করে জানায়, এটি ওয়াশিংটনকে সন্তুষ্ট করার জন্য করা হয়েছে। তাই এ সংশোধনীর পর এখন নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে রাশিয়া ও চীন এ ভোটাভুটিতে আদৌ থাকবে কি না।
এর আগে গত ২৫ অক্টোবর 'মানবিক বিরতি' বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছিল রাশিয়া ও চীন।
প্রস্তাব পাশ হলে কি পরিবর্তন আসবে?
গাজার সব মানুষ ক্ষুধার কষ্টে রয়েছে। এজন্য উপত্যকাটির জরুরিভাবে খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন।
প্রস্তাবটি পাশ হলে আশা করা হচ্ছে গাজায় সহায়তা কার্যক্রম বাড়বে। তবে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
এর আগে গত মাসে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে সাত দিনের মানবিক বিরতি হয়েছিল। এ সময় উভয়পক্ষ তাদের নিজেদের বন্দিদের বিনিময়ের পাশাপাশি গাজায় সহায়তা কার্যক্রম বেড়েছিল।