রাশিয়ার নতুন আক্রমণ আরও কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে ইউক্রেনকে
বিভিন্ন বিশ্লেষণের ইঙ্গিত, রাশিয়া সম্ভবত ইউক্রেনে নতুন একটি আক্রমণ পরিচালনার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। স্থলযুদ্ধে সম্মুখ রণাঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থানে মস্কোর বাহিনী লড়াই জোরদার করেছে। গত কয়েক সপ্তাহে অল্প পরিমাণে ভূমিও দখল করেছে তারা।
এদিকে ইউক্রেনের স্থলবাহিনীর কমান্ডার কর্নেল-জেনারেল ওলেকজান্ডার সিরস্কি বলেছেন, তার বাহিনী বর্তমানে 'সক্রিয় প্রতিরক্ষা' ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে।
এর অর্থ কি রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতিরোধ এবং বিজয়ী হওয়ার প্রচেষ্টা নতুন করে রুশ আক্রমণ শুরু হলে গুরুতর সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে? এটা নির্ভর করবে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ের সক্ষমতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার মূল্যায়নের ওপর। তবে দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে কোনো পক্ষই ছাড় দিতে এখন পর্যন্ত রাজি নয়।
গত ১৬ জানুয়ারি স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের এক ফোরামে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে বলেছিলেন, ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে তার কোনো ইচ্ছা নেই। বরং এ যুদ্ধের ফলস্বরূপ ইউক্রেনের রাষ্ট্রের ওপর 'খুবই বড় একটি আঘাতের' পূর্বাভাস দেন তিনি।
অন্যদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এ সপ্তাহে ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইউকোনমিক ফোরামে বর্তমানে রাশিয়ার অধীনে থাকা ইউক্রেনের সব অংশ সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তার সংকল্পের কথা ব্যক্ত করেছেন।
কিন্তু দুই নেতার 'আজ্ঞা' প্রতিপালনের জন্য দুুই দেশের কি এ মুহূর্তে যথেষ্ট সেনাবল আছে? আর এ বিষয়টির সঙ্গে যুদ্ধ সরঞ্জাম ও জনবল দুটোই জড়িত। এ যুদ্ধ থেকেই এটা স্পষ্ট যে আকাশপথে যুদ্ধ ও আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাশিয়ার অস্ত্র ও গোলাবারুদ রয়েছে। অন্যদিকে এখনো পর্যাপ্ত আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি ইউক্রেন।
একইভাবে গোলাবারুদের তীব্র সংকট ক্রমাগত বাড়তে থাকায় ইউক্রেনের স্থল আক্রমণ মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের একাধিক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে অলাভজনক নীতি সংস্থা দ্য ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অভ ওয়ার গত ৮ জানুয়ারি বলেছে, 'আর্টিলারি গোলার সংকট পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে হিমশিম খাচ্ছে ইউক্রেনীয় বাহিনী'। একইভাবে 'পর্যাপ্ত ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সক্ষমতা না থাকায়' যুদ্ধে তাদের ছোট আকারের ড্রোনের ব্যবহারও ব্যহত হচ্ছে।
অন্যদিকে উভয়পক্ষের জনবল সংকটও প্রকট হয়ে উঠছে। গত বছরের শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে পুতিন নতুন করে সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দার উপপ্রধান ভাদিম স্কিবিটস্কির মতে, মস্কোর পক্ষে প্রতি মাসে ৩০ হাজারের মতো স্বেচ্ছাসেবী জোগাড় করা সম্ভব।
তবে যুদ্ধে বেশি জনবল খরচ করার অর্থনৈতিক প্রভাবের ধাক্কার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশকে।
ইরান ও উত্তর কোরিয়ার দেওয়া সামরিক সরবরাহের সুবাদে যুদ্ধে দারুণ সুবিধা পেয়েছে রাশিয়া। উত্তর কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী চো সন-হুই সম্প্রতি মস্কো ভ্রমণ করেছেন। তার মানে দেশটির সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক আরও গভীর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার চেয়ে ইউক্রেনের বিদেশ-নির্ভরতা বেশি। অথচ ইউক্রেনের বিদেশি সহায়তা ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।
ভবিষ্যতে মার্কিন সামরিক সহায়তা নিশ্চিত করার স্পষ্ট কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না কিয়েভ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকেও ভবিষ্যৎ সহায়তা নিয়ে বিশেষ কোনো প্রতিশ্রুতি পায়নি ইউক্রেন। দেশটি এখন জার্মানি ও যুক্তরাজ্যসহ অল্প কয়েকটি দেশের ওপর নির্ভরশীল অবস্থায় রয়েছে।
এছাড়া ইউক্রেনের নিজস্ব প্রতিরক্ষা খাতও যথেষ্ট পরিপক্ব নয়। এ কারণেই যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদের পর্যাপ্ত গোলাবারুদ সরবরাহ করতে পারেনি এটি।
পরিস্থিতি বিবেচনায় এ মুহূর্তে পুতিনের দেওয়া ইউক্রেনের ওপর 'খুবই বড় একটি আঘাতের' হুমকি বাস্তবায়নের হাতিয়ার রুশ পালটা আক্রমণ থামানোর একটি সম্ভাব্য উপায় হতে পারে রাশিয়াকে যেকোনোভাবে এমন আক্রমণ চালানো থেকে প্রতিরোধ করা।
২০২৩ সালের জুলাইয়ে জি৭-এর ইউক্রেনের পক্ষে যৌথ ঘোষণায় বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ ও ইউক্রেনের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এ মুহূর্তে এসে পরিপক্কতা লাভ করতে শুরু করেছে।
গত ১২ জানুয়ারি নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়ে যুক্তরাজ্য ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ফ্রান্স ও ইউক্রেনের মধ্যেও এ ধরনের চুক্তি চূড়ান্ত হবে বলে জানিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ।
যদি এ চুক্তি ভবিষ্যতের আরও একাধিক চুক্তির মডেলে পরিণত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ন্যাটোসদস্য ইউক্রেনের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তিতে পৌঁছায়, এবং এসব চুক্তির প্রতিশ্রুতিসমূহ যদি যথাযথভাবে মানা হয়, কেবল তাহলেই রাশিয়াকে নতুন করে কোনো ধরনের পালটা আক্রমণ চালাতে না দেওয়ার পক্ষে পশ্চিমাদের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার বোঝা যাবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।