‘আমরা মারা যাচ্ছি’: ফিলিস্তিনিরা ঘাস খাচ্ছেন, পান করছেন দূষিত পানি; গাজাজুড়ে দুর্ভিক্ষ
৩৮ বছর বয়সি হানাদি গামাল সাইদ এল জামারা বলেন, আজকাল তার ছেলেমেয়েরা পেটের খিদের জ্বালা থেকে একটু মুক্তি পায় কেবল ঘুমিয়ে পড়লে। সাত সন্তানের মা জামারা এখন দক্ষিণ গাজার রাফাহর কর্দমাক্ত রাস্তায় খাবার ভিক্ষে করে বেড়ান।
দিনে অন্তত একবারের জন্য সন্তানদের খাওয়ানোর চেষ্টা করেন তিনি। তার ওপর স্বামী অসুস্থ, ভুগছেন ক্যান্সার ও ডায়াবেটিসে।
ছেলেমেয়েদের পরিস্থিতি নিয়ে গত ৯ জানুয়ারি জামারা সিএনএনকে বলেন, 'তারা এখন সবাই দুর্বল, ডায়রিয়া লেগেই আছে। মুখগুলো হলুদ হয়ে গেছে। আমার স্বামী কিছু খেতে পারে না।'
গাজা ক্রমশ পুরোদস্তুর দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে। বাস্তুচ্যুত বেসামরিক নাগরিকেরা বলছেন, নিজের সন্তানদের মুখে একটু খাবার তুলে দিতে তারা নিজেরা অনেক বেলা না খেয়ে থাকছেন। ফিলিস্তিনিদের কপালে এখন যেটুকু পানি জুটছে, তাও বেশিরভাগ সময় পানের অযোগ্য।
ত্রাণের ট্রাক এলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এক টুকরো রুটি নিয়ে রাস্তায় ছোটছোট ছেলেমেয়েরা মারামারি করে। অনেকেই খাবারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় হেঁটে যান।
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের প্রধান অর্থনীতিবিদ আরিফ হোসেন জানান, এমনকি যুদ্ধের আগেও গাজার প্রতি তিনজনের দুজন খাবার সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। গত ১৭ বছর ধরে ইসরায়েল ও মিশরের সৃষ্ট আংশিক অবরোধের মধ্যে বাস করছেন ফিলিস্তিনিরা।
জাতিসংঘের জরুরি তহবিলের প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস বলেন, গাজার চার লাখ বাসিন্দাদের একটি 'বড় অংশ' — যারা না খেয়ে থাকার ঝুঁকিতে আছেন বলে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা জানিয়েছে — তারা 'আদতে দুর্ভিক্ষে ভুগছেন'।
এল জামারা বলেন, 'আমরা ধীরে ধীরে মরছি। আমার তো মনে হয় তার চেয়ে বরং বোমার আঘাতে মরাই ভালো। তখন অন্তন শহীদ হিসেবে মরব। কিন্তু এখনো তো খিদে আর তৃষ্ণায় প্রাণ যাচ্ছে।'
গত ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েল আচমকা হামলায় এক হাজার ২০০ জন নিহতের পর ইসরায়েলের গাজায় পালটা আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২৬ হাজার ৬৩৭ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৬৫ হাজার ৩৮৭ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
উত্তর গাজায় ফিলিস্তিনিরা 'ঘাস খেয়ে' বেঁচে আছেন
রাফাহর একজন বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি ও ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট মোহাম্মদ হামুদার এখনো মনে আছে তার এক সহকর্মী ওদে আল-হ পরিবারের জন্য পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে কীভাবে নিহত হয়েছেন।
উত্তর গাজার শরণার্থী শিবির জাবালিয়ায় পানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন আল-হ। তখন ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে তিনিসহ আরও কয়েক ডজন মানুষ নিহত হন।
তিন সন্তানের জনক হামুদা বলেন, 'দুঃখের কথা হলো, এখনো অনেক আত্মীয়পরিজন ও বন্ধুবান্ধব উত্তর গাজায় পড়ে পড়ে ভুগছেন। তারা ঘাস খেয়ে আর দূষিত পানি পান করে বেঁচে আছেন।'
ইসরায়েল হাজায় অবরোধ দিয়ে রেখেছে। উপত্যকাটিতে ত্রাণ সরবারহ করার বিষয়েও এটির বিধিনিষেধ রয়েছে। ফলে গাজাবাসীর জন্য খাবারদাবারের পর্যাপ্ত কোনো মজুত নেই। তবে খাবারের সংকট উপত্যকাটির উত্তর অংশে বেশি। যুদ্ধের শুরুতে এখানেই ইসরায়েল এর আক্রমণ তীব্র করেছিল।
হামুদা জানান, জাবালিয়ায় থাকা তার বন্ধুরা জানিয়েছেন, তারা খাবারে অভাবে বাধ্য হয়ে একটি গাধা জবাই করে এর মাংস খেয়েছিলেন।
এদিকে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো একাধিক পশ্চিমা দেশ গাজায় কাজ করা জাতিসংঘের এজেন্সি ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস ইন দ্য নিয়ার ইস্টকে (ইউএনআরএডব্লিউ) তহবিল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ ইসরায়েল অভিযোগ করেছে সংস্থাটির একাধিক কর্মী ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ওপর হামলায় অংশ নিয়েছিলেন। এ অভিযোগের পর জাতিসংঘ সংস্থাটির কয়েকজন কর্মীক বরখাস্তও করে।
'নেই সুপেয় পানি'
আরেক বাস্তুচ্যুত গাজাবাসী জিহান এল বাজ বলেন, 'আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত খাবার নেই। এই যে সন্ধ্যা হয়ে এল, কিন্তু আমাদের পেটে এখনো দানাপানিও পড়েনি।' ক্লান্তির কারণে অজ্ঞান হয়ে পড়ে সম্প্রতি হাত ভেঙে ফেলেছেন তার স্বামী।
'পান করার মতো কিছু নেই, নেই পরিষ্কার পানি, বাথরুম। ছেলেমেয়েরা একটুকরা বিস্কিটের জন্য কান্নাকাটি করে, কিন্তু কিছু্ই দিতে পারি না,' নিজের দুর্দশার কথা এভাবেই জানান তিনি।
গাজা সিটির একটি এতিমখানার পরিচালক হাজেম সাঈদ আল-নাইজি বলেন, 'মানুষ বাধ্য হয়ে গাছ কাটছে জ্বালানি ও রান্নার জন্য। সবজায়গায় কেবল ধোঁয়া আর ধোঁয়া। চারপাশে মাছি উড়ে বেড়াচ্ছে, রোগজীবাণু ছড়াচ্ছে।'
মোহাম্মদ হামুদার ছয়, চার ও দুই বছর বয়সি তিন সন্তানকে তিনি একসময় ফল, শাকসবজি, বিস্কুট, জুস, মাংস ও সিফুড খাওয়াতেন। কিন্তু এ বছর তার পরিবার খুব কম দিনই একবেলা পেটপুরে খেতে পেয়েছে।
'খাবার ও পানির জন্য বাচ্চারা একে অপরের সঙ্গে হিংস্র আচরণও করছে। এসব কথা বলতে গেলে চোখের জল বাঁধ মানে না। এই ছোট ছোট বাচ্চাদের অভুক্ত মুখগুলো দেখা কী যে কষ্টের।'
ইউনিসেফ গত মাসে জানিয়েছেন, গাজার পাঁচ বছরের কম বয়সি সাড়ে তিন লাখ শিশুর সবাই তীব্র পুষ্টিহীনতার মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে।
২০ বছর বয়সি শাদি ব্লেহা ছয় জনের পরিবারকে খাওয়াতে নিয়মিত সংগ্রহ করছেন। সপ্তাহে দুই দিন তারা ইউএনআরএডব্লিউ থেকে দুটো পানির বোতল, তিনটে বিস্কিট এবং 'মাঝেমধ্যে' খাবারের দুটো ক্যান পান বলে জানান তিনি।
দক্ষিণ গাজার ফিলিস্তিনিরাও বলছেন, ত্রাণ বিতরণ সঠিকভাবে না হওয়ায় কেউ কেউ একেবারে কোনো সহায়তাই পান না। আবার যারা পান, তাদের অনেকে লাভের জন্য ওই খাবার বিক্রি করে দেন।
অনেকক্ষেত্রে ফেরিওয়ালারা ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকে ত্রাণের খাবার সংগ্রহ করে অনেক বেশি দামে বাজারে বিক্রি করেন। যেসব লোকের গাড়ি আছে, তারা অনেক দূরবর্তী স্থান থেকে পানি নিয়ে এসে শরণার্থী শিবিরগুলোতে চড়া দামে বিক্রি করেন।
তিন সপ্তাহ আগে খান ইউনিস এলাকায় ২৫ কেজির একটি আটার বস্তা ২০ ডলারে বিক্রি হতো। সেখানে ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনী (আইডিএফ) হামলা বাড়ানোর পর তার দাম বেড়ে ৩৪ ডলার হয়ে যায়।
অনেকে অভিযোগ করছেন, তারা ত্রাণের প্যাকেট পেলেও সেগুলোর ভেতরে অনেক খাবার পাচ্ছেন না। ত্রাণের প্যাকেটে থাকা খেজুর, অলিভ অয়েল, রান্নার তেল ইত্যাদি দ্বিগুণ দামে কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।