তীব্র খাদ্য সংকটে গাজার মানুষ পশুখাদ্য আর ভাত খেয়ে বেঁচে আছেন
যেদিকে যতদূর তাকানো যায়– চোখে পড়বে শুধু অনন্ত ধ্বংসের স্তূপ। জীবিত মানুষের বসতি থেকে শুরু করে মৃতদের শেষ সমাধি– ইসরায়েলি বোমা আর বুলডোজার গুঁড়িয়ে দিয়েছে পুরো উপত্যকা। লাখো মানুষ উদ্বাস্তু, যুদ্ধের মধ্যে খাদ্য সরবরাহের উপায় নেই। গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। ফলে ছোট ছোট শিশুরাও টানা কয়েকদিন ধরে অনাহারে থাকছে, এরপর কিছু জুটলে খেতে পারছে। উত্তর গাজার বাসিন্দারা এমনটাই জানিয়েছেন ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসিকে। খবর বিবিসির
উগ্র জায়নবাদিরা গাজামুখী ত্রাণবহরের পথ আটকে দিচ্ছে কখনো। কখনোবা ইসরায়েলের সরকারই দিচ্ছে না ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি। এদিকে আগ্রাসনের শুরুতেই উত্তর গাজাকে দক্ষিণাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং বোমায়-গোলায় ধুলার সাথে মিশিয়ে দেয় ইহুদিবাদী সেনারা। ফলে এখানে আটকে পড়া স্থানীয় বাসিন্দাদের আটার সাথে পশুখাদ্য মিশিয়ে খেয়ে জীবনধারণ করতে হচ্ছে। কিন্তু, এসব শস্যও এখন সোনার চেয়ে দামি। সরবরাহ নেই কোথাও।
ইসরায়েল পারমাণবিক বোমা হয়তো ফেলেনি, কিন্তু প্রচলিত অস্ত্র দিয়ে এমন ধবংসযজ্ঞ চালিয়েছে, যাকে শুধুমাত্র পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের সাথেই তুলনা করা যায়। যুদ্ধের ময়দানে ইহুদি সেনারা প্রচুর মার খেয়েছে, কিন্তু তাঁর প্রতিশোধ নিয়েছে পাইকারিহারে বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে।
এই বিস্তীর্ণ ধবংসস্তূপে মানুষ বসবাস করে, এমনটাই অবিশ্বাস্য। তবু তাই যেন নিয়তি উত্তর গাজায়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, খাবার ও কাপড় ধোয়ার জন্য মাটি খুঁড়ে পানি সরবরাহের পাইপ থেকে পানি নিচ্ছেন তাঁরা।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, উত্তর গাজার শিশুদের মধ্যে তীব্র অপুষ্টি ব্যাপকহারে বেড়েছে। বর্তমানে যা অত্যন্ত সংকাটাপন্ন একটি পর্যায় ১৫ শতাংশকে ছাড়িয়েছে।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয়কারী সংস্থা- ওচা জানিয়েছে, উত্তর গাজামুখী অর্ধেকের বেশি ত্রাণ সহায়তাকে গত মাসে সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি ইসরায়েল। কোথায় ও কীভাবে এই ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হবে– সেবিষয়েও দিনকে দিন জাতিসংঘের ওপর খবরদারি বাড়াচ্ছে ইসরায়েলি সেনারা। অসহায়ের মত জাতিসংঘকে এই মগের মুল্লুক মেনে নিতে হচ্ছে।
ওচা জানিয়েছে, উত্তর গাজায় বসবাস করছেন এমন তিন লাখ মানুষ ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না, প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি।
ইসরায়েল অবশ্য ডাহা মিথ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। গাজায় ত্রাণ প্রবেশের সমন্বয়ের সাথে জড়িত ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর একটি সংস্থার মুখমাত্র গত মাসে এক বিবৃতিতে বলেন, "গাজায় কেউ অনাহারে নেই। আমাদের সংস্থা– কোগাট এর পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, আমরা কোনোপ্রকার মানবিক ত্রাণ সহায়তাকে সীমিত করি না (বা বাধা দেই না)।"
উত্তর গাজার প্রধান দুটি জনপদের মধ্যে আছে– গাজা সিটি ও বেইত লাহিয়া। এখানকার তিনজন বাসিন্দার সাথে কথা বলেছে বিবিসি। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে, স্থানীয় সাংবাদিকদের তোলা ছবি ও ভিডিও ফুটেজও দেখেছে।
বেইত লাহিয়ার একজন মেডিকেল ত্রাণ কর্মী মোহাম্মদ শালাবি বলেন, "পশুখাদ্যের জন্য রাখা নিম্ন মানের শস্য ভেঙে মানুষ আটার সাথে মেশাচ্ছে, এখন অবশ্য তাও ফুরিয়ে যাচ্ছে। নিম্ন মানের এই শস্যও বাজারে খুঁজে পাচ্ছে না কেউ। উত্তর গাজা ও গাজা সিটিতে তো একদমই পাওয়া যাচ্ছে না।"
টিনজাত খাদ্যের মজুতও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
শালাবি বলেন, "(নভেম্বরে) আমরা ছয় বা সাতদিনের একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি পাই, সেই সুযোগে যেটুকু সম্ভব ত্রাণ গাজায় পৌঁছায়। কিন্তু, এতদিনে সেসব ত্রাণ শেষ হয়ে গেছে। তাই কপালে জুটলে মানুষ শুধু ভাত খাচ্ছে, শুধু ভাত, সাথে আর কিচ্ছুটি নেই।"
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) চলতি সপ্তাহে এই সপ্তাহে বিবিসিকে জানায়, গাজার উদ্দেশ্যে পাঠানো প্রতি পাঁচটি ত্রাণবহরের মধ্যে চারটিকে আটকে দেয় ইসরায়েলি সেনারা। এই অবস্থায়, গাজায় দুই সপ্তাহ পর পর একটি করে ত্রাণ কনভয় ঢুকতে পারছে।
'দুর্ভিক্ষের মারাত্মক ঝুঁকি'
ডব্লিউএফপি'র আঞ্চলিক প্রধান ম্যাট হলিংওর্থ বলেন, "নিয়মিতভাবে প্রচুর খাদ্য সহায়তা দেওয়া না গেলে গাজায় মারাত্মক দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি রয়েছে।
জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ সমন্বয় বিষয়ক সংস্থা- ওচা বলেছে, উত্তর গাজায় প্রবেশের অনুমতি না পাওয়া ত্রাণ মিশনের সংখ্যা তীব্রভাবে বাড়ছে। জানুয়ারিতে ৫৬ শতাংশ ডেলিভারিকে বাধা দেওয়া হয়, সে তুলনায় অক্টোবর ও ডিসেম্বরে তা ছিল ১৪ শতাংশ।
সংস্থাটি আরও জানায়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী প্রায়ই স্বাস্থ্য অবকাঠামোর জন্য জ্বালানি সরবরাহের পরিমাণ নিয়ে আপত্তি তোলে, এবং ব্যাখ্যা চায়, একইসঙ্গে খাদ্যসহ নানান সহায়তা কমানোর লক্ষ্যে বিধিনিষেধ দিয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চায় বিবিসি। তখন বিবিসিকে কোগাটের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু, যোগাযোগ করা হলে– কোগাট আবার সরাসরি সেনাবাহিনীকে প্রশ্ন করতে বলে।
এদিকে গাজার মানুষের জীবন বর্ণনাতীত। বেইত লাহিয়ার বাসিন্দা চার সন্তানের মা দুহা আল-খালিদি বিবিসিকে বলেন, তিন দিন ধরে তাঁর সন্তানরা অভুক্ত ছিল, এই অবস্থায় খাদ্যের সন্ধানে হয়রান হয়ে তিনি দুই সপ্তাহ আগে ছয় মাইল হেঁটে গাজা সিটিতে তাঁর বোনের বাড়িতে আসেন।
তিনি বলেন, "আমার কাছে কোনো টাকা ছিল না। থাকলেও শহরের প্রধান বাজারে কোনো খাবার ছিল না। আমার বোন ও তাঁর পরিবারও চরম দুর্বিষহ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। তারপরেও যখন আমরা যখন এলাম, তখন ঘরে অবশিষ্ট থাকা শেষ পাস্তাটুকু আমাদের সাথে ভাগ করে নেয়।"
তাঁর বোন ওয়াদ বলেন, "আমরা বুঝছি মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। আমাদের বাড়ির উপরের তলা ধবংস হয়ে গেছে। যেকোনো মুহূর্তে মাথার ওপর ছাদ ভেঙে পড়ার আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। দুই সপ্তাহ ধরে বাজার থেকে কিছু কিনতে পারিনি। যদিওবা কোনো খাদ্যপণ্য পাওয়া যায়, দেখা যায় তাঁর দাম স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি।"
দুর্ভিক্ষের ঝুঁকির বিষয়ে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর করা পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকার উত্তরের এলাকাগুলোর অন্তত একতৃতীয়াংশ বাসিন্দা "বিপর্যয়কর" পর্যায়ের খাদ্য সংকটে ভুগছে। কিন্তু, এসব এলাকায় প্রবেশে ইসরায়েলি বাহিনীর বাধার কারণে, সরেজমিনে গিয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতা যাচাই করতে পারছেন না জাতিসংঘ কর্মীরা।
খাদ্যের পাশাপাশি নিরাপদ পানি সরবরাহও নেই উত্তর গাজায় আটকে পড়া পরিবারগুলোর।
বেইত লাহিয়ার বাসিন্দা মাহমুদ সালাহ বলেন, প্রায় সবাইকে অশোধিত (পানের জন্য অনিরাপদ) পানি পান করতে হচ্ছে। যুদ্ধে পানি সরবরাহের কোনো পাইপ আর অক্ষত নেই। আমাদের মাটি খুঁড়ে পানি তুলতে হচ্ছে।"
জাবালিয়া এলাকার তোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছে চারপাশে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে আছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁরা মাটি খুঁড়ে পানি সরবরাহের বড় পাইপ থেকে পানি সংগ্রহ করছেন।
তাঁদের একজন ইউসুফ আল-আয়োতি বলেন, "এখানে প্রতি ১৫ দিন পর পর আমরা কিছুটা করে পানি পাই। সেই পানিও ময়লা। এই পানি খেয়ে খেয়ে আমাদের শিশুদের পেট খারাপ হয়ে গেছে, তাঁদের দাঁত ক্ষয়ে গেছে। কারণ, এই পানি যেমন লবণাক্ত, তেমনি বালুময়।"
টানা চার মাস যুদ্ধের পর গাজায় ক্ষুধা মেটানোর সাময়িক সমাধানগুলোও এখন শেষ বলতে গেলে। অবরুদ্ধ গাজায় খাদ্য মজুত তৈরিরও সুযোগ নেই। ইসরায়েল ক্ষুধাকে পরিণত করেছে যুদ্ধের অস্ত্রে।
ইসরায়েলের অভিযোগের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনিদের ত্রাণ সহায়তাকারী জাতিসংঘের সংস্থা আনরা'কে তহবিল দেওয়া বন্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে হামাসকে একটি যুদ্ধবিরতির চুক্তি সইয়ে চাপ দিচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব। কারণ তাঁরা যুদ্ধের ময়দানে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগ দেখেছে। যার সম্মুখীন হয়ে সামরিক কোনো লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি ইসরায়েল।
অনুবাদ: নূর মাজিদ