পর্যাপ্ত সেনার অভাব, নতুন করে সৈন্যভর্তি নিয়ে বিভক্ত ইউক্রেন
পরিস্থিতি রূঢ়, তবে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে। সম্প্রতি শীর্ষ কমান্ডারকে বরখাস্ত করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। নতুন কমান্ডার ও পুরোনো, দুজনেই একটি আসন্ন সমস্যা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন: গত দুই বছর ধরে যুদ্ধ করা ক্লান্ত সৈন্যদের ছুটি দিয়ে নতুন সেনাদের রণাঙ্গনে পাঠানো।
ইউক্রেন অস্ত্রশস্ত্রের জন্য পশ্চিমামিত্রদের ওপর নির্ভর করে। তবে যুদ্ধের সেনাবল নতুন করে জোগানোর কাজটা পুরোটাই তাদের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ। তরুণদের যুদ্ধে অংশ নেওয়া বাধ্যতামূলক করার নিয়মের [ড্রাফট] বয়সের সীমা কমানো নিয়ে সম্প্রতি দেশটির পার্লামেন্ট একটি বিল প্রস্তাব করার পর সেটির বিরুদ্ধে ছোটখাটো প্রতিবাদও গড়ে উঠেছে।
সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ বছর ইউক্রেন নতুন করে আসা মার্কিন অস্ত্রের চালান দিয়ে সর্বোচ্চ তাদের ফ্রন্টলাইন ধরে রাখতে পারবে। আর মার্কিন অস্ত্র না পেলে তাদের আরও পিছিয়ে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে। দেশটির এখন লক্ষ্য হলো নতুন সেনা সরবরাহের মাধ্যমে বাহিনীর মৃত সেনাদের স্থান পূর্ণ করা এবং একইসঙ্গে ড্রোন ও সাবোটাজ অপারেশনের মাধ্যমে রাশিয়াকে ব্যতিব্যস্ত রাখা।
সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে জেনারেল ওলেক্সান্ডার সিরস্কিকে নিয়োগ দেওয়ার সময় জেলনস্কি বলেছিলেন, তিনি 'নতুন একটি ব্যবস্থাপক দল' চান। সশস্ত্র বাহিনীর জন্য নতুন কৌশল খোঁজার কথাও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। এছাড়া রণাঙ্গনের পেছনের দিকে থাকা সৈন্যদের সম্মুখভাগে আনার পরিকল্পনাও রয়েছে তার।
সেনাসমাবেশ [মোবিলাইজেশন] ও নিয়োগের জন্য প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি নতুন একটি পদ্ধতির কথাও ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ বিষয়টি নিয়েই সাবেক কমান্ডার জেনারেল জালুঝনির সঙ্গে প্রকাশ্যে মতবিরোধ হয়েছে জেলেনস্কির। জালুঝনির বরখাস্ত হওয়ার একটি কারণ এটিও।
গত ডিসেম্বরে এক সংবাদ সম্মেলনে জেলেনস্কি বলেছিলেন, জেনারেল জালুঝনির অফিসারেরা সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ মানুষকে সেনাদলে নিয়োগ দিতে চাচ্ছেন। প্রেসিডেন্টের এ মন্তব্যের পর বিরোধীরা দাবি করেছিলেন, এত এত সৈন্যকে বাধ্যতামূলক ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো গুরুদায়িত্বটি জেলেনস্কি সামরিক বাহিনীর ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন।
নিয়োগের পর নতুন কমান্ডার জেনারেল সিরস্কি এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, তার প্রধান অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে 'সেনাদের জীবন ও স্বাস্থ্য'। তিনি আরও বলেন, সম্মুখযুদ্ধ করা ইউনিট এবং প্রশিক্ষণে থাকা ইউনিটগুলোর মধ্য একটি নতুন 'ভারসাম্য' তৈরি করার চেষ্টা করবে সেনাবাহিনী।
তবে সেনাসমাবেশ নিয়ে ইউক্রেনে এখন মানুষ দ্বিধাবিভক্ত। বিরোধী ইউরোপিয়ান সলিডারিটি পার্টি'র সদস্য ইরিনা ফ্রিজ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'সেনাসমাবেশের বিষয়ে রাজনীতি ঢুকে গেছে।'
ইউক্রেনের সেনা মোবিলাইজেশনের নতুন বিলটিতে বাধ্যতামূলক সেনাদলে ভর্তির বয়স ২৭ থেকে ২৫-এ নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া যারা এ ধরনের নিয়োগ এড়িয়ে যেতে চাইবেন, তাদের জন্য আরও কড়া শাস্তির বিধান রাখার কথাও বলা হয়েছে।
বর্তমানে ২৭–৬০ বছরের বেসামরিক নাগরিকদের বাধ্যতামূলকভাবে সেনাদলে ভর্তি করাচ্ছে ইউক্রেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ে যারা সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, তাদের বেশিরভাগেরই কপালে পদাতিক হয়ে পরিখায় পরিখায় ঘুরে যুদ্ধ করার নিয়তি লেখা থাকে।
এসব সেনারা আর্টিলারির গোলা, ড্রোন বিস্ফোরণ, স্নাইপারের গুলি অথবা রাশিয়ান সেনাদের সঙ্গে কাছাকাছি দূরত্বের যুদ্ধে নিহত হন। ইউক্রেনের হাজার-হাজার সেনা রুশ ল্যান্ড মাইনের আঘাতে পা হারিয়েছেন। গত শীতে সেনাদের ঘুমানো ও আশ্রয় নেওয়ার বাংকারগুলোতে ইঁদুরের উপদ্রবও দেখা দিয়েছিল।
সাধারণত সেনারা তিনদিনের মতো সময় পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন পরিখায় কাটান, সেগুলোতেই ঘুমান। এ সময়ে তাদের ওপর প্রতিপক্ষ নিয়মিতই গুলিবর্ষণ করে। এর পরের তিনদিন এসব সেনারা আশপাশের গ্রামের পরিত্যাক্ত বাড়িগুলোতে কিছুটা নিরাপদ পরিবেশে অবস্থান করেন।
পার্লামেন্ট সদস্য ফ্রিজ বলেন, ইউক্রেন সরকারকে সেনা ভর্তির বিষয়টি এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে যেন তা-তে দেশের সেনাবাহিনী ও অর্থনীতি দুটোর মধ্যেই ভারসাম্য বজায় থাকে। তার মতে, ইউক্রেনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে এ ভারসাম্য দরকার।
তিনি উল্লেখ করেন, সেনাবাহিনীতে বেসামরিক নাগরিকদের ভর্তি করানোর বয়স কমানো হলে তা-তে হয়তো জোয়ান সৈন্য বেশি পাওয়া যাবে। কিন্তু দেশটির জনমিতির কথা বিবেচনা করলে, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ জনসংখ্যার টিকে থাকার ক্ষেত্রে এটি দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
বেশিরভাগ সোভিয়েত দেশের মতো নব্বইয়ের দশকে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ইউক্রেনেও ২০ বছর বয়সি জনসংখ্যা কম। বরং দেশটিতে ২০ বছরের কোঠায় থাকা মানুষের চেয়ে ৪০ বছর বয়সি মানুষের সংখ্যা বেশি।
চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনের সেনাক্ষয়ের হার উল্লেখযোগ্য। তাই ২০-এর কোঠায় থাকা তরুণদের এভাবে যুদ্ধে পাঠালে ইউক্রেনের এ তরুণদের বাবা হওয়ার হারও কমে যাবে। এর ফলে আজ থেকে কয়েক দশক পরে এভাবে প্রয়োজনে সেনাদলে ভর্তি করানোর মতো মানুষ অথবা কর্মক্ষম নাগরিকের পর্যাপ্ত সংখ্যা থাকবে না। এতে হুমকির মুখে পড়বে দেশটির ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও অর্থনীতি।
এদিকে ইতোমধ্যে অনেক নাগরিককে সৈন্যদলে ভর্তি করানো এবং দেশ ছেড়ে অসংখ্য নারীর পালিয়ে যাওয়ার কারণে ইউক্রেনের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেশ বড় হারে কমে গেছে।
নতুন করে সেনা ভর্তি করানোর চেষ্টা করা হলে দেশটির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। গত সপ্তাহে একদল নাগরিক এ ধরনের নিয়োগের বিরুদ্ধে রাস্তায় বিক্ষোভ করেন। এ সময় তারা রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে পুলিশের সঙ্গেও বাকবিতণ্ডায় জড়ান।