ইউক্রেন কি তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে হারতে যাচ্ছে?
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের দুই বছর পার হয়েছে। এমতাবস্থায় কিয়েভের অন্যতম মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে আটকে আছে ইউক্রেনের জন্য সর্বশেষ সাহায্যের বিলের প্রস্তাব। ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ তাই বিশ্ববাসীর কাছে যেন ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
চলমান যুদ্ধে আপাতত ইউক্রেনের জয়ের যেন কোনো পথই খোলা নেই। এমনকি তীব্র মার্কিন সমর্থনও যেন এই বাস্তবতা খুব একটা পরিবর্তন আনতে পারবে না।
যুদ্ধের শুরুর দিকে ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনী অবশ্য কিছুটা হলেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিল। রাশিয়ার সম্মিলিত সশস্ত্র আক্রমণের কয়েকদিন আগে ইউক্রেনের জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফের চেয়ারম্যান মার্ক মিলি ধারণা করেছিলেন যে, রাজধানী কিয়েভের পতন হবে মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে। এক্ষেত্রে মার্কিন নেতারা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে উৎসাহিত করেছিলেন। রুশ সৈন্যরা তাকে হত্যা করতে পারে বলেও শঙ্কা ছিল।
রাশিয়ার তাৎক্ষণিক সাফল্যের এমন ধারণার সূত্রপাত ঘটে ২০১৪ সালে, রাশিয়ার ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করার সময় ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতা অর্জন এবং এই যুদ্ধে তাদের প্রস্তুতি প্রদর্শনে ব্যর্থ হওয়ায় মধ্য দিয়ে। একইসাথে তারা রাশিয়ান বাহিনীর প্রস্তুতি, বিমানের অবস্থা এবং সামরিক কৌশলকে খুব একটা মূল্যায়ন করতে পারেনি।
এক বছর আগে অবশ্য ইউক্রেনের অবস্থা বর্তমানের চেয়ে বেশ ভালো ছিল। এক্ষেত্রে কিছুটা অবাক করে দিয়ে তারা দেশটির পূর্বাঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এমনকি সফল পাল্টা আক্রমণের মধ্য দিয়ে ইউক্রেন সামরিক বাহিনী দক্ষিণাঞ্চল পুনরুদ্ধার করে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তখন আসন্ন বছরটিকে 'অপরাজেয়' বলে ঘোষণা করেন। এক্ষেত্রে দেশটির নিরাপত্তা নিশ্চিতে সহায়তা হিসেবে আর্টিলারি এবং অ্যান্টি-ট্যাঙ্কের অস্ত্রে বিশাল অর্থ সাহায্য করে যুক্তরাষ্ট্র। তখন একইভাবে এই সাহায্য চলতে থাকবে বলে ধারণা করেছিল ইউক্রেন।
তৎকালীন সময়ে রাশিয়ার বিশাল ও অত্যাধুনিক সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ইউক্রেনের অত্যাশ্চর্য সাফল্যের পর পশ্চিমারা এই যুদ্ধ নিয়ে বেশ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিতে থাকে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সময়ের সাথে সাথে সেই স্বপ্ন যেন ম্লান হতে থাকে।
বর্তমানে যুদ্ধে ইউক্রেনের পরিস্থিতি বেশ শোচনীয়। যুদ্ধের ধীর গতি একদিকে রাশিয়ার পক্ষে কাজ করছে। আর অন্যদিকে সৈন্য ও অস্ত্র চালনায় মস্কোর চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়ছে ইউক্রেন।
২০২৩ সালের দীর্ঘ-পরিকল্পিত ও উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ইউক্রেনীয় পাল্টা আক্রমণ অবশেষে ব্যর্থ হয়। ফলাফলস্বরূপ, রাশিয়ার দখলকৃত এলাকা পুনরুদ্ধার করতে পারেনি কিয়েভ। এতে করে ইউক্রেন ও পশ্চিমে জেলেনস্কির সমর্থন কমতে শুরু করেছে। এদিকে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মার্কিন সাহায্যের প্রস্তাবও কংগ্রেসে আটকে আছে।
অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, গত দুই বছরের ধরে রাশিয়ার সামরিক অবস্থা নিয়ে ভুল ধারণা পোষণ করে রেখেছিল ইউক্রেনীয় বাহিনী। একটা দীর্ঘ সময় ধরে তারা রাশিয়ার জেনারেলদের পরাস্ত করার কথা ভেবেছে।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, দুই বছর অতিবাহিত হওয়ার পরে এখন ইউক্রেন তাদের জয়ের কোনো পথই খুঁজে পাচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির সৈন্যরা রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর 'আভদিভকা' শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। গত নয় মাসে উভয় পক্ষের ক্ষতি বা লাভের হিসেবে- প্রায় সমস্ত সুবিধাই রাশিয়ার দিকে।
তবে 'আভদিভকা' দখল যুদ্ধের তেমন কোন পরিবর্তন না আনলেও এর গতি কিছুটা পরিবর্তন করেছে। ইউক্রেন এই মুহূর্তে মানসিকভাবে ক্লান্ত এবং তারা রাশিয়ার বাহিনীর চেয়ে সংখ্যার দিক থেকেও অনেক পিছিয়ে। এক্ষেত্রে তারা নতুন সৈন্য নিয়োগের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।
এমতাবস্থায় ইউক্রেন এখন তার সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং আরেকটি রাশিয়ান আক্রমণ ঠেকাতে রাশিয়ার সাথে একটি আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করার চেষ্টা চালাতে পারে। এমনকি এই অবস্থায় এটিও অনেকখানি অবাস্তব মনে হতে পারে।
পূর্ণ মাত্রায় রাশিয়ান আক্রমণের পর প্রথম বছরের ফেব্রুয়ারি, ২০২২ থেকে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সৈন্যরা প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতাগুলি কাটিয়ে উঠে। এক্ষেত্রে তারা মূলত আমেরিকান জ্যাভেলিনস, স্টিংগারস এবং একাধিক লঞ্চ রকেট সিস্টেম রপ্ত করে।
এই সময়কালে আমেরিকান সাহায্য হিসেবে ডজন ডজন ট্যাঙ্ক, একশরও বেশি ব্র্যাডলি ফাইটিং যান এবং একশরও বেশি স্ট্রাইকার ইউক্রেনকে লড়াইয়ে টিকিয়ে রেখেছিল। তবে এই সময়ের মধ্যে কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের সমর্থন হ্রাস পেতে শুরু করে।
বর্তমানে এটা স্পষ্ট যে, মার্কিন হাউস বর্তমান প্রস্তাবিত সাহায্য অনুমোদন করলেও ক্রমেই অস্ত্রের প্রবাহ বন্ধ হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে অস্ত্রের অব্যাহত সরবরাহ ছাড়া এই যুদ্ধে ইউক্রেন শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবেনা। এমনকি আগামী মাসে ইউক্রেনে যে এফ-১৬ ফাইটার জেটগুলো যুক্তরাষ্ট্র পাঠাবে, সেগুলোও মোড় ঘুরাতে পারবে না এই যুদ্ধের।
এফ-১৬ এর জন্য দীর্ঘ, মসৃণ রানওয়ে প্রয়োজন। যুদ্ধবিমানটি ইউক্রেনের বোমা বিধ্বস্ত রানওয়েতে অবতরণ করতে এবং টেক অফ করতে বেশ প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হবে।
অথচ রাশিয়া সব দিক থেকেই এগিয়ে আছে এই যুদ্ধে। যুদ্ধ যতই দীর্ঘায়িত হোক না কেন, পুতিন তার একক কৌশলগত পথে রাশিয়াকে সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারবেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনেক কিছুতেই বাধার সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে হোয়াইট হাউস কংগ্রেসের আসনগুলোতে পরিবর্তন আসবে। সেক্ষেত্রে পরিবর্তিত হবে নীতিও।
অন্যদিকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিও দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে গত দুই বছরে বৈশ্বিক অস্থিরতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইউক্রেন সমর্থন থেকে কিছুটা সরিয়ে রেখেছে।
গত অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধ বর্তমানে হোয়াইট হাউস এবং কংগ্রেসের ফোকাস হয়ে উঠেছে। ইরান, ইরাক ও সিরিয়ায়ও বেশ বেকায়দায় রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এদিকে চীন তাইওয়ান আক্রমণ করার হুমকি দিয়েছে। এই সমস্ত সংকট মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন মনোযোগ ও অর্থ। প্রথমদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ মার্কিন প্রশাসনের মূল উদ্বেগের জায়গা হলেও এখন সেই মনোযোগ ভাগ হয়ে গেছে বিভিন্ন খাতে। ফলে প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ সংকটে পড়েছে ইউক্রেন।
এসব অনিশ্চয়তার সাথে যুক্ত হচ্ছে চলতি বছরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প এই নির্বাচনে বাইডেনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ন্যাটোর সম্পর্কে রয়েছে টানাপড়েন। তার সাম্প্রতিক ন্যাটোকে নিয়ে দেয়া মন্তব্যে ন্যাটো চুক্তি রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় রাশিয়ার প্রতি সহনশীল আচরণ করার পরামর্শ দেন; যা তার ন্যাটোর প্রতি আস্থাহীনতার বিষয়টি আরও জোরালো করে।
সকল ধরনের বাস্তবতা ও পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক রাজনৈতিক অবস্থায় রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি কী হতে যাচ্ছে তা অনুমান করা সম্ভব নয়। তবে ইউক্রেনের জন্য সহযোগিতা বিবেচনা করার ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকরা কতদিন নগদ অর্থ এবং অস্ত্র সরবরাহ করবে সেটা অবশ্যই মূল্যায়ন করে দেখবে।
এদিকে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য পুতিনের তেমন কোন আগ্রহ আছে বলে মনে করছেন না বিশ্লেষকরা। পুতিন এখন তার প্রতিপক্ষ ইউক্রেনের সৈন্য-রসদ ফুরানোর এবং একইসাথে তাদের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ধৈর্য শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।
এসব কিছুর মধ্যে পুরো ভোগান্তিটাই ইউক্রেনের জনগণের। বর্তমানে তাদের বেশ করুণ বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতামত, কংগ্রেসে রাখা ৬০ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্রস্তাব ভবিষ্যতে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে না। দীর্ঘ এই লড়াই চালাতে প্রয়োজন অতিরিক্ত আরো সাহায্য। এক্ষেত্রে খুব শীঘ্রই সহায়তা বন্ধ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এর মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হবে ইউক্রেনের চূড়ান্ত ভাগ্য।