মৃতদেহ দাফনের আর জায়গা নেই: গাজার এক কবর খননকারী
গাজার বাসিন্দা সাদি বারাকা। তার কাজ মৃতদেহ দাফনের জন্য কবর খনন করা। প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ কাজ করেন তিনি।
বারাকা বলছিলেন, মৃতদেহ দাফনের জন্য কবরস্থানে আর জায়গা নেই।
গাজার মধ্যাঞ্চলের দেইর-আল-বালাহ শহরের কবরস্থানটির জায়গা সম্প্রতি কয়েক ধাপে বাড়ানো হয়েছে। তারপরও মৃতদেহ দাফনের জন্য সেখানে জায়গার সংকুলান হচ্ছে না। দাফনের জন্য তাই মাটির ওপরই কংক্রিট দিয়ে কবর তৈরি করা হচ্ছে।
বারাকা জানান, গত ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েল হামলা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ১৬ হাজার ৮৮০টি মরদেহ দাফন করেছেন তিনি। যা কি না হামলায় নিহত হওয়া মোট ফিলিস্তিনিদের অর্ধেকেরও বেশি।
ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় এ পর্যন্ত গাজায় ৩০ হাজার ৬৩১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ইসরায়েলের দাবি- নিহতদের মধ্যে অন্তত ১০ হাজার ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সদস্য।
বারাকা বলেন, 'আমি প্রতিদিন ভোর ৬টায় কবরস্থানে আসি। থাকি সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০টি কবর প্রস্তুত করি। আমি ১৬৭টি গণকবর তৈরি করেছি।'
৬৪ বছর বয়সী বারাকা গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর আগেও একই কাজ করতেন। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর নিহতদের দাফন করতে গিয়ে শিশুদের ক্ষত-বিক্ষত দেহ, একই কবরে গোটা পরিবারকে একসঙ্গে দাফনের মতো যে ভয়াবহতা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, তাতে তিনি স্বাভাবিক হতে পারছেন না।
বারাকা বলেন, 'আমি ঘুমানোর চেষ্টা করি, কিন্তু কসম করে বলছি, আমি সেটি পারি না, এমনকি আমি যদি দুই কিলো ঘুমের বড়ি খাই তারপরও।'
বারাকার ধারণা, তিনি যতজনকে দাফন করেছেন, তাদের মধ্যে ৮৫ শতাংশই নারী ও শিশু।
তিনি দাবি করে বলেন, 'এ কবরস্থানে দাফন করা হাজার হাজার মরদেহের মধ্যে মাত্র তিনটি মরদেহ ছিল হামাস সদস্যের।'
তিনি বলেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু 'হামাস সদস্যদের হত্যার বিষয়ে মিথ্যাচার করছেন।'
মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনএর একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, নতুন করে কবর খননের বদলে ইট, বালু আর সিমেন্ট দিয়ে মাটির ওপরই কবর তৈরি করা হচ্ছে।
আরেকটি ভিডিওতে এক মেয়ের মরদেহ নিয়ে কিছু লোককে কবরস্থানে যেতে দেখা যায়। তাদের পিছে পিছে মেয়েটির মা-ও কবরস্থানে যান। তিনি দাফনের আগে মেয়েকে শেষবারের মতো দেখতে বারাকার কাছে আকুতি জানান। দাফনের পর বেশ কয়েকজন মেয়েটির জন্য প্রার্থনা করেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, টানা পাঁচ মাস ধরে চলা ইসরায়েলের নির্বিচার বিমান হামলায় ফিলিস্তিনিরা নিহত হলেও এখন অনেকেই ক্ষুধায় মারা যাচ্ছেন।
সম্প্রতি ডব্লিউএইচওর একটি দল উত্তর গাজা পরিদর্শনের পর জানিয়েছে, গাজায় মানুষ মারাত্মক পর্যায়ের অপুষ্টিতে ভুগছেন, শিশুরা অনাহারে মারা যাচ্ছে, জ্বালানি, খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রির গুরুতর ঘাটতিসহ বহু হাসপাতাল ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে।
গত বৃহস্পতিবার গাজায় সিটিতে খাবারের জন্য ট্রাকের কাছে ভিড় করা ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর সরাসরি বন্দুক হামলার কয়েকদিন পর ডব্লিউএইচওর প্রতিনিধি দল এ তথ্য জানাল। ইসরায়েলের এই হামলায় অন্তত ১১৮ জন অনাহারি ও বাস্তুচ্যূত ফিলিস্তিনি নিহত ও ৭৬০ জন আহত হন।
এ ঘটনার পর প্রথমবারের মতো আকাশ থেকে গাজায় মানবিক সহায়তা সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে বারাকা যুক্তরাষ্ট্রের এই সহায়তাকে একটি রাজনৈতিক কৌশল বলেই মনে করেন।
তিনি বলেন, 'আমরা চাই না তারা (যুক্তরাষ্ট্র) আকাশ থেকে আমাদের জন্য সহায়তা সরবরাহ করুক। এটা কেবল তাদের লোকদেখানো।'
বারাকার আকাঙ্ক্ষা, মারা যাওয়ার আগে প্রজন্মের পর প্রজন্মের ওপর চলা ইসরায়েলি এই সহিংসতা বন্ধ হয়েছে এমনটা দেখে যেতে চান তিনি।
তিনি বলেন, 'আমি কেবল শান্তি চাই এবং এছাড়া আমি আর কোনো সমাধান দেখি না।'
তিনি আরও বলেন, দুইটি রাষ্ট্রের মানুষরা একে-অপরের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে বসবাস করবে- আমি এমনটাই সমর্থন করি। কিন্তু হামাস 'নির্মূলে' ইসরায়েলের এই প্রচেষ্টার কারণে কোনোদিনও সেই পরিস্থিতি তৈরি হবে ন।
পরে নেতানিয়াহুকে উদ্দেশ্য করে আরবি ভাষায় বারাকা বললেন, 'যদি আপনি হামাসকে নির্মূল করতে চান, তাহলে আমি বলব, নেতানিয়াহু, আপনি আপনার সময় নষ্ট করছেন।'
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক