ইউক্রেনে ড্রোনের ব্যবহার যেভাবে আধুনিক যুদ্ধব্যবস্থাকে বদলে দিচ্ছে
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে নজিরবিহীন সংখ্যায় ব্যবহার করা হচ্ছে ড্রোন। কয়েক হাজার ড্রোন এ যুদ্ধে শত্রুর গতিবিধির ওপর নজর রাখা, আর্টিলারি ও বোমার লক্ষ্যবস্তুকে গাইড করার দায়িত্ব পালন করছে। ড্রোন হামলার অর্ধশতের বেশি ভিডিও বিশ্লেষণ, ড্রোন নির্মাতা, সেনা ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে এক প্রতিবেদনে রয়টার্স জানিয়েছে কীভাবে ড্রোন প্রযুক্তি আধুনিক যুদ্ধব্যবস্থাকে বদলে দিচ্ছে।
রণাঙ্গনের ফ্রন্টলাইনে বিমানবিধ্বংসী অস্ত্রের অবস্থান বেশি হওয়ায় চিরায়ত যুদ্ধবিমান এ যুদ্ধে খুব বেশি ব্যবহার করা যায়নি। তার বদলে কার্যকর অস্ত্র হিসেবে রাশিয়া ও ইউক্রেন দুপক্ষের কাছেই ভরসার নাম হয়ে উঠেছে ছোট আকৃতির সস্তা এ ড্রোনগুলো।
মূলত বেসামরিক ব্যবহারের জন্য তৈরি করা এসব ড্রোনের গায়ে বিস্ফোরক জুড়ে দিয়ে প্রতিপক্ষের মিলিয়ন ডলারের ট্যাংকও অনায়াসে ধ্বংস করা যাচ্ছে। এতে খরচ পড়ছে কেবল ৫০০ ডলারের মতো।
ড্রোনের আকার, ব্যাটারি ও বিস্ফোরকের ওপর নির্ভর করে এগুলোর পাল্লা পাঁচ থেকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
এসব ড্রোনের কোনোটি আকাশ থেকে শত্রুর অবস্থানের ওপর নজরদারি চালায়। কোনোটি নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুর ওপর উড়ে গিয়ে বোমা বা গোলা ফেলে। আবার কোনোটি বিস্ফোরকসহ নিজেই তীব্রগতিতে ধেয়ে লক্ষ্যবস্তুর গায়ে বিধ্বস্ত হয়।
দুজন সৈন্যের একটি দল এ ড্রোনগুলো পরিচালনা করেন। তাদের একজন রিমোট কন্ট্রোল ও হেডসেট ব্যবহার করে ড্রোনটি ওড়ান। অন্যজন ট্যাবলেট কম্পিউটারের পর্দায় ম্যাপের ওপর নজর রেখে পাইলটকে নির্দেশনা দেন।
ফ্রন্টলাইনে পৌঁছানোর পর লক্ষ্যবস্তু খুঁজে নেন পাইলট। বেশিরভাগ সময় তা হয় ট্যাংক। সাধারণত প্রবেশমুখ, ইঞ্জিন বা গোলাভান্ডারের মতো ট্যাংকের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করে হামলা চালানো হয়।
তবে বেশিরভাগ সময় দুটো ড্রোন ব্যবহার করা হয় এ ধরনের মিশনে। একটি ড্রোন রেকির কাজ করে। এটি লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করার পর আক্রমণকারী ড্রোন সরাসরি গিয়ে ওই লক্ষ্যে হামলা চালায়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে ড্রোনের ব্যবহার মাঝেমধ্যে করা হলেও এখন এ ধরনের যুদ্ধপদ্ধতি একটি গাঠনিক রূপ পেয়েছে। ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীতে ড্রোন এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রায় প্রতিটি ব্রিগেডের একটি করে আক্রমণকারী ড্রোন কোম্পানি রয়েছে। এছাড়া বেশিরভাগ ইউনিটই ছোট ছোট নজরদারি ড্রোন ব্যবহার করে।
এ বছর প্রায় ১০ লাখ আক্রমণকারী ড্রোন বানানোর পরিকল্পনা করছে ইউক্রেন সরকার।
যেভাবে ড্রোন এত কার্যকর
ড্রোন মিশন পরিচালনার জন্য প্রথমে একটি নজরদারি ড্রোনকে আকাশে পাঠানো হয়। এটি ওপর থেকে নিচের দৃশ্য ভিডিও করে তা পাইলটের কাছে থাকা কন্ট্রোল স্ক্রিনে পাঠায়। বলা বাহুল্য, এসব ড্রোনের ক্যামেরা খুবই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন হয়।
এসব নজরদারি ড্রোনের আকার ও আকৃতি ভিন্ন হতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে চীনের তৈরি ডিজেআই মাভিক কোয়াডকপ্টার ড্রোন। এ ড্রোনগুলোর বেসামরিক ব্যবহাররের মধ্যে রয়েছে ল্যান্ডস্কেপ বা বিয়ের ভিডিও করা।
এ ড্রোনগুলোর দাম পড়ে দেড় থেকে তিন হাজার মার্কিন ডলার।
ড্রোনের মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করার পর তার অবস্থান বা কোঅর্ডিনেট একটি সুরক্ষিত মেসেজিং ব্যবস্থার মাধ্যমে কমান্ডারদের কাছে পাঠানো হয়। এরপর রাশিয়ান লক্ষ্যবস্তুর তথ্য-উপাত্ত নিয়ে তৈরি করা বিশেষ মানচিত্র ক্রপিভায় প্রবেশ করানো হয় ওসব কোঅর্ডিনেট।
তারপর ওই লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করার সবচেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতি কী হতে পারে তা ঠিক করেন কমান্ডারেরা।
আক্রমণকারী ড্রোনগুলোকে যেহেতু লক্ষ্যবস্তু পর্যন্ত গাইড করে নিয়ে যাওয়া যায়, তাই এগুলো বেশিরভাগ আর্টিলারির চেয়ে নিখুঁতভাবে হামলা করতে পারে। এসব ড্রোন চলন্ত সাঁজোয়া যানের পিছু নিয়েও হামলা চালাতে সক্ষম।
রাশিয়া-ইউক্রেনযুদ্ধে দু'পক্ষই ড্রোন ব্যবহার করছে। ফলে ট্যাংকের মতো ভারী অস্ত্রসমূহ বাধ্য হয়ে ফ্রন্ট লাইন থেকে কয়েক কিলোমিটার ভেতরে সরিয়ে নিতে হয়েছে দুই দেশকেই।
তবে এসব ড্রোনের ভয়ে তটস্থ থাকতে হচ্ছে পদাতিক সেনাদের। তারা বলছেন, যুদ্ধের এ পর্যায়ে আকাশ থেকে গোলা নিক্ষেপ করা ড্রোনের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে। ফলে তাদের জন্য স্থান পরিবর্তন কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
দীর্ঘপাল্লার আক্রমণ
কেবল মূল যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, ফ্রন্টলাইন থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরেও ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয় পক্ষই দীর্ঘপাল্লার ড্রোন ব্যবহার করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে।
এসব ড্রোন দিয়ে সাধারণত অস্ত্র কারখানা, সামরিক ঘাঁটি কিংবা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে।
২০২২ সালে রাশিয়া প্রথম দীর্ঘপাল্লার ড্রোন ব্যাপক পরিসরে ব্যবহার শুরু করে। ওই সময় ইরান থেকে কয়েকশ শাহেদ ড্রোন কিনেছিল মস্কো। এগুলো ইউক্রেনের অভ্যন্তরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে ব্যবহার করেছিল রুশ বাহিনী।
শাহেদ-১৩৬ মডেলের এ ড্রোনগুলো পূর্বনির্ধারিত গতিপথ অনুসরণ করে লক্ষ্যবস্তুর কাছে পৌঁছে। এ ড্রোনগুলোর দাম এক লাখ ডলার বা তার চেয়েও কম। রাশিয়া বর্তমানে নিজেই এ ধরনের ড্রোন তৈরির জন্য কারখানা স্থাপন করেছে।
একই সময়ে ইউক্রেনও দীর্ঘপাল্লার ড্রোন ব্যবহার করে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালিয়েছিল। প্রথমদিকে এসব ড্রোন রাশিয়ানরা ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ব্যবস্থা ব্যবহার করে ভূপাতিত করতে পারলেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউক্রেন রাশিয়ার অভ্যন্তরে একাধিক সফল ড্রোন হামলা পরিচালনা করেছে।
ড্রোনের বিরুদ্ধে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার
ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কার্যকর প্রতিরক্ষা হিসেবে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার (ইডব্লিউ) ব্যবহার করেছে রাশিয়া ও ইউক্রেন।
দুই দেশই নির্দিষ্ট এলাকার রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি জ্যাম করার জন্য ইডব্লিউ সিস্টেম ব্যবহার করে। এর ফলে ড্রোনের সিগন্যাল ব্যবস্থা কাজ করে না। ফলে পাইলট আর ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, অথবা ঘটনাস্থল থেকে ভিডিও সিগন্যাল পান না।
বেশিরভাগ ইডব্লিউ ব্যবস্থার ফ্রিকোয়েন্সির স্প্যান সীমিত। এ সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে ড্রোন পাইলটেরা কম ব্যবহৃত ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করার সুযোগ খোঁজেন। আবার পাইলটের কাছে ড্রোনের পাঠানো সিগন্যালও চিহ্নিত করতে পারে ইলেকট্রনিক নজরদারি ব্যবস্থাগুলো।
এ থেকে রক্ষা পেতে ড্রোন পাইলটেরা বিভিন্ন সিগন্যাল রিপিটার ব্যবহার করেন। এসব রিপিটার মাটিতে স্থাপন করা যায়, আবার আকাশে অন্য ড্রোনের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়। এগুলো মূল ড্রোন ও পাইলটের মধ্যবর্তী স্টেশন হিসেবে কাজ করে। এতে পাইলটের অবস্থান সুরক্ষিত থাকে।
ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের সঙ্গে পাল্লা দিতে বর্তমানে ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয় দেশই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা পরিচালিত ড্রোন তৈরিতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
এ ড্রোনগুলো পাইলটের সঙ্গে যোগাযোগ করা ছাড়াই লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করে সেগুলোতে হামলা চালাতে পারবে। ফলে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের সিগন্যাল জ্যামিং ব্যবস্থা এগুলোর বিরুদ্ধে কোনো কাজে আসবে না।