আকাশ প্রতিরক্ষা উধাও, ইউক্রেনের আকাশে আধিপত্য এখন রাশিয়ার
জরুরিভিত্তিতে আরও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও ক্ষেপণাস্ত্র দরকার, এ কথা ইউক্রেন নিজেই স্বীকার করেছে। কারণ পশ্চিমাদের দেওয়া বেশিরভাগ উচ্চ সক্ষমতার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হয় রুশ আক্রমণে ধবংস হয়েছে, নাহলে সেগুলোর ইন্টারসেপ্টর মিসাইল ফুরিয়ে গেছে।
ইউক্রেনকে দেওয়ার জন্য ন্যাটো এখন সদস্য দেশগুলোর কাছে খুঁজছে প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার যন্ত্রাংশ ও ক্ষেপণাস্ত্র। কিন্তু অতিরিক্ত কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ও যন্ত্রাংশ নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে প্যাট্রিয়েট ব্যবহারকারী জার্মানিসহ বেশিরভাগ ইউরোপীয় ন্যাটো সদস্য।
ন্যাটোর আরেক সদস্য নরওয়ে অবশ্য উন্নত নাসামস এয়ার ডিফেন্স দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু এগুলো আগে উৎপাদন করে তারপর দিতে হবে। এর বাইরে ইউরোপীয় মিত্রদের থেকে আইরিস-টি এয়ার ডিফেন্স মিসাইল পেয়েছে কিয়েভ, তবে সেই চালানও ফুরিয়ে গেছে। অন্তত ২০২৫ সালের আগে এ ক্ষেপণাস্ত্রের নতুন চালান পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই।
এর আগে ইউক্রেনকে ১৯৫০-এর দশকে প্রথম সার্ভিসে আসা হক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ক্ষতিগ্রস্ত হক সিস্টেমগুলো মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণে সম্প্রতি প্রায় ১৪ কোটি ডলারের এক বিক্রয় পরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
জরুরি এ বিক্রির আওতায় ঋণ-ভিত্তিতে হক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার যন্ত্রাংশ ও ক্ষেপণাস্ত্র পাবে ইউক্রেন। এ অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হক সিস্টেম মেরামত করাও হবে।
হক এয়ারডিফেন্স পুরোনো দিনের প্রযুক্তি হলেও এর আধুনিকায়িত সংস্করণ ইমপ্রুভড হক ফেইজ-থ্রি পেয়েছে ইউক্রেন। এটি পেতে মিত্র তাইওয়ান ও ইসরায়েলের দ্বারস্থ হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও নিজেদের হক মিসাইল ইউক্রেনকে না দিয়ে বরং ধবংস করার সিদ্ধান্ত নেয় তাইপে। অন্যদিকে ইসরায়েল জানায়, তাদের হক সিস্টেমগুলোর অবস্থা খুবই শোচনীয়, সামরিক সার্ভিসে না থাকায় এগুলোর ব্যাপক মেরামত দরকার হবে। যুক্তরাষ্ট্রের তাগাদায় স্পেন প্রথম দফায় কিছু ইমপ্রুভড হক ফেইজ-থ্রি সিস্টেম পাঠিয়েছে ইউক্রেনে, আরও ৬টি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এসব ঘটনার অন্তর্নিহিত অর্থ একটাই দাঁড়ায়; তা হলো স্পেন থেকে পাঠানো হক সিস্টেমগুলোর বেশিরভাগই ক্ষতিগ্রস্ত বা ধবংস হয়েছে। অথবা এগুলো আর কার্যক্ষম অবস্থায় নেই। নাহলে জরুরি হক মিসাইল ও যন্ত্রাংশ বিক্রয় অনুমোদন দিত না মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।
হক একটি সেমি-মোবাইল আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ১৯৫০-এর দশকে হক এয়ার ডিফেন্স যখন সার্ভিসে আসে তখন অ্যানালগ প্রযুক্তির কম্পিউটার ও ভ্যাকুয়াম টিউবের ব্যবহার করা হয়েছিল এতে। আধুনিকায়িত হক ডিফেন্সে রয়েছে ডিজিটাল কম্পিউটার এবং আংশিক ডিজিটাইজ করা রাডার।
লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত ও ধবংস করতে তিন ধরনের রাডারের প্রয়োজন হয় হক এয়ার ডিফেন্সের।
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের নৌসেনার সার্ভিসে থাকা সর্বশেষ হক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে। তার কয়েক বছর আগে ডিকমিশন করে তাইওয়ান। সে জায়গায় তারা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত স্কাই বো-থ্রি নামক একটি আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যুক্ত করে। আর ডেভিড স্লিং নামক এয়ার ডিফেন্স দিয়ে হক সিস্টেম প্রতিস্থাপন করছে ইসরায়েল।
এতেই বোঝা যায়, কতদিনের পুরোনো এ প্রযুক্তি ইউক্রেনকে গছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে এ সমরাস্ত্রের কার্যকারিতাও প্রশ্নবিদ্ধ।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, ইউক্রেনে পাঠানো হক সিস্টেমের মেরামত ও সংস্কার দরকার। যন্ত্রাংশ ও ইন্টারসেপ্টর মিসাইল হয় যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের পুরোনো মজুত থেকে দেওয়া হবে, নাহলে সেগুলো উৎপাদন করে তারপর পাঠানো হবে।
অথচ আধুনিকায়িত হক মিসাইল ডিফেন্সে ব্যবহৃত বেশিরভাগ সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ ১৯৮০'র দশকে তৈরি। মাঝারি সাইজের এ রকম কম্পিউটার চিপের উৎপাদন বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। উৎপাদনের যন্ত্রপাতিও হয়তো আর নেই। ফলে কোনো চিপ প্রস্তুতকারক ফাউন্ড্রি এ উৎপাদনের ঠিকাদারি নেবে বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় পুরোনো এয়ার ডিফেন্সের কম্পিউটার, গাইডেন্স যন্ত্রাংশ ও ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম হবে ত্রুটিপূর্ণ এবং অনির্ভরযোগ্য। পুরোনো প্রযুক্তিকে সচল করার প্রক্রিয়াও সহজ হবে না।
হক এয়ার ডিফেন্স যুক্তরাষ্ট্রনির্মিত হলেও এর বড় ব্যবহারকারী ছিল তার মিত্ররা। রেজা শাহের আমলে ইরান ছিল যুক্তরাস্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণ হক এয়ার ডিফেন্স কেনেন তিনি। রেজা শাহের পতনের পরে ইরান হক এয়ার ডিফেন্সের নিজস্ব সংস্করণও উৎপাদন ও ব্যবহার করেছে ইরাক-ইরান যুদ্ধে। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে কুয়েতও ইরাকি বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে হক এয়ার ডিফেন্স ব্যবহার করে। আরব দেশগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরায়েলও এটি ব্যবহার করেছে।
তবে আধুনিক সময়ের শত্রু বিমান বা ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে হক এয়ার ডিফেন্স কতটা কার্যকর – সে সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। পেন্টাগনের বক্তব্য হলো, ইউক্রেনের আকাশে রাশিয়ার ড্রোনের মতো নিচু দিয়ে ওড়া লক্ষ্যবস্তুকে ধবংস করতে হক এয়ার ডিফেন্স দরকার দেশটির।
একক লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে নাহয় ভালো কাজ করলো, কিন্তু একাধিক বা মিশ্র লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে কী করবে? শত্রুপক্ষ ড্রোনের ঝাঁক পাঠাতে পারে; অথবা একইসাথে ড্রোন, ক্রুজ মিসাইল, গ্লাইড বোমা ও উচ্চগতির মিসাইল দিয়ে হামলাও করছে রাশিয়া। এসব হুমকি মোকাবিলায় হক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাফল্য এককথায় প্রশ্নবিদ্ধ।
মানসম্মত অবস্থায় থাকলে দুটি মিসাইল দিয়ে হক এয়ার ডিফেন্সের শত্রু যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার সম্ভাবনা হচ্ছে ৮৫ শতাংশ। কিন্তু, ব্যালেস্টিক মিসাইল বা ড্রোনের বিরুদ্ধে এর কার্যকারিতার কোনো প্রমাণ নেই।
আধুনিকায়িত হক মিসাইলের পাল্লা ২৮ থেকে ৩১ কিলোমিটার, ফলে একে মাঝারি পাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বলা যায়। অন্যদিকে রাশিয়ার নতুন গ্লাইড বোমার পাল্লা হচ্ছে ২৫ মাইল বা ৪০ কিলোমিটার। ফলে রুশ বিমান হক সিস্টেমের আওতার বাইরে থেকেই এগুলোকে লক্ষ্য করে বোমা ছুড়তে পারবে। আর হাইপারসনিক মিসাইল দিয়ে হামলা করলে তো কথাই নেই।
রুশ হামলা থেকে রাজধানী কিয়েভসহ প্রধান প্রধান শহরগুলোকে রক্ষা করা নিয়েই এখন বেশি উদ্বিগ্ন ইউক্রেন। ইতোমধ্যে ওডেসা ও খারকিভের মতো বড় শহরে চালানো রুশ হামলা ইঙ্গিত দিচ্ছে, ওই শহরগুলোর কোনো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল না।
গত গ্রীষ্মের পাল্টা-আক্রমণ অভিযানের সময় প্যাট্রিয়ট এয়ার ডিফেন্স ব্যবহার করেছিল ইউক্রেন। তবে বিভিন্ন সূত্রের খবরে জানা গেছে, অন্তত একটি বা দুটি প্যাট্রিয়ট সিস্টেম ধবংস করেছে রাশিয়া। সম্প্রতি কিয়েভের কাছে আরেকটি প্যাট্রিয়েট সিস্টেম ধবংস হয়েছে।
একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো এবং যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর আকাশপথের আক্রমণ ঠেকাতে দরকার হয় এয়ার ডিফেন্স। ইউক্রেনের হাতে থাকা হক সিস্টেমগুলোকে সংস্কার করে দিলেও সেগুলো দেশটির জরুরি স্থাপনা ও সেনাদের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট হবে না।
মোদ্দা কথা, ইউক্রেনের কাছে এখন কার্যকর আকাশ প্রতিরক্ষা বলতে তেমন কিছু নেই। আগামী জুলাই মাসে ইউক্রেন পুরোনো কিছু এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পাবে, কিন্তু আকাশপথে রুশ হামলা ঠেকাতে গুটিকয় এফ-১৬ কতটা ভূমিকা রাখবে, তা নিয়ে খোলাখুলিভাবেই সন্দেহ পোষণ করা যায়। এক কথায়, কার্যকর আকাশ প্রতিরক্ষা অনুপস্থিতিতে ইউক্রেনের আকাশে রাজত্ব করছে রাশিয়া।
অনুবাদ: নূর মাজিদ
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।