ইরানে পাল্টা-হামলায় মধ্যপ্রাচ্যব্যাপী যুদ্ধের ঝুঁকি রয়েছে: হারেৎজ
দামাস্কাসে ইরানি কনস্যুলেটে হামলার দুই সপ্তাহ পরে অন্তত সাড়ে তিনশ ড্রোন ও মিসাইল দিয়ে ইসরায়েলে হামলা করেছে ইরান। দামাস্কাসে ইরানের শীর্ষ কয়েকজন সামরিক কমান্ডার নিহত হওয়ায়– পাল্টা-জবাব দিতে বাধ্য হয় তেহরান। রোববার ভোর পর্যন্ত চলে ড্রোন, ক্রুজ মিসাইল ও ব্যালেস্টিক মিসাইল দিয়ে এই হামলা, তবে আগে থেকেই ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্রদের প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি থাকায়- এতে উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের বামপন্থী সংবাদমাধ্যম হারেৎজ।
হারেৎজ বলেছে, ইসরায়েলি বিমান বাহিনী, অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কয়েকটি বন্ধুপ্রতীম দেশের প্রচেষ্টা এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
পশ্চিমা বিশ্ব ইরানি কনস্যুলেটে হামলার ঘটনায়, কূটনৈতিক স্থানকে নিরাপত্তা দেওয়া জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘনের ঘটনায় কোনো নিন্দা জানায়নি। উল্টো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন পাল্টা-হামলা না করতে ইরানকে পরোক্ষভাবে হুমকি দেন। তেহরান তাতে কিছুটা কালক্ষেপণ করলেও- হামলার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি। ইসরায়েলে হামলার পর জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মতো ইউরোপীয় দেশগুলো উল্টো ইরানের নিন্দা করেছে।
হারেৎজ তাদের বিশ্লেষণে বলেছে, ইরানের হুমকি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মিত্রদের ব্যাপক সমর্থন ও সহায়তা পাচ্ছে তেল আবিব। এই হামলার পর প্রতিক্রিয়া কী হবে তা ঠিক করতে বৈঠক চলছে ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার। তবে ইসরায়েলকে রক্ষায় সবরকম সহায়তা দিলেও, প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইরানে পাল্টা-হামলা না চালাতে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর ব্যাপক চাপ দিচ্ছেন। কারণ, জায়নবাদী রাষ্ট্র পাল্টা-হামলায় গেলে হিজবুল্লাহ-সহ ইরানের প্রক্সিরা তাতে জড়িয়ে পড়বে; এতে গোটা মধ্যপ্রাচ্যকেই গ্রাস করবে যুদ্ধের আগুন।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে এক ঝটিকা অভিযান চালায় হামাস। এই সংঘাতের হাত ধরেই শুরু হয় গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন। এসময় গাজায় হামাসের প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার আশা করেছিলেন, ইরান ও হিজবুল্লাহ'র মতোন 'প্রতিরোধ অক্ষ' হামাসের হয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে।
অভিযানের সফলতা নিশ্চিত করতে– হামলার দিনক্ষণ গোপন রেখেছিলেন সিনওয়ার। পরে তিনি আবিষ্কার করেন, আগে থেকে বোঝাপড়া না হওয়ায়– হামাসের মিত্ররা এই যুদ্ধে জড়াতে চায় না। ফলে হিজবুল্লাহ লেবানন সীমান্ত থেকে সীমিত আকারে গোলাবিনিময় অব্যাহত রাখে, অন্যদিকে নেপথ্যে থাকাই বেছে নেয় ইরান।
ইসরায়েল ঘোষণা করে, হামাসকে নির্মুল করবে। এজন্য তার সামরিক বাহিনীর আছে পৃথিবী সেরা সব সমরাস্ত্র। কিন্তু, ছয় মাসের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ করেও ঘোষিত লক্ষ্য তারা অর্জন করতে পারেনি। বরং, গাজার বিভিন্ন লড়াইয়ে অনেক ইসরায়েলি সেনা হতাহত হয়েছে। লোহিত সাগরে হুথিদের হামলাতেও ব্যাহত হয়েছে ইসরায়েলের বাণিজ্য।
হারেৎজ জানায় এই অবস্থায়, গত কয়েক মাস ধরে ইরানের ওপর ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হচ্ছিল ইসরায়েলিদের। আঞ্চলিক প্রক্সিদের মাধ্যমে ইহুদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হামলা করার পাশাপাশি – প্রক্সি বাহিনীগুলোকে অস্ত্রসজ্জিত করা অব্যাহত রেখেও – ইরানিদের অক্ষত থাকার বিষয়টি হয়ে ওঠে এই ক্ষোভের প্রধান কারণ।
গত ১ এপ্রিল দামাস্কাসে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা করার পেছনে আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল– সিরিয়া ও লেবাননে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর অভিজাত কুদস ফোর্সের ক্ষতিসাধন। এজন্যই কুদস ফোর্সের শীর্ষ জেনারেল রেজা জাহিদিকে লক্ষ্যবস্তু করে তেল আবিব। নেতানিয়াহু সরকার মনে করেছিল, এই হামলা সত্ত্বেও সবকিছু আগের মতই চলতে থাকবে। খুব বেশি হলে, তেহরান হয়তো সীমিত আকারে হামলা করবে প্রক্সিদের মাধ্যমে। যেমনটা সচরাচর করা হয়। কিন্তু, অচিরেই সেই ভুল ভাঙ্গে তাদের, দিনকয়েকের মধ্যেই এটা স্পষ্ট হতে থাকে যে, ইরান ব্যাপক শক্তির মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডের পাল্টা-জবাব দেবে।
পাল্টা-হামলা নিয়ে ইরান কোনো রাখঢাকও করেনি। ইরানের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা আলী খোমেনি জনসম্মুখে অন্তত তিনবার স্পষ্টভাবেই তা জানিয়েও দেন। খোমেনি জানান, কনস্যুলেটে হামলা ইরানের ভূখণ্ডে হামলার সমার্থক, এজন্য জায়নবাদী সত্ত্বাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।
এই অবস্থায় ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় কৌশলগত আঞ্চলিক মিত্রদের সাহায্য নিয়ে আসন্ন হামলা মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বেশকিছু ইউরোপীয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি-প্রধান দেশকে সাথে নিয়ে ইসরায়েলে আঘাত হানার আগেই ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকানোর এক সুরক্ষাবলয় গড়ে তোলেন বাইডেন।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকা রেডার ও অন্যান্য সেন্সরের অন্তর্জাল ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত ও ধবংস করতে বড় অবদান রেখেছে। তাছাড়া, একাধিক স্তরের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকায় ইসরায়েলও সফলভাবে এসব হুমকি মোকাবিলা করতে পেরেছে। ইরান সীমান্তে কাছাকাছি মোতায়েন থাকা রেডার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও মিত্ররা মিসাইলের গতিপথ সম্পর্কে তেল আবিবকে সঠিক ধারণা দিয়েছে।
ফলে সাড়ে তিনশ'র বেশি ড্রোন ও মিসাইল ছুড়লেও ইরান রোববার ভোররাতের আক্রমণে তেমন ক্ষয়ক্ষতি করতে পারেনি। বেশিরভাগ হুমকি ইসরায়েল ও তাঁর মিত্ররা আকাশপথেই ধবংস করে দিলেও, বিক্ষিপ্তভাবে কিছু ব্যালেস্টিক মিসাইল আঘাত হেনেছে দক্ষিণ ইসরায়েলের নেগেভ মরুভূমিতে। দক্ষিণের একটি বিমানঘাঁটিও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। বাকি ক্ষেপণাস্ত্র গিয়ে পড়ে ফাঁকা জায়গায়।
প্রায় ৯৯ শতাংশ ড্রোন ও মিসাইল সফলতার সাথে ধবংস করা হয়। এর বেশিরভাগই করা হয় ইসরায়েলের সীমান্তের বাইরে জর্ডান ও ইরাকে। এ দুটি দেশের আকাশপথেই বেশিরভাগ ইরানি ড্রোন ও মিসাইল ধবংস করে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমান ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
হারেৎজ বলছে, এই সাফল্যকে খাটো করে দেখা উচিত নয় তেল আবিবের। ইসরায়েলের সমস্ত যুদ্ধের ইতিহাসে– এটি নজিরবিহীন এক অর্জন। ইসরায়েলি ও মার্কিন বৈমানিকরা শত শত ক্রুজ মিসাইল ও ড্রোন ভূপাতিত করার রেকর্ড করেছে।
ফলে এই হামলার প্রত্যাশিত ফল যে তেহরান পায়নি তা স্পষ্ট, এবং তাতে গভীরভাবে হতাশই হওয়ার কথা দেশটির শাসকদের। ইরানের মূল উদ্দেশ্য ছিল, ইসরায়েলের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সক্ষমতা প্রমাণ করা। বিমান হামলার সাইরেনগুলো যেভাবে বেজেছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে, মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল দক্ষিণের নেভাতিম বিমানঘাঁটি। খুব সম্ভবত এই ঘাঁটি পুরোপুরি ধবংস করতে চেয়েছিল ইরানিরা, যেখানে ইসরায়েলের অত্যাধুনিক বেশ কয়েকটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানও ছিল। কিন্তু, ইরান এই লক্ষ্য অর্জনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে হারেৎজের বিশ্লেষণে।
@নেতানিয়াহু এবার কী করতে চান?
নিজ ভূখণ্ডে এত বড় পরিসরে হামলার পরে ইসরায়েলের সামনে একেবারে হাত গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই বলে মনে করছে নেতানিয়াহু প্রশাসন। খোদ নেতানিয়াহু অথবা তাঁর পক্ষে কেউ একজন এরমধ্যে চ্যানেল-১২ কে জানিয়েছে, নজিরবিহীন আকারে জবাব দিতে চায় ইসরায়েল, এজন্যই সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় লাগছে। যদিও এখনও সে ধরনের কিছু করা হয়নি।
তাছাড়া বাইডেনের সাথে ফোনালাপের পর নেতানিয়াহু ঘুমাতেও যান। হোয়াইট হাউসের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতেও ছিল ইরানি আগ্রাসন মোকাবিলায় ইসরায়েলের জন্য আশাবাদের বার্তা। পরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ফোনালাপে বাইডেন নেতানিয়াহুকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেছেন। আকাশ প্রতিরক্ষার বিস্ময়কর জয় নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতেই তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়েছেন।
গত কয়েক মাস ধরেই জানা যাচ্ছে, আঞ্চলিক গোলযোগের সুযোগে পারমাণবিক কর্মসুচিকে ব্যাপক গতিতে এগিয়ে নিচ্ছে ইরান। নেতানিয়াহু যা ধবংস করতে চান। তাই অনুমান করা যায়, বাইডেনের শঙ্কা যে পাল্টা-হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের সুযোগ নিয়ে আমেরিকানদের দিয়েই ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিনাশ করতে চান নেতানিয়াহু। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তা এড়াতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক বলে হারেৎজের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে।
ইরানের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চাওয়ার অনেক কারণ আছে ইসরায়েলের। তেল আবিব মনে করে, 'আঞ্চলিক সন্ত্রাস'কে তেহরান সমর্থন দিয়ে তার স্বার্থহানি করছে বহু বছর ধরে। কিন্তু এর সম্ভাব্য পরিণামও ভাবতে হবে। ইরানের ওপর বড় আক্রমণ এলে হিজবুল্লাহ আর সংযত থাকবে না।
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রধর হয়ে ওঠার আগে ঘরের কাছে হিজবুল্লাহ-ই ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি, যাদের রয়েছে বিপুল ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত। হিজবুল্লাহ সর্বাত্মক যুদ্ধে নামলে ইসরায়েলি জনপদগুলো রকেট বৃষ্টিতে পর্যদুস্ত হবে। এজন্যই এর আগে ইসরায়েল হিজবুল্লাহর সাথে সরাসরি যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে চেয়েছে। কারণ, এই ধরনের পরিস্থিতি ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় জনপদের ৬০ হাজার বাসিন্দাকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে। এমনকী অনেক এলাকাই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা দীর্ঘদিনের জন্য ব্যাহত হবে।
ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার অনেকেই হয়তো মনে করছেন, সব হিসাবের ছক পাল্টানোর এটাই সুবর্ণ সুযোগ। কারণ, আঞ্চলিক এই যুদ্ধে পশ্চিমাদের পাশাপাশি সুন্নি আরব দেশগুলো কোনো না কোনোভাবে তাদের পক্ষেই থাকবে। যুদ্ধে পর্যদুস্ত হবে ইরান, এবং ধবংস হবে তার কৌশলগত আঞ্চলিক সম্পদ হিজবুল্লাহ'র ব্যাপক অস্ত্রভাণ্ডার। লেবাননের অবকাঠামোর ক্ষতিও করা যাবে সীমাহীন।
তবে যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা এবং সামরিক বাহিনীর সাথে যুক্ত কিছু সিনিয়র কর্মকর্তা আরো বেশি সতর্ক। মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধে ইসরায়েলেরও বহু ক্ষতি হবে। তাঁরা মনে করেন, লেবাননের সাথে বোঝাপড়া পরে সময়মতো করা যাবে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা অটুট রাখার দিকেই তেল আবিবের মনোযোগী হওয়া উচিত, যাতে মার্কিনীরা উত্তর ফ্রন্টে একটা সমঝোতার চেষ্টা করতে পারে। আঞ্চলিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে যে, বিপুল আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ইন্টারসেপ্টর মিসাইল ও গোলাবারুদের দরকার হবে- সেকথাও বলাই বাহুল্য।
তবে সার্বিকভাবে পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কী করতে চান- তার ওপর। হারেৎজ বলছে, ৭ অক্টোবরের পরে এই ব্যক্তিই ব্যর্থতার সার্বিক দায় সামরিক বাহিনীর ওপর চাপান। নিজের কোনো দোষই তিনি স্বীকার করেননি, আর ইসরায়েলি বিমান বাহিনীসহ মিত্রশক্তির ইরানের আক্রমণ ঠেকাতে যে সাফল্য অর্জন করেছে, এই মুহূর্তে তিনি তাঁর জোরেই রাজনৈতিকভাবে দৃঢ় অবস্থানে থাকতে পারছেন।
অনুবাদ: নূর মাজিদ