‘অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণার’ জন্য স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি পেলেন ডাচ যুবতী
অসহনীয়, দুরারোগ্য মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিলেন ডাচ যুবতী। আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের পর অবশেষে ২৯ বছর বয়সি এ যুবতীকে স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তার স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমোদন দেওয়ার পর এ ইস্যু নিয়ে ইউরোপজুড়ে এর পক্ষে-বিপক্ষে তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
গত সপ্তাহেই নেদারল্যান্ডসে ২০০২ সালে পাশ হওয়া এক আইনের আওতায় স্বেচ্ছামৃত্যুর চূড়ান্ত অনুমোদন পান জোরায়া টার বিক। সাড়ে তিন বছরব্যাপী প্রক্রিয়া শেষে এ অনুমতি পেয়েছেন তিনি।
নেদারল্যান্ডসে মানসিক রোগের জন্য স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি দেওয়ার ঘটনা অস্বাভাবিক হলেও এরকম অনুমোদনের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১০ সালে মানসিক যন্ত্রণার জন্য দুজনকে এবং ২০২৩ সালে ১৩৮ জনকে স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি দেওয়া হয়।
গত এপ্রিলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে টার বিকের স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদনের খবর প্রকাশিত হলে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়। এতে তিনি মর্মপীড়ায় পড়ে যান।
টার বিক গার্ডিয়ানকে বলেন, তার মতো যারা স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করতে চান, তাদের নিয়ে বিতর্ক হবে—এটা স্বাভাবিক। 'লোকে মনে করে মানসিকভাবে অসুস্থ হলে কেউ ঠিকমতো চিন্তা করতে পারে না। এই ভাবনা অপমানজনক। …কেউ কেউ মনে করেন, কিছু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্য চাপে রাখা হয় কি না। কিন্তু নেদারল্যান্ডসে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে এ আইন আছে। নিয়মকানুনগুলো ভীষণ কড়া, এবং সত্যিকার অর্থেই নিরাপদ।'
ডাচ আইনে স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি পেতে হলে একজন ব্যক্তি অবশ্যই এমন 'সহনীয় যন্ত্রণায় ভুগতে হবে' যার কোনো 'উন্নতির সম্ভাবনা নেই'। আর ওই ব্যক্তিকে স্বেচ্ছামৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যোগ্য এবং এ-বিষয়ে সবকিছু অবগত থাকতে হবে।
টার বিকের কষ্টের শুরু শৈশবেই। তিনি ক্রনিক ডিপ্রেশন (দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতা), উদ্বেগ, ট্রমা ও আনস্পেসিফাইড পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভুগছেন। তার অটিজমও রয়েছে। প্রেমিকের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর টার বিক ভেবেছিলেন তার সঙ্গে নিরাপদে থাকতে থাকতে একসময় তিনি সেরে উঠবেন। কিন্তু তার আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠা থামেনি।
বিক টার থেরাপি, ওষুধসহ ব্যাপক চিকিৎসা নিয়েছেন। ৩০ সেশনেরও বেশি ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি (ইসিটি) নিয়েছেন তিনি।
কিন্তু থেরাপিতে বিক টার নিজের সম্পর্কে, নিজের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে অনেককিছু জানলেও তাতে 'মূল সমস্যার সমাধান হয়নি'। তিনি বলেন, 'চিকিৎসার শুরুতে মনে আশা জাগে। ভেবেছিলাম আমি ভালো হয়ে যাব। কিন্তু চিকিৎসায় যত সময় গড়াতে লাগল, আমি ততই আশা হারাতে শুরু করলাম।'
১০ বছর পরে চিকিৎসার আর 'কিছুই বাকি নেই'। বিক টার বলেন, 'আমি জানতাম, এখন যেভাবে বেঁচে আছি, তাতে টিকে থাকতে পারব না।'
বিক টার আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু স্কুলের এক বন্ধুর ভয়াবহ আত্মহত্যা এবং তার পরিবারের ওপর ওই ঘটনার প্রভাবের কথা মনে করে আত্মহনন থেকে বিরত থাকেন তিনি।
২০২০ সালে ইসিটি শেষ করার বেশ অনেকটা সময় পর, ওই বছরের ডিসেম্বরে স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্য আবেদন করেন বিক টার। আবেদনের সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য অনুমোদন দেওয়া হয় না। প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ এবং জটিল। দীর্ঘ সময় বিক টারের আবেদনটিকে মূল্যায়নের জন্য ওয়েটিং লিস্টে রাখা হয়। একটি চিকিৎসকদল তার স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদনের গ্রহণযোগ্যতা মূল্যায়ন করে। তারপর আরেকজন স্বতন্ত্র চিকিৎসক তাদের সিদ্ধান্ত রিভিউ করেন।
বিক টার বলেন, 'এ কাজে যে সাড়ে তিন বছর লেগেছে, এই সময়ের মধ্যে আমি একবারও নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হইনি। অপরাধবোধ হয়েছে—আমার একজন সঙ্গী আছে; পরিবার, বন্ধুবান্ধব আছে—আর তাদের যন্ত্রণার বিষয়টিও আমি জানি। আর আমি ভয়ও পেয়েছি। কিন্তু কাজটি করার জন্য আমি বদ্ধপরিকর।
'প্রতিটি ধাপে প্রত্যেক চিকিৎসক বলেন: "আপনি নিশ্চিত তো? চাইলে যেকোনো মুহূর্তে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পারেন।" আমাকে সমর্থন জোগাতে চিকিৎসকদের সঙ্গে প্রতিটা আলোচনায় উপস্থিত ছিল আমার সঙ্গী। তবে কয়েকবার ওকে কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে বলা হয়েছে, যাতে আমি চিকিৎসকদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারি।'
নিজের মেডিক্যাল তিমের সঙ্গে সাক্ষাতের পর টার বিক আশা করছেন, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তার জীবনাবসান করা হবে। 'স্বস্তি বোধ করছি আমি। লম্বা লড়াই ছিল এটা।'
জীবনাবসানের দিনে মেডিক্যাল টিম টার বিকের বাড়িতে যাবে। তিনি জানান, 'প্রথমে তারা আমাকে ঘুমের ওষুধ (সিডেটিভ) দেবেন। আমি কোমায় যাওয়ার পরই হৃৎস্পন্দন থামানোর ওষুধ দেবেন। আমার জন্য ব্যাপারটা হবে ঘুমিয়ে পড়ার মতো। আমার সঙ্গী উপস্থিত থাকবে, তবে ওকে বলেছি মৃত্যুর আগমুহূর্তে চাইলে ও ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে।'