ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যু: ইরানের ভঙ্গুর বিমানব্যবস্থার মূল কারণ কি মার্কিন নিষেধাজ্ঞা?
পার্বত্য অঞ্চলে, বৈরী আবহাওয়ায় হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় রোববার (১৯ মে) ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দোল্লাহিয়ান নিহত হয়েছেন।
রোববার আজারবাইজান সীমান্তবর্তী এলাকায় একটি জলাধার প্রকল্প উদ্বোধনের পর তেহরান ফেরার পথে পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের জোলফা এলাকায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার। এতে হেলিকপ্টারের ক্রু সদস্যসহ আরও ছয়জন নিহত হন।
বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটি ছিল বেল-২১২ মডেলের । মাঝারি আকারের হেলিকপ্টারটি পাইলটসহ মোট ১৫ জন বসতে পারতেন। ইরানে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার বেশ আগেই এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমান সংস্থার তৈরি।
সামরিক বিশ্লেষক সেড্রিক লেইটনের বরাত দিয়ে মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, ইব্রাহিম রাইসিকে নিয়ে বিধ্বস্ত হওয়া হেলিকপ্টারটি ছিল ষাটের দশকের।
লেইটন জানিয়েছেন, বেল-২১২ মডেলের হেলিকপ্টার ১৯৭৬ সালে ইরানে শাহ বংশের শাসন আমলের শেষের দিকে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়। কিন্তু মার্কিন সামরিক বাহিনী এটিকে ১৯৬০ এর দশকের শেষ থেকেই ব্যবহার করে আসছিল।
১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে ইরানের ওপর বিদেশি নিষেধাজ্ঞা এবং পরে তার পারমাণবিক কর্মসূচি এবং ইউরোপিয়ান দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটি অত্যাধুনিক নতুন বিমান বা বিমানের কোনো যন্ত্রাংশ কিনতে বা সংগ্রহ করতে পারত না।
৪৫ বছর আগে ইরানের ওপর প্রথম মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে ইরানের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিশেষ করে এর বিমান সংস্থাগুলো।
১৯৭৯ সালের পর থেকে ইরানের আকাশসীমায় হওয়া সবচেয়ে বড় বিমান দুর্ঘটনা এবং বিভিন্ন দেশের নিষেধাজ্ঞা কীভাবে এই খাতকে প্রভাবিত করেছে তার সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো:
ইরানের সবচেয়ে বড় বিমান দুর্ঘটনাগুলো
জেনেভাভিত্তিক ব্যুরো অব এয়ারক্রাফট অ্যাক্সিডেন্ট আর্কাইভসের (বি৩এ) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ইরানে ২৫৩টি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ৩ হাজার ৩৩৫ জন নিহত হয়েছেন।
২১ জানুয়ারি ১৯৮০: ইরান এয়ারের পতাকাবাহী বোয়িং ৭২৭-১০০ তেহরানের আলবোর্জ রেঞ্জের একটি পাহাড়ের ঢালে আঘাত হানলে এর ১২৮ আরোহীর সবাই নিহত হন। একটি অকেজো ইনস্ট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম (আইএলএস) এবং রাতের বেলা বৈরী আবহাওয়ার কারণে সীমিত দৃশ্যমানতা থেকে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ইরানের এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলাররা ধর্মঘট থেকে ফেরার পরপরই এ দুর্ঘটনা ঘটে।
৩ নভেম্বর ১৯৮৬: ইরানের বিমান বাহিনী পরিচালিত একটি লকহিড সি-১৩০ হারকিউলিস বিমান সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশের একটি পাহাড়ি ঢালে আঘাত হানলে ন্যূনতম নিরাপদ উচ্চতা সীমা (১,৯৮১ মিটার) ৬,৫০০ ফুটের নিচে চলে যায়। উচ্চতা মাপার জন্য ব্যবহৃত আল্টিমিটারে ত্রুটির কারণে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
১৩ জুলাই ১৯৮৮: কাশেম দ্বীপে মার্কিন নৌবাহিনীর ক্রুজার ইউএসএস ভিনসনেস থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইরান এয়ার পরিচালিত একটি এয়ারবাস এ-৩০০ বিধ্বস্ত হয়। ইরানের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ এ বিমান দুর্ঘটনায় ২৯০ জন আরোহীর সবাই নিহত হন।
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০০২: ইরান এয়ার ট্যুরের একটি তুপোলেভ টিইউ-১৫৪ বিমান ভুল গতিপথ দিয়ে যাওয়ার কারণে খোররামাবাদের একটি পাহাড়ের ঢালে আঘাত হানে, এতে চার স্প্যানিশ নাগরিকসহ ১১৯ জন আরোহীর সবাই নিহত হন। বৈরী আবহাওয়ার কারণে সীমিত দৃশ্যমানতা থেকে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৩: ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) পরিচালিত একটি ইলিউশিন ২-৭৬ বিমান অবতরণের পর কেরমান বিমানবন্দরের কাছে একটি পাহাড়ে আঘাত হানলে বিমানের ২৭৫ আরোহীর সবাই নিহত হন। বিমানটি ন্যূনতম নিরাপদ উচ্চতার আগেই অবতরণ শুরু করলে দুর্ঘটনায় পতিত হয়।
১৫ জুলাই, ২০০৯: ক্যাস্পিয়ান এয়ারলাইন্স পরিচালিত একটি টুপোলেভ টিইউ-১৫৪ বিমান দ্রুত অবতরণের পর কাজভিনের একটি খোলা মাঠে বিধ্বস্ত হয়, এতে বিমানের ১৬৮ আরোহীর সবাই নিহত হন। দুর্ঘটনার জন্য ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ ক্ষতিগ্রস্ত এবং হাইড্রোলিক ও ফুয়েল লাইন কেটে যাওয়াসহ বেশ কিছু কারিগরি ত্রুটিকে দায়ী করা হয়েছে।
৮ জানুয়ারি ২০২০: ইউক্রেনের পতাকাবাহী ইউক্রেন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স পরিচালিত একটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ তেহরানের সাবাশাহরে উড্ডয়নের কয়েক মিনিট পর দুটি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ভূপাতিত হয়। বিমানটিকে 'শত্রু লক্ষ্যবস্তু' ভেবে ভুল করার পর সরকার এটিকে 'মানবিক ভুল' বলে অভিহিত করেছে।
নিষেধাজ্ঞা ইরানের বিমান খাতকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে?
১৯৭৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরপরই সরকার নতুন বিমান আমদানি করতে না পারায় ইরানের বিমান চলাচল খাত বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৮০, ১৯৯০ এবং ২০০০ এর দশকের গোড়ার দিকে ইরানের পুরোনো বিমানগুলো মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল।
নিষেধাজ্ঞার আওতায় ইরান এমন বিমান বা বিমানের সরঞ্জাম আমদানি করতে পারবে না যেগুলোতে ১০ শতাংশের বেশি মার্কিন যন্ত্রাংশ রয়েছে। এর ফলে ইরান নতুন অত্যাধুনিক পশ্চিমা বিমান বা হেলিকপ্টার কিনতে বা তার পুরানো মার্কিন বা ইউরোপিয়ান বহর চালু রাখার জন্য যন্ত্রাংশও সংগ্রহ করতে পারবে না।
এমনকি কিছু রাশিয়ান জেটও মার্কিন যন্ত্রাংশের ওপর নির্ভর করে। তাই তেহরান ও মস্কোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং তিনটি দেশেরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক বিরোধ থাকা সত্ত্বেও ইরানের পক্ষে মার্কিন যন্ত্রাংশ থাকা যেকোনো বিমান আমদানি করা কঠিন।
তাই এখনও ইরানি বিপ্লবের আগে কেনা তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের বিমান দিয়ে তাদের বিমান বাহিনী পরিচালনা করছে।
ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি অনুসারে, এপ্রিল ২০১৯ পর্যন্ত, ২৩ টি ইরানি বিমান সংস্থার কাছে থাকা মোট ৩০০ টির মধ্যে ১৫৬ টি বিমান পরিচালনা করছিল, যা ইঙ্গিত দেয় যে প্রতিস্থাপনের যন্ত্রাংশের অভাবে দেশটির প্রায় অর্ধেক বিমান উড়তে অক্ষম ছিল।
ঘন ঘন মেরামতের প্রয়োজনীয়তা ইরানে বিমানের টিকিটের দাম বাড়িয়েছে এবং ছোট বিমান সংস্থাগুলোর ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে।
ইরানের সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের প্রধান মোহাম্মদ মোহাম্মদী-বখশ ২০২২ সালে সংবাদসংস্থা ফারকে বলেছিলেন, বিমানগুলো মেরামতের জন্য বিদেশে পাঠানো যায় না এবং স্থানীয়ভাবে সীমিত বিশেষজ্ঞ জনবল দিয়ে মেরামত করতে হয়।
২০১৫ সালে জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) নামে ইরানের পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হতে পারে এমন উপকরণের উৎপাদন বন্ধ করতে রাজি হয়। বিনিময়ে, এর বিমান খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়, ফলে এটি এয়ারবাস এবং বোয়িংয়ের মতো সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বিমান কেনার অনুমতি লাভ করে।
তবে ২০১৮ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে গেলে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের মতে, সাময়িক নিষেধাজ্ঞা শিথিলে ইরানের খুব একটা লাভ হয়নি।
ইরান এই তিন বছরে পশ্চিমা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ২০০টিরও বেশি বিমানের অর্ডার দিয়েছিল, তবে ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা আবার আরোপ করার আগে কেবল তিনটি এয়ারবাস জেট এবং ১৩ টি স্বল্প দূরত্বের এটিআর টার্বোপ্রোপস বিমান পেতে সক্ষম হয়েছিল।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন