আইসিসির করিম খান: আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া এক কৌঁসুলি
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত - আইসিসির করিম খান খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দুর্দান্ত এক কৌঁসুলি হিসেবে নাম কামিয়েছেন। বিচারপ্রক্রিয়ার অতি মন্থরগতির জন্য এই আদালত নিয়ে যেখানে সমালোচনা আছে, সেখানে করিম খান যেন ব্যতিক্রম।
ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তিনি বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য গেপ্তারি পরোয়ানার আবেদন করেছিলেন এর আগে। আর সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ হামাসের শীর্ষ তিন নেতার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চেয়েছেন আইসিসির বিচারকমণ্ডলীর কাছে।
গাজায় ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়ে আসছে, বিশ্ব গণমাধ্যমের ফুটেজসহ খোদ ইসরায়েলি সেনাদের করা ভিডিওগুলোও তাঁর সাক্ষ্য দিচ্ছে। আর যুদ্ধের শুরু থেকেই গণহত্যায় সরাসরি প্ররোচণামূলক বক্তব্য দিয়ে এসেছেন নেতানিয়াহুসহ তাঁর সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীরা।
এই অবস্থায়, করিম খান নেতানিয়াহুর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চাইবেন গত মাস-দেড়েক ধরে এমন ধারণা করা হচ্ছিল। নেতানিয়াহুর মন্তব্যেও এই আশঙ্কার ছায়া দেখা গেছে। এরমধ্যে ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্রদের তীব্র চাপের মুখেও নতিস্বীকার করেননি ঝানু এই ব্রিটিশ আইনজ্ঞ। সেই অর্থে, তাঁর সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে আইসিসির ইতিহাসের এক নতুন ও উল্লেখযোগ্য অধ্যায় বলতে হয়।
আইসিসির এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এবং হামাসের শীর্ষ তিন নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার, মোহাম্মদ দেইফ এবং ইসমাইল হানিয়ের বিরুদ্ধে গেপ্তারি পরোয়ানা চাওয়া হয়েছে।
পুরো বিষয়টি নিয়েও চরম রাজনৈতিক মেরুকরণ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা এর বিরোধিতা করেছেন, এবং আইসিসি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে আদালতের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্য বিল পাসের কথাও বলেছেন।
এদিকে ইসরায়েলি নেতাদের সাথে হামাস নেতাদের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চাওয়ার প্রতিবাদ জানিয়েছে হামাস।
আইসিসির প্রধান কৌঁসুলির এই আবেদনের ব্যাপারে হামাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সামি আবু জুহরি বলেন, এর মাধ্যমে ভুক্তভোগীকে ঘাতকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
এর ব্যাখ্যা দিয়ে আইসিসির বিবৃতিতে বলা হয়, "মৌলিক একটি বিষয়ে আজ স্পষ্টভাবে জানিয়ে রাখা দরকার। আমরা যদি আইনকে সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ না করি, তাহলে এটা বাছাইকৃতভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে এমন দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। এরমধ্যে দিয়ে আমরা আইনের শাসন ভেঙে পড়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করব।"
"তাতে করে, দুর্দশার সময় ভুক্তভোগীরা যে আইনি নিরাপত্তা চায় অথবা সকল ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষায় – আমাদের মধ্যে যে বন্ধনগুলো এখনও অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও আলগা হয়ে পড়বে" বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে।
করিম খানের এই সিদ্ধান্ত আইসিসির ইতিহাসে বিরলও। এতদিন উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আইনের প্রয়োগ করে এসেছে আইসিসি। যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্তদের বেশিরভাগই ছিলেন আফ্রিকা মহাদেশের। সেখানে ইসরায়েলের মতো পশ্চিমা মদদপুষ্ট দেশের বিরুদ্ধে আদালতের বিচারিক প্রক্রিয়া– বৈশ্বিক দক্ষিণ বা উন্নয়নশীল বিশ্বের সামনে আইনের সমান প্রয়োগের দৃষ্টান্ত হবে।
৫০ বছরের করিম খানকে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ২০২১ সালে আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি নিযুক্ত করা হয়। আয়ারল্যান্ড, স্পেন ও ইতালির অন্য প্রার্থীদের হারিয়ে প্রধান কৌঁসুলি নির্বাচিত হন তিনি। কৌঁসুলি নির্বাচিত হতে অন্তত ৬২টি সদস্যের সমর্থন দরকার, সেখানে ৭২টি দেশের ভোট পেয়েছিলেন করিম খান।
আইন বিষয়ে করিম খান উচ্চতর শিক্ষা সম্পন্ন করেন লন্ডনের কিংস কলেজে। এসময় আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার সম্পর্কে তাঁর মধ্যে আগ্রহ দেখা যায়। পাকিস্তানের আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সদস্য হওয়ায় মানবাধিকার সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ শুরু থেকেই ছিল।
১৯৮০'র দশকে আহমদিয়া সম্প্রদায় নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দিতে পারবে না এমন একটি আইন পাস করে পাকিস্তান সরকার। এরপরে লন্ডনে তাদের সদর দফতর সরিয়ে নেয় আহমদিয়ারা। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে মানবাধিকার বিষয়ে পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ করে বলে জানিয়েছিলেন করিম খান।
১৯৯২ সালে তিনি বারের সদস্য হন, এবং যুক্তরাজ্যের ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের মাধ্যমে আইনচর্চা শুরু করেন। আইসিসির কৌঁসুলি নিযুক্ত হওয়ার পরে আইনবিষয়ক একটি ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে করিম খান জানান, টেলিভিশনে বলকান যুদ্ধের ভয়াবহতার দৃশ্য দেখে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক যুগোস্লাভিয়ার জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন, এবং তাতে সফলও হন।
আইসিসির কৌঁসুলি নির্বাচনের সংক্ষিপ্ত তালিকায় শুরুতে তাঁর নাম ছিল না। তবে কেনিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্টের পক্ষে একটি মামলা লড়ে জয়ী হওয়ায় –দেশটির অনুরোধে করিম খানকে এ তালিকায় রাখা হয়। উল্লেখ্য ২০০৭ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা ১,২০০ জন নিহত হওয়ার পরে কেনিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রোটোর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল আইসিসিতে।
২০১৬ সালে রোটোর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো খারিজ করে আইসিসি। এসময় আদালত জানান, সাক্ষীদের প্রভাবিত করা এবং বিচার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঘটার প্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কিংস কলেজে করিম খানের আন্তর্জাতিক আইনের শিক্ষক ছিলেন ফিলিপ স্যান্ডস কেসি। তখন থেকেই দুজনের সম্পর্ক। সাবেক ছাত্রের আইসিসির কৌঁসুলি নিযুক্ত হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, "অ্যাডভোকেট হিসেবে অসামান্য এক ক্যারিয়ার রয়েছে তাঁর। সে এই দায়িত্ব পালনের জন্য ব্যাপক অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানসমৃদ্ধ, যার সহায়তায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের অধীনে বিচারিক প্রস্তুতি, বা আইনপ্রয়োগের ক্ষেত্রে যা যা দরকার, সে করতে পারবে।"