রাফায় সামরিক অভিযান বন্ধে ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের নির্দেশ
গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণকে রক্ষায় ব্যবস্থা নিতে দক্ষিণ আফ্রিকার অনুরোধে সাড়া দিয়ে শুক্রবার (২৪ মে) ইসরায়েলকে রাফায় সামরিক অভিযান বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)।
রায়ে বলা হয়, ইসরাইলকে অবিলম্বে রাফায় সামরিক অভিযান এবং অন্য সব ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।
আদালত আরও উল্লেখ করেছেন, ইসরায়েলকে অবশ্যই নির্ভরযোগ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেকোনো তদন্তকারী সংস্থাকে গণহত্যার অভিযোগ তদন্তের উদ্দেশ্যে গাজায় 'নিরবচ্ছিন্ন' যাতায়াত সুবিধা দিতে হবে।
আইসিজে-র রায় পড়ে শোনানোর সময় সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট নওয়াফ সালাম বলেছেন, 'আদালত ইসরায়েলকে গাজার সর্বশেষ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পর থেকে ফিলিস্তিনি উপত্যকার পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নতুন করে জরুরি আদেশ দেওয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে।'
তিনি বলেন, 'ইসরায়েল রাষ্ট্রকে (...) অবিলম্বে রাফাহ গভর্নরেটে তার সামরিক অভিযান এবং তাদের যেসব কর্মকাণ্ড গাজার নাগরিকদের জীবনযাত্রার উপর প্রভাব ফেলতে পারে বা তাদের শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, তা বন্ধ করতে হবে।'
আদালত গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশের জন্য মিশর ও গাজার মধ্যে রাফাহ ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ইসরায়েলকে।
এছাড়া আদালত বলেছেন, তদন্তকারীদের অবরুদ্ধ উপত্যকায় প্রবেশের ব্যবস্থা করতে হবে এবং এক মাসের মধ্যে এর অগ্রগতি সম্পর্কে রিপোর্ট দিতে হবে।
সারা বিশ্বের ১৫ জন বিচারকের প্যানেল ১৩-২ ভোটের ভিত্তিতে এই রায় প্রণয়ন করেছেন। শুধু উগান্ডা ও ইসরায়েলের বিচারক এ রায়ের বিরোধিতা করেছেন।
এক সপ্তাহ আগে দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে একটি মামলা করে এবং ইসরায়েলকে রাফায় অভিযান বন্ধের নির্দেশ দেওয়ার আহ্বান জানায়।
শুক্রবার আদালত প্রিটোরিয়ার অনুরোধ পর্যালেচনা করে এই রায় দিয়েছেন।
বিচার আদালতের বাইরে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীদের একটি ছোট দল পতাকা উড়িয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিনের ডাক দেয়।
তবে ইসরায়েল বারবার গণহত্যার মামলার অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
আদালতে ইসরায়েল যুক্তি দিয়েছে, গাজায় তাদের অভিযান আত্মরক্ষার এবং ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলাকারী হামাস জঙ্গিদের লক্ষ্য করে।
শুক্রবারের রায়ের আগে ইসরায়েলি সরকারের এক মুখপাত্র বলেছেন, 'পৃথিবীর কোনো শক্তিই ইসরায়েলকে তার নাগরিকদের রক্ষা করা এবং গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো থেকে বিরত রাখতে পারবে না।'
চলতি মাসে ইসরায়েল দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফায় হামলা শুরু করে। এর ফলে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি এমন একটি শহর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়, যা গাজার ২৩ লাখ জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকা এই আদেশকে 'যুগান্তকারী' বলে অভিহিত করেছে
দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ আইসিজের এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে এবং এই আদেশকে 'যুগান্তকারী' বলে বর্ণনা করেছে।
দেশটি বলেছে, তারা এই আদেশ নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে যাবে।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
আইসিজের রায়ের পর ইসরায়েলের আইনি দল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
তবে ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ বলেন, যারা ইসরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধের দাবি করছেন, তারা দাবি করছেন যে ইসরায়েলের অস্তিত্ব বিলীন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। ইসরায়েল কখনোই এতে রাজি হবে না।
ইসরায়েলের বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার লাপিদ আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায়ের নিন্দা জানিয়েছেন।
তিনি জানান, যুদ্ধ বন্ধের দাবির সঙ্গে গাজায় থাকা ইসরায়েলি জিম্মিদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবির মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়েছেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত।
লাপিদ বলেন, এই দুটি বিষয়কে সংযুক্ত করতে আদালতের ব্যর্থতা 'নৈতিক অবক্ষয় ও নৈতিক বিপর্যয়'।
রাফাহ বিষয়ে আইসিজে'র সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে হামাস
হামাস রাফাহ বিষয়ে আইসিজে'র সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে, তবে শুধু এই রায় যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছে।
হামাসের একজন কর্মকর্তা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে এই রায় যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন এবং গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
হামাস জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকেও আইসিজে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে।
পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) মুখপাত্র বলেছেন, তারা আইসিজে'র সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।
তিনি বলেন, এ রায় গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন শেষ করার জন্য একটি 'আন্তর্জাতিক ঐকমত্য'-এর প্রতিনিধিত্ব করছে।
সাত মাস ধরে চলা সংঘাত
গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় এক হাজার ২০০ মানুষ নিহত ও আড়াই শতাধিক মানুষকে জিম্মি করার পর গাজায় আগ্রাসন শুরু করে ইসরায়েল।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েলের আগ্রাসনে ৩৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। গাজার জনসংখ্যা প্রায় ২৩ লাখ।
সর্বশেষ লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফাহ।
গাজার দক্ষিণ প্রান্তের রাফায় ইসরায়েলের হামলার ফলে কয়েক লাখ মানুষ পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া গাজায় ত্রাণের প্রধান প্রবেশপথও বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল, যার ফলে ব্যাপক প্রাণহানি ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ইসরায়েল বলছে, সেখানে আশ্রয় নেওয়া হামাস যোদ্ধাদের শেষ ব্যাটালিয়নকে নির্মূল করতে শহরটিতে হামলা চালানো ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই।
চলতি মাসের শুরু থেকেই ধীরে ধীরে রাফাহর পূর্ব উপকণ্ঠে অগ্রসর হয়েছে ইসরায়েলি সেনারা।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি