ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ইসরায়েলের একার পক্ষে ধ্বংস করা সম্ভব নাও হতে পারে
ইরানের বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাতের চিন্তা করছে ইসরায়েল। জল্পনা রয়েছে, এটি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করতে পারে।
কিন্তু এ মাত্রার আক্রমণ পরিচালনায় কিছু গুরুতর জটিলতা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন হামলার জন্য ইসরায়েলের সরাসরি মার্কিন সমর্থনের প্রয়োজন হতে পারে।
জেনেভা গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউটের একজন জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী ফারজান সাবেত বিজনেস ইনসাইডারকে বলেন, 'ইসরায়েল মার্কিন সহায়তা ছাড়াই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তবে দেশটি নিজে থেকে প্রচলিত আক্রমণপদ্ধতিতে এ ধরনের হামলা চালিয়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে বড় ধাক্কা দিতে পারবে কি না তা স্পষ্ট নয়।'
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতোমধ্যে ইসরায়েলের এ ধরনের কোনো হামলার বিরোধিতা করেছেন।
'এর উত্তর হলো না,' বুধবার এক সাংবাদিক তাকে ইসরায়েলের এমন পদক্ষেপ সমর্থন করেন কি না প্রশ্ন করলে এভাবেই জবাব দিয়েছিলেন বাইডেন।
'একটা বড় ভুল'
দীর্ঘকালের আঞ্চলিক শত্রু ইসরায়েল ও ইরান সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে — এ আশঙ্কা এখন আরও তীব্র হয়েছে। এমন কোনো যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে মরিয়া হয়ে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
গত মঙ্গলবার ইসরায়েলে প্রায় ১৮০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব মিসাইলের বেশিরভাগই ইসরায়েলি ও মার্কিন সামরিক বাহিনী প্রতিহত করেছে।
ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী বিদেশি প্রক্সি লেবাননের হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে তেল আবিবের ক্রমবর্ধমান অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় ইরান এমন হামলা চালায়।
৭ অক্টোবর ইরানের আরেক মিত্র হামাস ইসরায়েলে বিধ্বংসী হামলা চালানোর পর হামাসকে ধ্বংস করার চেষ্টায় এক বছর অতিবাহিত করেছে ইসরায়েল। দেশটি এখন হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে অস্ত্র তাক করেছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ইরান 'বড় ভুল করেছে' এবং 'এর মাশুল দেবে'। বিশেষজ্ঞরা ইসরায়েলের দিক থেকে একটি আসন্ন প্রতিক্রিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছেন, পাল্টা হামলায় ইসরায়েল ইরানের প্রভাবশালী কাউকে গুপ্তহত্যা বা দেশটির জ্বালানি অবকাঠামো ধ্বংস করার চেষ্টা করতে পারে।
ক্রমবর্ধমান সংঘাতের কারণে উৎপাদন সীমিত হতে পারে এমন জল্পনার মাঝে জ্বালানি তেলের দাম শুক্রবার চতুর্থ দিনের মতো বেড়েছে।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েল আঘাত করলে তার প্রতিক্রিয়ায় ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির তোড়জোড় শুরু করতে পারে বলেও অনেক বিশেষজ্ঞ ধারণা করছেন।
বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে ইসরায়েল
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বিস্তৃত পরিসরে হামলা চালাতে চাইলে ইসরায়েলকেও বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করতে হবে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে দূরত্ব।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসরায়েল এবং ইরানের প্রধান পারমাণবিক ঘাঁটির মধ্যকার দূরত্ব এক হাজার মাইলেরও বেশি।
ইউএস কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের ২০১২ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানে এমন হামলার জন্য ইসরায়েলের প্রায় ১০০টি বিমান দরকার হবে। এ সংখ্যা ইসরায়েলের ৩৪০টি যুদ্ধবিমানের বহরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের সমান।
এছাড়া ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো লক্ষ্যবস্তু হিসেবেও জটিল; এগুলো বিভিন্ন স্থানে বিস্তৃত, সবচেয়ে সংবেদনশীল স্থাপনাগুলোর বেশ কয়েকটি অতি সুরক্ষিত ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারের মধ্যে অবস্থিত।
ফোর্তো ও নাতানজের মূল ভূগর্ভস্থ স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার জন্য ইসরায়েলকে বাঙ্কারবিধ্বংসী মার্কিন জিবিইউ-৫৭এ/বি বোমা ব্যবহার করতে হবে বলে গত অক্টোবর লিখেছিলেন বুলেটিন অব দ্য অ্যাটমিক সায়েন্টিস্ট-এর বিশেষজ্ঞরা।
এছাড়া আক্রমণের জন্য ইরানের আকাশ-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং স্থাপনাগুলোকে ধ্বংস করতে হবে যাতে ইরান হামলার সময় পাল্টা প্রতিরোধ না করতে পারে।
লন্ডনের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের সামরিক বিজ্ঞানের পরিচালক ম্যাথিউ স্যাভিল বিজনেস ইনসাইডারকে বলেন, 'একা ইসরায়েলই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর গুরুতর ক্ষতি করতে পারে, তবে মার্কিন সহায়তা ছাড়া বাঙ্কারের ভেতরকার স্থাপনাগুলো হয়তো দেশটির পক্ষে ধ্বংস করা সম্ভব নয়।'
সম্ভাব্য বিকল্প সীমিত হামলা
ইসরায়েলের আরেকটি বিকল্প হলো আরও সীমিত পরিসরে আক্রমণ পরিচালনা করা।
ইউনিভার্সিটি অব হালের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিভাগের অধ্যাপক রবার্ট ডোভার বলেন, এ ধরনের হামলার ক্ষেত্রে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির লজিস্টিক লাইনে আক্রমণ দেখা যেতে পারে।
ডোভার বলেন, 'ইসরায়েলের ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির লজিস্টিক লাইনে আক্রমণ করার সম্ভাবনা বেশি, যা তাদের সামরিক কর্মকাণ্ড বর্তমানে যেভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় সেই ঘণ্টাভিত্তিক সময়সীমার মধ্যে অর্জন করা যেতে পারে।'
ফারজান সাবেত ডোভারের এ ধারণার সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, এ পর্যায়ে সামরিক ঘাঁটি, সেকেন্ডারি পারমাণবিক স্থাপনা এবং অর্থনৈতিক স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
ইরান সবসময় বলে এসেছে, এটির পারমাণবিক কার্যক্রম শান্তিপূর্ণ এবং তাদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কোনো পরিকল্পনা নেই।
তবে এটি পারমাণবিক চুক্তি লঙ্ঘনের দায়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছে। এর ফলে দেশটির অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ফিলিপ্পো ডিওনিগি বিজনেস ইনসাইডারকে বলেন, বাইডেনের ওই মন্তব্য সত্ত্বেও ইসরায়েল এমন কোনো আক্রমণ চালালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।