মহারাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ বাবা সিদ্দিকীকে জনসম্মুখে হত্যার বিষয়ে যা জানা গেল
ভারতের মুম্বাইয়ের জনবহুলপূর্ণ এক এলাকায় বাবা জিয়াউদ্দিন সিদ্দিকী নামের এক রাজনীতিবিদকে হত্যা করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ৬৬ বছর বয়সি এই নেতাকে গুলি করা হয়। এরপর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করে।
সিদ্দিকীকে হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। প্রখ্যাত এই রাজনীতিবিদ মহারাষ্ট্রের কোয়ালিয়েশন সরকারের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা ছিলেন। এক্ষেত্রে তার মৃত্যুর ঘটনার রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে দোষারোপ করছে।
সিদ্দিকীকে হত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে এখনো সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে অনেকে এক্ষেত্রে ৯০ দশকের পরিস্থিতির স্মৃতিচারণ করছেন। যখন কি-না রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সিনেমা জগতের তারকারা মুম্বাইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ড সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পরিণত হতো।
সিদ্দিকীকে হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্তও চলছে। স্থানীয় গণমাধ্যম জানান, গ্রেফতারকৃতরা একটি দুর্ধর্ষ গ্যাংয়ের সদস্য; যার প্রধান এখন জেলে রয়েছেন।
বাবা সিদ্দিকী কে?
বাবা সিদ্দিকীর জন্ম বিহার রাজ্যে। তবে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবার সাথে তিনি মুম্বাইয়ে চলে আসেন। যিনি পেশায় ছিলেন একজন ঘড়ি নির্মাতা।
১৯৮০-এর দশকে কংগ্রেসের ছাত্রনেতা হিসেবে সিদ্দিকীর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয়। শীঘ্রই তিনি মুম্বাইয়ে কংগ্রেসের যুব উইংয়ের নেতৃত্বে আসেন। এরপর তিনি স্থানীয় কাউন্সিলের রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং তিনবার রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালে মন্ত্রিত্ব লাভ করেন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সিদ্দিকী কংগ্রেস ছেড়ে ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টিতে যোগ দেন। যারা কি-না বর্তমানে মুম্বাইয়ে বিজেপি ও শিব সেনা সরকারের সাথে কোয়ালিয়েশন সরকারে রয়েছেন।
রাজনৈতিক কার্যক্রম ছাড়া সিদ্দিকী রমজান মাসে জাঁকজমকপূর্ণ ইফতারের আয়োজন করে বেশ আলোচনায় আসতেন। যেখানে বলিউডের শীর্ষ অভিনেতারা আমন্ত্রিত ছিলেন।
২০১৩ সালে সিদ্দিকীর ইফতার আয়োজনে সালমান খান ও শাহরুখ খান এসেছিলেন। সেক্ষেত্রে প্রতি বছরই এই আয়োজন ঘিরে মুম্বাইবাসীর মধ্যে একটা বাড়তি আগ্রহ ছিল।
সিদ্দিকীকে যেভাবে হত্যা করা হয়
সিদ্দিকীকে তার ছেলের অফিসের সামনেই গুলি করা হয়। মুম্বাইয়ের ব্যস্ততম বান্দ্রা এলাকায় গাড়িয়ে ওঠার সময় ঘটনাটি ঘটে।
পুলিশ জানায়, আততায়ীরা সিদ্দিকীর বুক ও তলপেট লক্ষ্য করে ছয় থেকে সাত রাউন্ড গুলি করে তাৎক্ষণিক পালিয়ে যায়। একইসাথে একজন পথচারীও পায়ে গুলি লেগে আহত হন।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে তারা দুইটি পিস্তল ও ২৮টি লাইভ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে।
সিদ্দিকের তিনজন পুলিশ গার্ড ছিল। স্থানীয় গণমাধ্যমে তথ্য অনুযায়ী, তার নিরাপত্তা কয়েকদিন আগেই বাড়ানো হয়েছিল। তবে ঐ সময়ে সন্দেহভাজনেরা আতশবাজির ধোঁয়া তৈরি করে নিরাপত্তারক্ষীদের বিভ্রান্ত করে ফেলেছিল।
তদন্তের পরিস্থিতি
গ্রেফতারকৃতদের এক সপ্তাহের জন্য পুলিশি হেফাজতে রাখা রয়েছে। পুলিশ জানায়, অভিযুক্তদের সঙ্গীদের খোঁজা হচ্ছে।
পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তা দত্ত নালাওয়াদে বলেন, "আমরা ১৫টি দল গঠন করেছি এবং কারা শ্যুটারদের লজিস্টিক সহায়তা দিয়েছে তা শনাক্ত করতে তদন্ত করছি।"
স্থানীয় কয়েকটি রিপোর্টের সূত্রমতে, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের সাথে দুর্ধর্ষ বিষ্ণু গ্যাংয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে এটি নিশ্চিত করা হয়নি। এক্ষেত্রে গ্যাং লিডার লরেন্স বিষ্ণু বেশ কয়েকটি মামলায় অভিযুক্ত। বর্তমানে তিনি গুজরাটের হাই-সিকিউরিটি জেলে রয়েছেন।
ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই একজন ব্যক্তি নিজেকে ঐ গ্যাংয়ের সদস্য হিসেবে দাবি করে ফেসবুকে পোস্ট দেন যে, তারাই সিদ্দিকীর হত্যাকাণ্ডের পেছনে দায়ী। পুলিশের পক্ষ থেকে এখনো ঐ পোস্টের নির্ভুলতা যাচাই করা হয়নি।
২০১৫ সাল থেকে জেলে থাকলেও প্রায়শই আলোচনায় আসছেন বিষ্ণু। সোশ্যাল মিডিয়ার বেশ কয়েকটি অ্যাকাউন্ট থেকে তার জেলে থাকা অবস্থায় সেলফি তুলে পোস্ট করা হয়। এমনকি ২০২২ সালের এক টিভি চ্যানেলে তিনি সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন।
তবে বিঞ্চু সম্পর্কে পাওয়া বেশিরভাগ তথ্যই পুলিশ সূত্র থেকে পাওয়া। এক্ষেত্রে তিনি জেলে থেকে কীভাবে গ্যাং অপারেশন চালায় সেটি স্পষ্ট নয়।
২০২২ সালে পাঞ্জাবী র্যাপার সিধু মুসেওয়ালার হত্যার পেছনেরও বিষ্ণু গ্যাংয়ের নাম এসেছিল। এপ্রিলে সালমান খানের অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে গোলাগুলির অভিযোগে গ্যাংটির দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।
এদিকে সোমবার কানাডিয়ান পুলিশ অভিযোগ করে যে, বিষ্ণু গ্যাংয়ের ভারতীয় এজেন্টদের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। দেশটিতে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের লক্ষ্যবস্তু করার জন্য তারা গ্যাংটিকে ব্যবহার করছে। যদিও কানাডার এই দাবির বিষয়ে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
নব্বইয়ের দশকে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও বলিউড তারকাদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অহরহ দেখা গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে এমন ঘটনা এটিই প্রথম। স্থানীয় গণমাধ্যম জানায়, মৃত্যুর দুই সপ্তাহ আগেই তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। যার ফলে তার নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়েছিল।
হুমকির কিছুদিন পরেই সিদ্দিকীর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বেশ চাপে পড়েছে মহারাষ্ট্র সরকার। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মল্লিকার্জুন খাড়গে এটিকে 'আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির সম্পূর্ণ ব্যর্থতা' বলে অভিহিত করেছেন।
দিল্লীর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেন, "ঘটনাটি শুধু মহারাষ্ট্র নয় বরং পুরো দেশকেই ভীত করেছে।"
এদিকে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে বলেছেন, "(অপরাধী) যেই হোক না কেন, সে রেহাই পাবে না। এবার সেটা বিষ্ণু গ্যাং হোক কিংবা অন্য কোনো আন্ডারওয়ার্ল্ড গ্যাং। যারা হুমকি পাচ্ছে, তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। এই দায়িত্ব পালন করা হবে।"
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান