জেলে বসে যেভাবে ৭০০ শুটার আর কুখ্যাত গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করেন লরেন্স বিষ্ণোই
২০২২ সালে পাঞ্জাবের মানসা জেলায় জনপ্রিয় পাঞ্জাবি গায়ক সিধু মুসে ওয়ালার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনায় আসেন। কয়েক বছর পর, কুখ্যাত বিষ্ণোই গ্যাংয়ের নেতা আবারও জনসাধারণের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন কারণ গ্যাং-এর সদস্যরা দাবি করেছেন, তারা মুম্বাইয়ের প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা বাবা সিদ্দিকের হত্যার সঙ্গে জড়িত।
এনসিপি নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী বাবা সিদ্দিককে (৬৬) শনিবার (১২ অক্টোবর) রাতে মুম্বাইয়ের বান্দ্রা পূর্বে তার ছেলের অফিসের বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনজন হামলাকারী তাকে লক্ষ্য করে একাধিক গুলি ছোঁড়েন। হামলাকারীরা দাবি করেছেন, তারা বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্য, যার নেতা লরেন্স বর্তমানে গুজরাটের সাবরমতি জেলে বন্দী রয়েছেন।
বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সংঘটিত হত্যাকাণ্ডটি লরেন্স বিষ্ণোই-এর জেলে থাকা অবস্থাতেও শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখা, জেলে বসেই গ্যাং পরিচালনা এবং অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাকে নির্দেশ করে।
বিষ্ণোই গ্যাং
বিষ্ণোই গ্যাং কোনো ছোটখাট সিন্ডিকেট নয়, তাদের বিশ্বজুড়ে কার্যক্রম রয়েছে। এই গ্যাংটির অপারেশন বিস্তৃত এবং জটিল, যা ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, দিল্লি এবং হিমাচল প্রদেশের মতো কয়েকটি রাজ্যে ছড়িয়ে রয়েছে। গ্যাংটির বিদেশেও যোগাযোগ রয়েছে, বিশেষ করে কানাডায়; যেখানে অপরাধ সিন্ডিকেটের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য গোল্ডি ব্রার অবস্থান করছেন। তাদের প্রভাব এবং নেটওয়ার্ক এতটাই বিস্তৃত যে, লরেন্স বিষ্ণোই যখন জেলে বন্দী থাকেন তখনও গ্যাংটির কার্যক্রম অব্যাহত থাকে।
বিষ্ণোই গ্যাংয়ের চাঁদাবাজি, হত্যা এবং অস্ত্র পাচারে জড়িত থাকার হার বছর ধরে ক্রমাগত বাড়ছে। এই গ্যাংটি মূলত উচ্চপ্রোফাইল টার্গেট, যেমন পাঞ্জাবি সঙ্গীতশিল্পী, অ্যালকোহল মাফিয়া এবং অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের থেকে চাঁদা আদায় করে এবং হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য পেশাদার শুটারদের নিয়োগ করে। এছাড়া ভুক্তভোগীদের চুপ রাখার জন্য ভীতি সৃষ্টি করে।
লরেন্স বিষ্ণোই ১৯৯৩ সালে পাঞ্জাবের আবোহরের কাছে ধত্তারানওয়ালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হরিয়ানা পুলিশের একজন কনস্টেবল ছিলেন। সাধারণ পরিবার থেকে আসা সত্ত্বেও, লরেন্স বিষ্ণোই-এর উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে অন্ধকার পথে নিয়ে যায়। তিনি যখন চণ্ডীগড়ের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলেন, তখনই তিনি সংগঠিত অপরাধের জগতে প্রথম পদার্পণ করেন। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় ভবিষ্যতের গ্যাং নেতা গোল্ডি ব্রারের, যিনি পরে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠেন।
লরেন্স বিষ্ণোই যেভাবে গ্যাং চালান
গুজরাটের সাবরমতী জেল বা দিল্লির তিহার জেল, যে কোন জায়গায় লরেন্স বিষ্ণোই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে যোগাযোগ করেন। বছরের পর বছর এই গ্যাংস্টারকে এক জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তর করা হয়েছে এবং তাকে একাকী অবস্থায় রাখা হয়। এই বছরের শুরুতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছিল, যেখানে লরেন্স বিষ্ণোইকে পাকিস্তানের গ্যাংস্টার শাহজাদ ভাট্টির সঙ্গে কথা বলতে দেখা গিয়েছিল।
মোবাইল ফোনগুলো সাধারণত অন্যান্য বন্দীদের মালিকানাধীন হয় এবং এগুলো উচ্চ-মানের ভিপিএন নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত থাকে যাতে যোগাযোগের সময় আইপি ঠিকানা এবং অবস্থান গোপন করা যায়। লরেন্স বিষ্ণোই ভারতে এবং বিদেশে তার সহযোগীদের সাথে যোগাযোগ করতে সিগন্যাল এবং টেলিগ্রামের মতো অ্যাপস ব্যবহার করেন। বিষ্ণোই গ্যাংয়ের শাখা বেশ কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে উত্তর আমেরিকায়। লরেন্স বিষ্ণোই প্রায়ই তার ভাই আনমোল এবং সহযোগী গোল্ডি ব্রার ও রোহিত গোদারার সাথে যোগাযোগ করেন। এই গ্যাংয়ের খালিস্তানি সন্ত্রাসীদের এবং উত্তর আমেরিকায় ভিত্তি স্থাপনকারী খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
ভারতে গ্যাংয়ের প্রায় ৭০০ জন শুটার রয়েছে। সূত্র অনুসারে, বিষ্ণোই গ্যাং স্থানীয় গ্যাংস্টারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। এই স্থানীয় গোষ্ঠীগুলো পরবর্তীতে অস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শুটারদের নিয়োগ করে এবং বিষ্ণোই গ্যাংয়ের হয়ে করা কোনো চুক্তিভিত্তিক হত্যাকাণ্ড বা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের জন্য ভাল অর্থ পায়।
নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা সাধারণত দরিদ্র পরিবার থেকে আসে কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে, যারা দ্রুত টাকা উপার্জনের খোঁজে থাকে। সম্ভাব্য শুটাররা জানেন না, তারা কাদের জন্য কাজ করছেন। তাদের শুধু একটি কাজ দেওয়া হয়: একটি টার্গেটকে হত্যা করা।
বিষ্ণোই গ্যাং একটি কর্পোরেট কোম্পানির মতো কাজ করে, অনেকটা দাউদ ইব্রাহিমের ডি-কোম্পানির মতো।
এই গ্যাং বিশাল শার্পশুটার [শুটিংয়ে অত্যন্ত পারদর্শী ব্যক্তি] বাহিনীর পাশাপাশি, আলাদা বিভাগ এবং কর্মী রয়েছে যারা লজিস্টিক, আইনগত সাহায্য প্রদান এবং তথ্য সংগ্রহের কাজ করেন।
বিষ্ণোই গ্যাংয়ের আলোচিত কর্মকাণ্ড
বছরের পর বছর ধরে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের কার্যকলাপ বেড়েছে এবং তাদের পদ্ধতিও আরো মারাত্মক হয়েছে। পাঞ্জাবি গায়ক ও অ্যালকোহল মাফিয়াদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা থেকে শুরু করে আলোচিত খুনের ঘটনায় জড়িত থাকা; বিষ্ণোই গ্যাং নিজেদের নির্মম কর্মকাণ্ডের জন্য কুখ্যাত হয়ে উঠেছে।
কারাগারের ভেতর থেকেও লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সমস্ত কাজকর্ম পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে ধারণা করা হয়। কারাগার কর্তৃপক্ষ অনেক দিন ধরেই সন্দেহ করছে, ভারতের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার জেলে বন্দী অনেক গ্যাং নেতার মতো লরেন্স বিষ্ণোইও কারাগারের ভেতর থেকেই তার অপরাধ সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন। তিনি চোরাই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে বাহিরে থাকা বিশ্বস্ত সহযোগীদের মাধ্যমে এসব কাজ পরিচালনা করেন। উদাহরণ হিসেবে তাকে ভরতপুর জেলে থাকা অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করে খুন ও অর্থ আদায়ের ষড়যন্ত্র চালাতে দেখা যায়।
লরেন্স বিষ্ণোই-এর সবচেয়ে সাহসী ষড়যন্ত্রগুলোর একটি ছিল, বলিউড তারকা সালমান খানকে হত্যা করার পরিকল্পনা; যেটির সাথে সালমানের হরিণ শিকার মামলার সম্পর্ক ছিল। বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্যদের কাছে ব্ল্যাকবাক হরিণ (কৃষ্ণমৃগ) পবিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
১৪ এপ্রিল মুম্বাইয়ের বান্দ্রায় সালমান খানের বাড়ির সামনে মোটরসাইকেলে থাকা দুই ব্যক্তি একাধিক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এই ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অভিযোগপত্র অনুযায়ী, বিষ্ণোই গ্যাং সালমান খানকে হত্যার জন্য ২৫ লাখ রুপির চুক্তি করেছিল। এই পরিকল্পনা ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কয়েক মাস ধরে তৈরি করা হয়। তদন্তে প্রকাশ পায়, বিষ্ণোই গ্যাং পাকিস্তান থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্র সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করেছিল। এসব অস্ত্রের মধ্যে ছিল: একে-৪৭, একে-৯২, এম১৬ রাইফেল এবং তুরস্কের তৈরি জিগানা পিস্তল, যেটি পাঞ্জাবি গায়ক সিধু মুসে ওয়ালার হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছিল।
বিষ্ণোই গ্যাংয়ের নেটওয়ার্কে অন্যান্য অপরাধীদের সঙ্গে অংশীদারিত্বও রয়েছে, যেমন কুখ্যাত গ্যাংস্টার সন্দীপ ওরফে কালা জাঠেদি। সন্দীপকে ২০২১ সালে দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল মহারাষ্ট্রের সংগঠিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আইনের (এমসিওসিএ) আওতায় গ্রেপ্তার করেছিল।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়