ইউক্রেনের প্রতিবেশীরাও এখন পিঠ দেখাচ্ছে
গত ২৪ নভেম্বর রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফায় বিজয়ী হন কট্টর জাতীয়তাবাদী ও রুশপ্রেমী বলে পরিচিত কালিন জর্জেস্কু। আর তাতেই উঁকি দেয় এক শঙ্কার – যুদ্ধরত ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্ত থাকা এই প্রতিবেশী কি রুশবান্ধব হতে চলেছে। এরমধ্যে রোমানিয়ার সাংবিধানিক আদালত প্রথম দফার ফলাফলকে বাতিল ঘোষণা করেছেন। কারণ, হিসেবে বলা হয়েছে নির্বাচনে রাশিয়ার 'হস্তক্ষেপের কথা'। তবে মূল ঘটনা অন্যখানে। কালিন রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট হলে ইউরোপে রুশপন্থী রাজনৈতিক শক্তি বাড়ত। এরমধ্যেই হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়ায় রুশবান্ধব সরকার রয়েছে, তার সঙ্গে রোমানিয়াও যোগ হলে– এই তিনটি দেশ একসঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রাশিয়া বিরোধী ঐক্যে আরও ফাটল ধরাত।
যুদ্ধে বেকায়দায় আছে ইউক্রেন, এরমধ্যে প্রতিবেশী দেশের সরকার রুশবান্ধব হওয়া হতো কিয়েভের গলার কাঁটা। হয়তো এজন্যই ইইউ ও রোমানিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি কালিন জর্জেস্কুর ক্ষমতায় আরোহন ঠেকিয়েছে। সম্প্রতি কালিন স্কাই নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেছেন, ইইউ এবং রোমানিয়ার মাফিয়া আদালত তাঁর প্রেসিডেন্ট হওয়া ঠেকাতেই প্রথম দফার নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করেছে। নেপথ্য ঘটনা যাই হোক, রোমানিয়ায় ভোটারদের মধ্যে রাশিয়ার প্রতি বৈরিতা পোষণ না করার একটি মনোভাব স্পষ্ট হয়েছে। ইইউয়ের রুশবিরোধীতার নীতি আরও দুর্বল হতে পারে আসন্ন ২০২৫ সালে — যখন নির্বাচন হওয়ার কথা চেক প্রজাতন্ত্র, মলদোভায়; এবং বুলগেরিয়াতেও নির্বাচনের সম্ভাবনা আছে। এসব নির্বাচনেও রুশপন্থীরা নির্বাচিত হলে – ইইউয়ে বিদ্রোহী সদস্যের সংখ্যাই ভারী হবে।
রোমানিয়া, হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া – তিন দেশই ইইউ ও ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য, ইউক্রেনের দক্ষিণপশ্চিম সীমান্তে যাদের অবস্থান। কিয়েভের প্রতিরক্ষার জন্যও তারা অপরিহার্য। সুতরাং, এই দেশগুলোয় এমন সরকার থাকা উচিৎ – যারা যুদ্ধরত প্রতিবেশীকে সমর্থন জুগিয়ে যাবে। কিন্তু, তা নাকরে রাশিয়ার প্রতি শান্তির বার্তা দিয়ে ইউক্রেন ও ইইউকে শঙ্কায় ফেলেছে স্লোভাকিয়া। একইপথে হাঁটছে হাঙ্গেরিও। এই অবস্থায়, রোমানিয়াও একই নৌকার যাত্রী হলে– ব্রাসেলস উদ্বিগ্ন হওয়ারই কথা।
ইউক্রেন যুদ্ধ লড়ছে উত্তরপূর্বে। ইউক্রেনের যেকোনো রণকৌশলের সফলতার জন্য তার অন্য প্রান্তের সীমান্তের প্রতিবেশীদের সহায়তা দরকার। তারা ইউক্রেনের পশ্চাদভাগ আগলে রাখলে– তবেই ফ্রন্টলাইনে নির্ভার লড়তে পারবে ইউক্রেনীয়রা। তাছাড়া, এসব প্রতিবেশী দেশের মাধ্যমেই কিয়েভকে অস্ত্র, রসদ, গোয়েন্দা তথ্য ইত্যাদি সরবরাহ করে ন্যাটো মিত্ররা। তবে যুদ্ধ শুরুর দিকে ইউক্রেনকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেওয়ায়, সীমান্তে ছিল না কোনো কড়াকড়ি। ফলে ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের জায়গা দিতে হয়েছে। ইউক্রেনের বিপুল কৃষিপণ্যও রোমানিয়ার সীমান্ত দিয়ে রপ্তানি হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে, ইউক্রেনের ওদেসা ম্যাচিনকভ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ভলোদমির দুবাভিক বলেন, "আমি আশঙ্কা করছি, যদি ট্রাম্প (যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট) ইউক্রেনের হাল ছেড়ে দেন, এবং রাশিয়াকে ছাড় দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন – তাহলে এসব আদর্শিক মিত্ররা (রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরিসহ পূর্ব ইউরোপের কট্টর ডান ও রুশপন্থীরা) যারা ইউক্রেনকে ব্যাপক সহায়তা দেওয়ার সমালোচনা করে, তারা আরও উৎসাহ পাবে।" তিনি আরও বলেন, "তাঁরা যদি প্রবলবভাবে ইউক্রেনকে ত্রাণ দেওয়ার বিপক্ষে যায়, এবং রাশিয়ার দাবিগুলোর প্রতি সহানুভূতি দেখাতে থাকে – তাহলে ইউক্রেনপন্থী জোটের ঐক্য এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের সংগ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
হাঙ্গেরিকে নিয়ে ইইউ ও ইউক্রেনের মাথাব্যথা শুরু থেকেই। কারণ, দেশটির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দীর্ঘদিনের অনুরাগী। ইউরোপ যখন নিষেধাজ্ঞা দেয়, তারমধ্যেও তিনি রাশিয়া থেকে তেল, গ্যাস ও পারমাণবিক প্রযুক্তি কিনেছেন। মাঝে কিছু অনুষ্ঠানে তাঁকে মস্কোতে পুতিনের পাশেও দেখা গেছে। ওরবান সুযোগ পেলেই ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ইউক্রেনকে দেওয়া ত্রাণের অনুমোদন আটকে রাখতেও সচেষ্ট। ইউরোপে তিনি যেন রাশিয়ার প্রক্সি, ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য রাশিয়ার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রচেষ্টাকেও জটিল করছেন তিনি। এসব সম্পদ জব্দ করে সদস্য দেশগুলো ইউক্রেনকে যে সহায়তা দিচ্ছে – তা পরিশোধ দিতে চায় ইইউ।
গত জুলাইয়ে রুশ ও বেলারুশীয় নাগরিকদের জাতীয় কার্ড প্রদানের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেন ওরবান। এই কার্ড থাকলে তাঁরা নিরাপত্তা তল্লাশি ছাড়াই হাঙ্গেরিতে এসে কাজের সুযোগ পাবেন। ইইউয়ের ধারণা, রুশ গোয়েন্দাদের সুযোগ দিতেই এমন উদ্যোগ নেন ওরবান। সঙ্গেসঙ্গেই এ সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেন ইইউ কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, হাঙ্গেরির এমন অনুমতি প্রদানের কারণে রুশ নাগরিক অবাধে ইইউভুক্ত দেশগুলোয় যেতে পারবে। ফলে গুপ্তচরবৃত্তির অপারেশন, নাশকতা ও অন্যান্য হাইব্রিড যুদ্ধ কার্যক্রম চালাতে পারে তাঁরা। এভাবে ওরবান যেন একাই একশ' – ইইউ ও ন্যাটোর সমরযন্ত্রে বেয়ারা এক যন্ত্রাংশ, যা ঐক্যবদ্ধ আটলান্টিক ফ্রন্টে বিভেদের প্রাচীর তুলতে শুরু করেছে।
এরমধ্যে ২০২৩ সালে স্লোভাকিয়ার সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন রবার্ট ফিকো। ওরবানের মতো তিনিও ইউক্রেনের চেয়ে বেশি রাশিয়ার প্রতি সহমর্মিতা রাখেন। ফলে ইইউতে ওরবানের শক্তি আরও বাড়ে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় ফিকো বলেছিলেন, কিয়েভকে আরও সামরিক সহায়তা দিলে তা কেবল যুদ্ধকেই দীর্ঘায়িত করবে। তিনি ইউক্রেনকে আর একটি বুলেটও না পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পরে গেল বছরের নভেম্বরে তিনি দাবি করেছিলেন, 'ইউক্রেনে কোনো যুদ্ধ হচ্ছে না।'
২০২৫ সালের মস্কোতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে অংশ নিতে ফিকোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন পুতিন, যা তিনি গ্রহণও করেছেন। নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে বিজয় উদযাপনের এই দিনে তিনি পুতিনের পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর ইউক্রেনের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীকেও নব্য-নাৎসি শক্তি বলে দাবি করে ক্রেমলিন।
স্লোভাক ফরেন পলিসি অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ইভা মিচোকভা বলেন, "স্লাভ জাতীয়তাবাদ ও আমেরিকা-বিরোধিতার রাজনীতি করেন ফিকো। স্লোভাক সমাজে যার মূল অনেক গভীরে। তিনি দাবি করেন, পশ্চিমাবিশ্ব অন্যায়ভাবে পুতিনকে শয়তান হিসেবে উপস্থাপন করছে। ইউক্রেনকে যারা সামরিক সহায়তা দিচ্ছে তাঁরা যুদ্ধকামী, তাঁরা যুদ্ধকে প্রলম্বিত করতে চায়। পুতিনকে তোষণ করার মাধ্যমে স্লোভাক ভোটারদের এই সরকার দেখাতে চায়– তাঁরা পশ্চিমাবিরোধিতার সাহস রাখে, এবং রাজনৈতিক সুবিধা যতদিন থাকবে, এই সমর্থন তাঁরা দিয়ে যাবে।"
ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন থেকে সংক্ষেপিত ভাবানুবাদ: নূর মাজিদ