ট্রাম্পের গণ-নির্বাসন পরিকল্পনার লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন যেসব অভিবাসী
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী ২০ জানুয়ারি হোয়াইট হাউজের দায়িত্ব নেওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বা অস্থায়ী ভিত্তিতে বসবাসকারী লাখ লাখ অভিবাসীকে নির্বাসিত বা দেশ থেকে বিতাড়িত করার একটি বৃহৎ পরিকল্পনা চালু করতে চান। এই পদক্ষেপ পরিবারের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে এবং মার্কিন ব্যবসাগুলোকেও প্রভাবিত করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০২২ সালের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আনুমানিক ১১ মিলিয়ন অভিবাসী অবৈধভাবে বা অস্থায়ী ভিত্তিতে বসবাস করছিলেন। কিছু বিশ্লেষকের দাবি, এই সংখ্যা বর্তমানে ১৩ থেকে ১৪ মিলিয়ন পর্যন্ত পৌঁছেছে।
তবে, অস্থায়ী সুরক্ষা পাওয়া অভিবাসীরা এখনই বিতাড়িত হচ্ছেন না। আবার অনেক অভিবাসী এমন রাজ্যগুলোতে অবস্থান করছেন, যেখানে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ফেডারেল অভিবাসন কর্তৃপক্ষকে সীমিত সহায়তা দেয়।
যেসব রাজ্যে অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা বেশি
নিউ ইয়র্কের মাইগ্রেশন স্টাডিজ সেন্টারের একটি হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে প্রায় ২.২ মিলিয়ন অবৈধ অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে বসবাস করছিলেন।
১.৮ মিলিয়ন অবৈধ অভিবাসী নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল টেক্সাস। তার পরের অবস্থানে ছিল– ফ্লোরিডা (৯ লাখ ৩৬ হাজার), নিউ ইয়র্ক (৬ লাখ ৭২ হাজার), নিউ জার্সি (৪ লাখ ৯৫ হাজার) এবং ইলিনয় (৪ লাখ ২৯ হাজার)।
ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি এবং ইলিনয় রাজ্যগুলোতে ডেমোক্র্যাটদের আধিপত্য বেশি। ইমিগ্র্যান্ট লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, এই চারটি রাজ্যসহ যুক্তরাষ্ট্রের মোট ১১টি রাজ্যে "পবিত্র" আইন বা নীতি রয়েছে। এই আইন ফেডারেল অভিবাসন কার্যক্রমের সাথে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা সীমিত করে।
মাইগ্রেশন সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসকারী অভিবাসীদের প্রায় ৪৪ শতাংশ এসব "পবিত্র" রাজ্যে ছিলেন।
যেসব জায়গা থেকে অবৈধ অভিবাসীরা বেশি আসেন
যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি দপ্তর (ডিএইচএস) থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসকারী ১১ মিলিয়ন অভিবাসীর মধ্যে ৪.৮ মিলিয়ন অভিবাসী মেক্সিকো থেকে এসেছিলেন।
অন্যান্য শীর্ষ দেশগুলো ছিল– গুয়াতেমালা, এল সালভাদর এবং হন্ডুরাস।
ডিএইচএস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে কিউবা, হাইতি, নিকারাগুয়া এবং ভেনেজুয়েলার প্রায় ২ মিলিয়ন অভিবাসী অবৈধভাবে সীমান্ত পার হওয়ার সময় আটক হন অথবা বাইডেন সরকারের মানবিক প্রোগ্রামের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি পান।
ট্রাম্প বাইডেনের এসব প্রোগ্রাম শেষ করার পরিকল্পনা করেছেন। এর মধ্যে একটি প্রোগ্রাম রয়েছে, যেটি মার্কিন স্পন্সরের মাধ্যমে অভিবাসীদের প্রবেশের অনুমতি দেয় এবং অন্যটি মেক্সিকোতে অবস্থানরত অভিবাসীদের একটি অ্যাপ ব্যবহার করে বৈধ সীমান্ত ক্রসিংয়ের মাধ্যমে প্রবেশের সুযোগ দেয়।
যেসব জায়গায় অবৈধ অভিবাসীরা বেশি কাজ করেন
ডিএইচএ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসকারী অভিবাসীদের বৃহত্তম অংশই কর্মক্ষম বয়সী ছিলেন। ১১ মিলিয়ন অভিবাসীর মধ্যে প্রায় ৮.৭ মিলিয়ন ছিলেন ১৮ থেকে ৫৪ বছর বয়সী।
কৃষক সংগঠনগুলো ট্রাম্পের কাছে তাদের শ্রমিকদের বিতাড়িত না করতে আবেদন জানিয়েছে। তাদের দাবি, এসব শ্রমিককে বিতাড়িত করলে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে যাবে।
নিউ ইয়র্কের মাইগ্রেশন স্টাডিজ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মোট ২ লাখ ৮৩ হাজার অবৈধ অভিবাসী কৃষি শ্রমিকের কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে বসবাস করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হিসাব অনুযায়ী, এই সংখ্যা প্রায় ১ মিলিয়ন হতে পারে।
কতজন আমেরিকান "মিক্সড-স্ট্যাটাস হাউসহোল্ড" এ বাস করেন?
ইমিগ্রেশন সমর্থক গ্রুপ এফডাব্লিউডি.ইউএস ধারণা করছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসকারী বা অস্থায়ী সুরক্ষা প্রাপ্ত অভিবাসীর সংখ্যা ১৪.৫ মিলিয়ন হবে।
এদের মধ্যে ১০.১ মিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বা স্থায়ী বাসিন্দার সঙ্গে "মিক্সড-স্ট্যাটাস হাউসহোল্ড" এ বসবাস করছেন।
মিক্সড-স্ট্যাটাস হাউসহোল্ড বলতে এমন একটি পরিবার বা গৃহস্থালিকে বোঝায়, যেখানে কিছু সদস্য বৈধ মার্কিন নাগরিক বা স্থায়ী বাসিন্দা (গ্রিনকার্ড ধারী) এবং কিছু সদস্য অবৈধ অভিবাসী বা অস্থায়ী সুরক্ষা প্রাপ্ত।
বড় মাত্রায় অভিবাসীদের বিতাড়িত করলে মার্কিন পরিবারগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি হতে পারে এবং এটি অনেক মার্কিন নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দাকে প্রভাবিত করতে পারে।
সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে এফডাব্লিউডি.ইউএস-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কমপক্ষে ৫.১ মিলিয়ন মার্কিন নাগরিক শিশু অবৈধ অভিবাসী বাবা-মায়ের সঙ্গে বসবাস করছে।
এই পরিবারগুলোকে হয়ত অন্য দেশে স্থানান্তরিত হতে হবে অথবা তারা আলাদা হয়ে যেতে পারে।
অবৈধ অভিবাসীরা কত বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন?
নিউ ইয়র্কের মাইগ্রেশন স্টাডিজ সেন্টারের ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসকারী ৫৪ শতাংশ অভিবাসী ১০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশটিতে ছিলেন।
প্রায় ২৫ শতাংশ অভিবাসী দেশটিতে পাঁচ বছরের কম সময় ধরে বসবাস করছেন।
কতজন অভিবাসীর বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বৈধতা নেই?
যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি (ডিএইচএস), নিউ ইয়র্কের মাইগ্রেশন স্টাডিজ সেন্টার এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবী প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাবে, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১১ মিলিয়ন অভিবাসীর বৈধতা ছিল না অথবা অস্থায়ী মানবিক সুরক্ষা ছিল।
ডিএইচএস-এর কার্যক্রম ও প্রবেশ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের পর আরও ৫ মিলিয়নের মতো অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন বা অস্থায়ী মানবিক সুরক্ষা পেয়েছেন।
তবে, কিছু অভিবাসী ইতোমধ্যে বিতাড়িত হয়েছেন, স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে গেছেন, বৈধতা পেয়েছেন বা মারা গেছেন। সবার তথ্য অন্তর্ভুক্ত করে এখন পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ সংখ্যা পাওয়া যায়নি।
অস্থায়ী সুরক্ষা পাওয়া ব্যক্তিরা কি এই হিসাবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত?
যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসকারী অভিবাসীদের হিসাবের মধ্যে তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয় যারা অস্থায়ী মানবিক সুরক্ষা পান, অর্থাৎ যারা অবিলম্বে বিতাড়িত হবেন না।
এদের মধ্যে রয়েছেন ১.১ মিলিয়ন মানুষ যারা টেম্পোরারি প্রোটেকটেড স্ট্যাটাস (টিপিএস)-এর (অস্থায়ী সুরক্ষা অবস্থা) আওতায় আছেন। এই সুরক্ষা তাদেরকে তাদের দেশে সশস্ত্র সংঘর্ষ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা অন্য কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে থাকার অনুমতি দেয় এবং কাজের অনুমতিও দেয়।
টিপিএস সাধারণত ৬ থেকে ১৮ মাস মেয়াদি হয়। তবে তা পুনর্নবায়নের মাধ্যমে অব্যাহত থাকতে পারে। ট্রাম্প তার প্রশাসনে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বেশিরভাগ টিপিএস রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আদালত সেটি আটকে দেন।
ট্রাম্প আশা করছেন, সুরক্ষা মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে তিনি টিপিএস বন্ধ করার চেষ্টা করবেন। তবে এটি আইনি লড়াইয়ের মুখে পড়তে পারে।
আরেকটি প্রোগ্রাম ডেফারড এনফোর্সড ডিপারচার বা ডিইএ (বিতাড়ন স্থগিত সিদ্ধান্ত) প্রোগ্রামের আওতায় হাজার হাজার মানুষ আছেন, যেটি ট্রাম্প আবার অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন।
এছাড়া, ডেফারড অ্যাকশন ফর চাইল্ডহুড অ্যারাইভালস বা ডিএসিএ (শিশুকালে আগমনের জন্য স্থগিত সিদ্ধান্ত) প্রোগ্রামের আওতায় ৫ লাখ ৩৫ হাজার "ড্রিমার" বা অভিবাসী শিশু অবস্থায় অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। তারা বিতাড়ন থেকে মুক্তি এবং কাজের অনুমতি পান।
ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে ডিএসিএ বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করে দেন। তিনি আবার ডিএসিএ বন্ধ করার চেষ্টা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তবে সম্প্রতি তিনি বলেছেন, "ড্রিমার"দের সুরক্ষার জন্য তিনি একটি চুক্তিতে যেতে প্রস্তুত।
টেক্সাস রাজ্য বর্তমানে ডিএসিএ প্রোগ্রামের বিরুদ্ধে একটি মামলা পরিচালনা করছে। এটি ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর আবারও সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারে।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়