পাখির আঘাতেই কি দক্ষিণ কোরিয়ার বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে?
গত রোববার (২৯ ডিসেম্বর) ১৮১ আরোহী নিয়ে বিধ্বস্ত হয় দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু এয়ারলাইন্স। বিমানটি থাইল্যান্ডের ব্যাংকক থেকে ফিরছিল। দুর্ঘটনায় ১৭৯ জন মারা গেছেন। দুজন ক্রুকে ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনার কারণ তদন্ত করছে। বিমানটি অবতরণের ঠিক আগে, বিমান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে বার্ড স্ট্রাইক বা পাখির আঘাতের সতর্কতা দেওয়া হয়েছিল।
তবে তদন্তের মাধ্যমেই বোঝা যাবে, পাখির আঘাতের কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে কি না, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে।
পাখির আঘাত কী?
পাখির আঘাত বলতে মূলত পাখির সাথে বিমানের সংঘর্ষকে বোঝায়। এটি বিমানের জন্য বিপজ্জনক, কারণ পাখি ইঞ্জিনে ঢুকে গেলে জেট ইঞ্জিন শক্তি হারাতে পারে।
পাখির আঘাত খুব সাধারণ একটি ঘটনা। যুক্তরাজ্যে ২০২২ সালে ১,৪০০ এর বেশি বার্ড স্ট্রাইক-এর (পাখির আঘাত) রিপোর্ট হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১০০টি ঘটনা বিমানকে প্রভাবিত করেছে বলে জানিয়েছে দেশটির সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি।
কিউকিউ বিশ্ববিদ্যালয়ে এভিয়েশন বিষয়ের অধ্যাপক ডাগ ড্রুরি এ বছর 'দ্য কনভার্সেশন'-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে লেখেন, বোয়িং বিমানগুলোর টারবোফ্যান ইঞ্জিন রয়েছে, যা পাখির আঘাতে গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
পাখির আঘাত কতটা বিপজ্জনক হতে পারে?
পাখির ধাক্কা সাধারণত বিমানের মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হয় না।
যদি পাখি ইঞ্জিনে ঢুকে যায়, তাহলে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে পাইলটরা সাধারণত সময়মতো বিষয়টি সামলে নিয়ে জরুরি অবতরণ করতে পারেন।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাগ ড্রুরির মতে, পাইলটরা সকালে বা সন্ধ্যায় বিশেষভাবে সতর্ক থাকেন, কারণ এই সময় পাখিরা বেশি সক্রিয় থাকে।
তবে পাখির ধাক্কায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা অতীতে ঘটেছে।
১৯৮৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বিমান ও বন্যপ্রাণীর সংঘর্ষে ৭৬ জন মারা গেছে বলে ফেডারেল এভিয়েশন প্রশাসন জানিয়েছে।
উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা ঘটে ১৯৯৫ সালে আলাস্কার এক বিমান ঘাঁটির কাছে। কানাডা ও আমেরিকার ২৪ জন বিমানসেনা একটি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। এটি একটি হাঁসের ঝাঁকের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে হয়েছিল।
সবচেয়ে পরিচিত পাখির আঘাতের ঘটনা ঘটেছিল ২০০৯ সালে। তখন একটি এয়ারবাস বিমানের সাথে রাজহাঁসের একটি ঝাঁকের সংঘর্ষ হলে সেটি নিউইয়র্কের হাডসন নদীতে জরুরি অবতরণ করে। এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
এই ঘটনা ২০১৬ সালের 'সালি' সিনেমাতে তুলে ধরা হয়, যেখানে টম হ্যাঙ্কস পাইলট চেসলি "সালি" সুলেনবার্গারের চরিত্রে অভিনয় করেন।
পাখির আঘাতেই কি বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে?
দক্ষিণ কোরিয়ার ফ্লাইট ৭সি২১১৬ বোয়িং ৭৩৭-৮০০ বিমান দুর্ঘটনা পাখির সাথেই সংঘর্ষের কারণে হয়েছিল কি না, কর্তৃপক্ষ তা এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি।
তবে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, বিমানের ভেতরে থাকা একজন যাত্রী তার আত্মীয়কে মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন, একটি পাখি বিমানের "পাখার মধ্যে আটকা পড়েছে" এবং সেটি অবতরণ করতে পারছিল না।
মুয়ান ফায়ার ডিপার্টমেন্টের প্রধান লি জিওং-হিউন জানিয়েছেন, পাখির ধাক্কা এবং খারাপ আবহাওয়ার কারণে এ দুর্ঘটনা হতে পারে। তবে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ এখনও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
অভিজ্ঞ পাইলট এবং বিমান বিশেষজ্ঞ ক্রিস কিংসউড, যিনি একই ধরনের বিমানে ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে চালিয়েছেন বলেন, ভিডিও ফুটেজ থেকে ঘটনাটির সঠিক কারণ স্পষ্ট নয়।
তিনি আরও জানান, বিমানটির ল্যান্ডিং গিয়ার ছিল না [অবতরণের সময় ল্যান্ডিং গিয়ার খোলা হয়নি] এবং ফ্ল্যাপগুলো স্বাভাবিক নিয়মে ব্যবহার করা হয়নি। এর অর্থ, "সবকিছু খুব দ্রুত ঘটেছে।"
তিনি বলেন, "এমন পরিস্থিতি তখনই তৈরি হয়, যদি দুটি ইঞ্জিনই বিকল হয়ে যায়। একটি ইঞ্জিনের মাধ্যমেও একটি যাত্রীবাহী বিমান নিরাপদে উড়তে পারে।"
তিনি যোগ করেন, যদি পাখির সঙ্গে সংঘর্ষে দুটি ইঞ্জিনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে উচ্চতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কম উচ্চতায় পাইলটকে "খুব অল্প সময়ে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিতে হয়।"
তিনি আরও বলেন, ইঞ্জিন বিকল হলেও অবতরণ গিয়ার এবং ফ্ল্যাপ চালানোর বিকল্প ব্যবস্থা আছে।
কিংসউড বলেন, "যদি বিমানটি কম উচ্চতায় থাকে, মাত্র কয়েক হাজার ফুট, তখন তাদের প্রধান লক্ষ্য হবে বিমানটি উড়িয়ে নিরাপদ জায়গায় নামানো।"
অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, শুধু পাখির সঙ্গে সংঘর্ষ কি দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে?
এয়ারলাইন নিউজের সম্পাদক জেফরি থমাস বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন,"সাধারণত, পাখির আঘাত একাই একটি বিমান ধ্বংস করতে পারে না।"
অস্ট্রেলিয়ার বিমান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জেফরি ডেল রয়টার্সকে বলেন, "আমি কখনোই এমন একটি পাখির আঘাত দেখিনি, যা ল্যান্ডিং গিয়ার খুলতে বাধা দিয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, যদি একাধিক পাখি ইঞ্জিনে ঢুকে পড়ে, তাহলে এটি ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা কমাতে পারে। তবে ইঞ্জিন সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে যাবে না। ফলে পাইলটদের হাতে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সময় থাকে।