রোগীর ক্যান্সার অপারেশন করতে গিয়ে চিকিৎসক নিজেই সংক্রমিত হলেন
রোগীর ক্যান্সার অপারেশন করতে গিয়ে ভুলবশত নিজের মধ্যেই ক্যান্সার 'প্রতিস্থাপন' করেছেন একজন সার্জন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটিকে প্রথমবার ঘটা একটি বিরল ঘটনা বলে মনে করা হচ্ছে।
জার্মানির ৩২ বছর বয়সী এক ব্যক্তি এক বিরল ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। তার পেটের টিউমার অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচার হচ্ছিল। অপারেশনের সময় ডাক্তার ভুলবশত নিজের হাতে কেটে ফেলেন। তবে দ্রুত ক্ষতটি জীবাণুমুক্ত করা হয় এবং ব্যান্ডেজ করা হয়।
তবে পাঁচ মাস পর ৫৩ বছর বয়সী ওই ডাক্তার লক্ষ্য করেন, যেখানে তিনি আগে কেটে ফেলেছিলেন সেখানে একটি ছোট মাংসপিণ্ড গজাতে শুরু করেছে এবং তিনি চিকিৎসা নিতে যান।
মাংসপিণ্ডটি একটি ম্যালিগন্যান্ট টিউমার ছিল এবং পরীক্ষায় এটি তার পূর্ববর্তী রোগীর ক্যান্সারের সাথে জেনেটিকভাবে মিলে যায়।
এতে চিকিৎসকরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান, টিউমারের কোষগুলো কেটে যাওয়ার জায়গা দিয়ে ঢুকে ডাক্তারকেও ক্যান্সার সংক্রমিত করেছে।
এই ঘটনার বিষয়ে কেস রিপোর্টের লেখকরা বলেন, এটি একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, কারণ সাধারণ ট্রান্সপ্লান্টে শরীর বিদেশি টিস্যুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করে এবং প্রত্যাখ্যান করে। তারা আশা করেছিলেন, ডাক্তারের শরীরও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবে।
তবে, টিউমারের বৃদ্ধি এবং বিকাশ দেখে মনে হচ্ছে, ডাক্তারের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে অকার্যকর ছিল।
এই কেসটি প্রথম ১৯৯৬ সালে রিপোর্ট করা হয়েছিল। তবে, এখন এটি নিয়ে নতুন করে আলোচনা হচ্ছে।
'দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন'-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে চিকিৎসকরা রোগীর ম্যালিগন্যান্ট ফাইব্রাস হিসটিওসাইটোমা (একটি বিরল ধরনের ক্যান্সার) 'অ্যাক্সিডেন্টাল ট্রান্সপ্লানটেশন'-এর [ভুলবশত প্রতিস্থাপিত হওয়া] বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। এই ক্যান্সারটি নরম টিস্যুর মধ্যে তৈরি হয় এবং প্রতি বছর মাত্র ১ হাজার ৪০০ জনের মধ্যে এটি ধরা পড়ে।
ওই ডাক্তার রোগীর পেট থেকে ক্যান্সার অপসারণের সময় ড্রেনেজ টিউব বসানোর চেষ্টা করতে গিয়ে তার বাম হাতের তালুতে আঘাত পান। তবে ক্ষতটি দ্রুত জীবাণুমুক্ত করা হয় এবং ব্যান্ডেজ করা হয়।
রোগীর প্রথম অস্ত্রোপচার সফল হলেও, পরে অপারেশনের জটিলতায় তার মৃত্যু হয়।
পাঁচ মাস পর ডাক্তারের বাম হাতের মধ্যমা আঙুলের গোড়ায় ১.২ ইঞ্চি দীর্ঘ এক 'টিউমার সদৃশ মাংসপিণ্ড' দেখা দেয় এবং তিনি এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যান।
একটি বিস্তৃত পরীক্ষা চালানো হয়, যার মধ্যে বিভিন্ন ল্যাবরেটরি ও রক্ত পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে, কোন অস্বাভাবিকতা পাওয়া যায়নি।
টিউমারটি অপসারণ করা হয় এবং মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করে দেখা যায়, এটি ছিল একটি ম্যালিগন্যান্ট ফাইব্রাস হিসটিওসাইটোমা।
রোগী এবং ডাক্তারকে চিকিৎসা দেওয়া ওই চিকিৎসক প্রশ্ন উত্থাপন করেন, টিউমার দুটি কি একে অপরের সাথে সম্পর্কিত ছিল কি না। দুটি টিউমারের নমুনা আরও বিশ্লেষণ করা হয় এবং দেখা যায়, সেগুলো 'একই রকম' ছিল।
সেগুলোর কোষের ধরন ও কোষের গঠন ছিল অভিন্ন। অর্থাৎ চিকিৎসক সম্ভবত অজান্তে রোগীর ক্যান্সার কোষ নিজের হাতের ক্ষতে স্থানান্তরিত করেছিলেন। ফলে রোগটি তার শরীরে জায়গা করে নেয় এবং বাড়তে থাকে।
লেখকরা বলেন, "সাধারণভাবে এক জনের শরীর থেকে অন্য জনের শরীরে টিস্যু স্থানান্তরিত হলে একটি প্রতিরোধী প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, যার ফলে প্রতিস্থাপিত টিস্যুটি প্রত্যাখ্যাত হয়।"
তারা আরও বলেন, "ডাক্তারের ক্ষেত্রে টিউমারের চারপাশে তীব্র প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া তৈরি হলেও, টিউমারের আকার বাড়তে থাকে, যা নির্দেশ করে তার শরীরের অ্যান্টি-টিউমার প্রতিরোধ ব্যবস্থা কার্যকর ছিল না।"
লেখকরা অনুমান করেন, টিউমারটি 'কিছু পরিবর্তন' ঘটিয়ে ইমিউন সিস্টেম [রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা] থেকে বাঁচতে সক্ষম হয়েছিল। এসব পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে– কোষের অণুতে পরিবর্তন এবং শরীরের সঠিকভাবে ক্যান্সার কোষ শনাক্ত ও আক্রমণ করতে ব্যর্থ হওয়া।
দুই বছর পর যখন ডাক্তার তার টিউমারটি অপসারণ করেন, তখন ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার বা ফিরে আসার কোন লক্ষণ পাওয়া যায়নি।
চিকিৎসকরা এই কেসটিকে আকর্ষণীয় মনে করেছেন, কারণ সাধারণত প্রতিস্থাপিত টিস্যু হোস্ট দেহের টিস্যুর থেকে আলাদা হওয়ায় ইমিউন সিস্টেম এটি ধ্বংস করার চেষ্টা করে।
এ কারণেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গ্রহণকারীদের ইমিউনোসাপ্রেসিভ ওষুধ সেবন করতে হয়, যাতে তাদের শরীর প্রতিস্থাপিত অঙ্গকে প্রত্যাখ্যান না করে।
তবে, চিকিৎসকের কেটে যাওয়া স্থানে প্রদাহ তৈরি হলেও তার ইমিউন সিস্টেম টিউমারের বৃদ্ধি থামাতে ব্যর্থ হয়।
ডাক্তারের সাথে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা অত্যন্ত বিরল এবং 'প্রতিস্থাপিত' ক্যান্সার নিয়ে কোনো পরিসংখ্যান নেই।
২০১৩ সালে "কোল্ড স্প্রিং হারবার পার্সপেক্টিভস ইন মেডিসিন"-এ প্রকাশিত একটি পর্যালোচনায় বলা হয়, দাতা থেকে গ্রহীতার মধ্যে ক্যান্সার সংক্রমণের ঝুঁকি নির্ধারণ করা যায়নি এবং এ বিষয়ে তথ্যও খুব সীমিত।
লেখকরা উল্লেখ করেন: "ক্যান্সার সংক্রমণের ঘটনা এতটাই বিরল যে, বিচ্ছিন্ন কেস রিপোর্টই প্রধান তথ্যসূত্র।"
১৯৭০-এর দশকের তথ্য বিশ্লেষণ করে ১৯৯৩ সালের আরেকটি পর্যালোচনায়ও দেখা যায়, অঙ্গ দান করার মাধ্যমে ক্যান্সার সংক্রমণের ঘটনা কেবল বিচ্ছিন্ন প্রতিবেদনেই সীমাবদ্ধ ছিল।
২০১৩ সালের পর্যালোচনায় আরও বলা হয়: "কম ঘটনা এবং ক্যান্সারের বিভিন্ন অবস্থার কারণে সুনির্দিষ্ট ঝুঁকি হিসাব করা অসম্ভব।"
তবে লেখকরা মনে করেন, এই তথ্য প্রকৃত সংক্রমণের হারকে কম দেখাতে পারে।
প্রাপ্ত সীমিত তথ্য অনুযায়ী, অন্তত একবার হলেও যে ক্যান্সারগুলো দাতা থেকে গ্রহীতার দেহে সংক্রমিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে স্তন ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সার, ফুসফুস ক্যান্সার, মেলানোমা, ওভারি ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার এবং কিডনি ক্যান্সার।