জার্মান অর্থনীতিকে ভাঙ্গনের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন পুতিন
আপনার ঘরে জ্বালানি না থাকলে আনাজ থেকেও লাভ নেই—হবে না কোনো রান্না। জ্বালানি পুড়িয়ে উৎপাদকরা যদি আবার বিদ্যুৎ সরবরাহ না করতে পারে—তাহলে ধস নামে ব্যবসা-বাণিজ্যেও। একটি দেশের জ্বালানি সংকটের কথা তখনই বলা হয় যখন সর্বময় একটি দুর্দশার মধ্যে পড়ে বা সেদিকে এগোতে থাকে দেশটি।
সেই অশনি ভবিষ্যতের বার্তাই দেওয়া হচ্ছে জার্মান অর্থনীতিকে নিয়ে। রূপক অর্থেই ব্লুমবার্গ বলেছে, কয়েক দশক ধরে কোনো রকম বিঘ্ন ছাড়াই সচল রয়েছে জার্মানির কিছু শিল্পের চিমনি। হঠাৎ তাদের আগুন নিভলে তরল ধাতু কঠিন রুপ নেবে আর তাতে ভঙ্গুর হবে উৎপাদন ব্যবস্থা।
ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতিকে নজিরবিহীন জ্বালানি ঘাটতির এমন উদ্বেগই ঘিরে ধরেছে। রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ কমলে অর্থনীতি মারাত্মক প্রভাবিত হবে এ ধারণার ভিত্তি দৃঢ় ছিল না এর আগে। কিন্তু সেই অশনি দশায় পড়ার ঝুঁকি দিন দিন বাস্তব হয়ে উঠছে।
ইউক্রেনকে অস্ত্র, প্রযুক্তি, অর্থ সব রকমের সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে ইউরোপিয় ইউনিয়ন। জার্মানি প্রভাবশালী ইইউ সদস্য এবং কিয়েভের উদার সমর্থক। একারণে শাস্তি হিসেবে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের প্রধান সংযোগে ৬০ শতাংশ গ্যাস প্রবাহ কমিয়েছেন রাশিয়া প্রেসিডেন্ট। পুতিনের এই পদক্ষেপের পর সম্ভাব্য পরিণতিগুলো অনুমান করেছেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের প্রশাসনের বিশেষজ্ঞরা। অনুমানগুলির কোনোটিতেই আগামী শীতকাল পাড়ি দেওয়ার মতো মজুদ থাকবে এমন ভরসা মেলেনি।
জার্মানি গ্যাস সরবরাহ নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেনেৎজ-এ। এর প্রধান ক্লাউস মুলার গত শুক্রবার ডয়েচল্যান্ডফুঙ্ক রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, "পরিণতিগুলি জানার মুহূর্ত ছিল দুঃখজনক। এবার যদি হিম শীতের প্রকোপ বেশি হয়, আর ঘর গরম রাখতে আমরা উদারভাবে গ্যাস পোড়াতে থাকি—তাহলে শেষে অনুতাপ করতে হবে।"
মন্দা, তীব্র শীতে ঠান্ডায় কাতর মানুষ ও কলকারখানায় তালা ঝোলা শুধু নয়, ঝুঁকির গণ্ডি আরও সুদূরপ্রসারী। কারণ গত কয়েক দশক ধরে সস্তায় রাশিয়া থেকে গ্যাস কিনে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে জার্মানি। চালিয়ে গেছে ব্যাপক উৎপাদন, বিকাশ হয়েছে সেবা খাতে। স্বাভাবিক সময় হলে এখন হয়তো রাশিয়া থেকে গ্যাস কিনতে আরেকটি পাইপলাইন স্থাপনে মস্কোর সাথে উদ্যোগ নিত বার্লিন। ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে যখন আরও বেশি বেশি জ্বালানি দরকার-তখনই যোগান কমাল রাশিয়া।
স্বাভাবিক সময় হলে এখন হয়তো রাশিয়া থেকে গ্যাস কিনতে আরেকটি পাইপলাইন স্থাপনে মস্কোর সাথে উদ্যোগ নিত বার্লিন। ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া ও পশ্চিমাদের বৈরিতায় তিরোধান হয়েছে সহযোগিতার সে যুগের। ভক্সওয়াগন এজি থেকে শুরু করে বিএএসএফ এর মতন বৃহৎ কোম্পানিগুলোকে এখন নতুন বাস্তবতার সাথে মানিয়ে চলতে হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস ছিল জার্মানির বড় উৎস। এর সংকট মোকাবিলার তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাপকহারে পরিবেশ দূষণকারী কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো এবং শিল্পোৎপাদনে ভিন্ন ধরনের জ্বালানি ব্যবহারের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। বিকল্প এ ধরনের জ্বালানি আসলে নবায়নযোগ্য উৎসের; তবে নির্ভরযোগ্য পরিমাণে এসব উৎপাদনে আরও অনেক বছর লাগতে পারে।
জার্মানিতে যেসব প্রতিষ্ঠান ধাতু, কাগজ ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদন করছে তাদেরকে এর ফলে দেশটিতে তাদের উৎপাদন কেন্দ্রের আকার ছোট করা বা হয়তো বন্ধও করতে দিতে হতে পারে। উৎপাদন খাতের এই চাকরিহীনতা দেশটির অর্থনৈতিক মানচিত্রে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির ছাপ রেখে যাবে।
জ্বালানি পরামর্শক গ্রুপ জিএমবিএইচ- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক উলফগ্যাং হানের মতে, " প্রতিযোগী মূল্যে যে দেশে পাইপলাইনের গ্যাস মিলবে- সেখানেই উৎপাদন কেন্দ্র সরিয়ে নেবে কোম্পানিগুলি। নিশ্চিতভাবে বোঝা যাচ্ছে জার্মানি থেকে তারা চলে যাবে। আসলে ২০ বছরের নীতিনির্ধারণী ভুল এক বা দুই বছরে সংশোধন করা যায় না"- মন্তব্য করেন তিনি।
আগামী নভেম্বরে গ্যাস রিজার্ভের ঘাটতি ৯০ শতাংশ পূরণে র লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে জার্মান সরকারের।এতে লাগবে ১১৫ দিন সময়। গ্যাসের প্রবাহ যদি বর্তমান মাত্রায় থাকে কেবল তাহলেই এ লক্ষ্যপূরণ সম্ভব। কিন্তু, ক্রেমলিন যেভাবে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমাদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার পাল্টা পদক্ষেপ নিচ্ছে—তাতে এ সম্ভাবনা একেবারেই কম।