রাশিয়ার বৈদেশিক ঋণ খেলাপির পরিণাম কী হবে?
১৯১৭ সালের বলেশেভিক বিপ্লবের পর এই প্রথমবারের মতো বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হতে চলেছে রাশিয়া। ইউক্রেনে আক্রমণ করায় রাশিয়ার ওপর দেওয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এভাবে দেশটিকে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে।
আসলে গত ২৭ মে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের সময় পেরোয় মস্কোর। তবে এর গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে আরও ৩০ দিনের, যা আগামী রোববার রাতে পেরিয়ে যাবে। ওইদিনের মধ্যে পরিশোধ না করলেই খেলাপি হবে রাশিয়া। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে খেলাপিকরণ নিশ্চিত করতে আরও সময় লাগবে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক-ভিত্তিক সার্বভৌম ঋণ বিষয়ক আইনজীবী জে এস ওসল্যান্ডার বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, "রাতারাতি জাদুকরি কিছু ঘটার সম্ভাবনাও রয়েছে। রাশিয়া হয়তো নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও কোনো আর্থিক সংস্থা বা বন্ড ক্রয়কারীদের ঋণ পরিশোধের অর্থ যোগাড় করতে পারবে। তবে কেউই তার ওপর বাজি ধরছেন না।"
"সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হলো তারা এই অর্থ যোগাড় করতে পারবে না, কারণ আন্তর্জাতিক কোনো ব্যাংক রাশিয়া থেকে আসা অর্থ পাওনাদারদের কাছে পৌঁছে দিতে রাজি হবে না।"
গত মাসে আমেরিকান ব্যাংকগুলির মাধ্যমে রাশিয়ার আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের শত শত কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ বন্ধ করে দেয় মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়।
এর প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, এখন থেকে ডলার-নির্ভর ঋণ রুবলে পরিশোধ করা হবে এবং তা পরে প্রকৃত মুদ্রায় (ডলারে) রুপান্তরিত করার সুযোগ দেওয়া হবে।"
অর্থাৎ, রুবলে ঋণের সুদ পাবার পর তা রাশিয়ান ব্যাংক থেকে ডলারে রুপান্তর করে নিতে পারবেন বন্ডে বিনিয়োগকারীরা।
রাশিয়ার কাছে ঋণ পরিশোধের অর্থ রয়েছে। কিন্তু, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় বিদেশে রাখা রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের বড় অংশ ফ্রিজ করা হয়েছে। তাই যেকোনো খেলাপিকে কৃত্রিম বলছে মস্কো।
গত মাসে রাশিয়ার অর্থমন্ত্রী অ্যান্টন সিলুয়ানোভ বলেন, "আমাদের হাতে অর্থ (ঋণ পরিশোধের) আছে এবং আমরা তা দিতেও প্রস্তুত। বিরূপ ভাবাপন্ন একটি দেশ এই পরিস্থিতি কৃত্রিমভাবে তৈরি করেছে। এতে রাশিয়ান নাগরিকদের জীবনমানে কোনো প্রভাব পড়বে না।"
লন্ডন-ভিত্তিক ব্লু –বে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ইউরোপের বৃহত্তম ঋণের নিশ্চিত আয় ব্যবস্থাপক সংস্থা। এর উদীয়মান বাজারের সার্বভৌম দেনা বিশ্লেষক টিম অ্যাশ এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, এই খেলাপি স্পষ্টভাবেই রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ইউক্রেনে আগ্রাসনে চালানোয় যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা রাশিয়াকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বাধা দিচ্ছে।
রাশিয়ার খেলাপি হওয়ার বিষয়ে মূল যে বিষয়গুলি জানা দরকার:
রাশিয়ার বৈদেশিক দেনার পরিমাণ কত?
বন্ড বিক্রি করে ৪ হাজার কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে মস্কো, যার অর্ধেক কিনেছে বিদেশিরা। যুদ্ধ শুরুর আগে স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রায় রাশিয়ার মোট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৪ হাজার কোটি ডলার। এর বহুলাংশ রাখা ছিল বিদেশে, যা এখন ফ্রিজ করা হয়েছে।
এক শতাব্দী আগে বলিশেভিক বিপ্লবের পর থেকে আর কখনো আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি রাশিয়া। বলিশেভিক বিপ্লব যে আমূল রাজনৈতিক পটপরিবর্তন করে তাতেই ঋণ খেলাপের ঘটনা ঘটে। ওই সময়ে পতন ঘটে রুশ সাম্রাজ্যের আর গঠিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৯০ এর দশকের শেষদিকে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া ঋণে খেলাপি হয়েছিল রুশ সরকার। তবে আন্তর্জাতিক সহায়তায় পরে তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়।
রাশিয়ার খেলাপি হওয়ার অনুমান গত কয়েক মাস ধরে করে আসছেন বিনিয়োগকারীরা। একারণে রাশিয়ার দেনার বিপরীতে করা বিমা চুক্তির মূল্য কয়েক সপ্তাহ ধরে ৮০ শতাংশ বেড়েছে। এমনকী স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পোর এবং মুডিস- এর মতো রেটিংস সংস্থা দেশটির ঋণকে বাতিল বা অলাভজনকের ঘরে রেখেছে।
একটি দেশের খেলাপি হওয়া কীভাবে বুঝবেন?
আন্তর্জাতিক রেটিংস এজেন্সিগুলি দেনা পরিশোধে ব্যর্থতাকে খেলাপির ঘরে নামিয়ে দেখাতে পারে, অথবা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে কোনো আদালত। 'ক্রেডিট ডিফল্ট সোয়াপ' নামে খেলাপি ঋণ অদল-বদলের চুক্তি থাকে বন্ড মালিকদের, এটি আসলে খেলাপির বিরুদ্ধে এক ধরনের বিমা পলিসি। এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে খেলাপি ঘোষিত না হওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ করা হবে কিনা তা নির্ধারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের একটি কমিটিকে বিবেচনার সুপারিশ করা হয়।
এমন একটি আন্তর্জাতিক কমিটি হচ্ছে 'ক্রেডিট ডিফল্ট ডিটারমিনেশন কমিটি' বা ঋণ খেলাপি নির্ধারক কমিটি। এটি বৃহৎ ব্যাংক ও বিনিয়োগ তহবিলগুলির একটি আর্থিক শিল্প জোট। গত ৭ জুন কমিটি জানায়, গত ৪ এপ্রিল নির্ধারিত তারিখে একটি বন্ডের অর্থ দেওয়ার সময় এতে নির্ধারিত অতিরিক্ত সুদ পরিশোধ করতে পারেনি রাশিয়া। সহসা কোনো পদক্ষেপ নিলে বন্ডের পরবর্তী কিস্তি পরিশোধে তা প্রভাব ফেলবে এই অনিশ্চয়তা থাকায় তখন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত ছিল কমিটি।
বিনিয়োগকারীরা কী করতে পারেন?
বন্ড মালিকদের প্রতি ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতা মূল অঙ্কের ২৫ বা তার বেশি হলে এবং তারা যদি অর্থ পাননি বলে অভিযোগ করেন, তখন তা আনুষ্ঠানিকভাবে খেলাপি ঘোষণার প্রচলিত ব্যবস্থা আছে। এরপর ঋণ পরিশোধে আইনি বাধ্যবাধকতা চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন বন্ড ক্রয়কারীরা।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, খেলাপি হওয়া সরকার ও তার বন্ডে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ঋণ পরিশোধ নিয়ে তখন আলোচনা শুরু হয়। আলোচনা সফলে হলে পর বন্ড ক্রয়কারীদের নতুন বন্ড দেওয়া হয়। এই বন্ডের লভ্যাংশ যেটি পরিশোধে সরকারটি আগে ব্যর্থ হয়েছে তার চেয়ে কম হয়—তবে তা সত্ত্বেও বিনিয়োগকারীরা আংশিক ক্ষতিপূরণ পান এ ব্যবস্থায়।
কিন্তু, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে এ ধরনের লেনদেনও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাছাড়া, ইউক্রেন যুদ্ধ শেষের কোনো লক্ষণ নেই, ততোদিনে খেলাপি হওয়া বন্ডের মূল্য কমে কোথায় দাঁড়াবে তাও অজানা।
এক্ষেত্রে খেলাপি ঘোষণা এবং মামলা করা 'সুবিবেচনাপ্রসূত উপায় হবে না' বলে মন্তব্য করেন ওসল্যান্ডার। তিনি আরও বলেন, রাশিয়ার সাথে আলোচনা করা এখন সম্ভব নয়। অজানা রয়েছে আরও বহু বিষয়। তাই ঋণদাতারা আপাতত অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
রাশিয়ার খেলাপি হওয়ার প্রভাব কেমন হবে?
যুদ্ধ শুরুর পর মস্কোকে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেক বিদেশি কোম্পানি রাশিয়ায় ব্যবসাপাতি গুটিয়ে বিদায় নিয়েছে। এতে বাকি বিশ্বের সাথে আর্থিক সম্পর্ক অনেকটাই ছিন্ন হয়েছে দেশটির। এই বিচ্ছিন্নতা ও আলাদা হয়ে পড়ার আরেকটি লক্ষণ হয়ে উঠতে পারে ঋণ খেলাপি।
ইতঃপূর্বে ১৯৯৮ সালে অভ্যন্তরীণ উৎসের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয় রুশ সরকার। এতে আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার ও সংস্থাগুলোর ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হয় বর্তমান খেলাপি তেমন প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন বিনিয়োগ বিশ্লেষকরা। তবে একথা তারা বলছেন যথেষ্ট সতর্কতার সাথে। বিপরীত পরিস্থিতিকেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
১৯৯৮ সালে রাশিয়ার স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা রুবল-ভিত্তিক বন্ডের সুদ-আসল পরিশোধে খেলাপি সৃষ্টি হলে বৃহৎ মার্কিন হেজ ফান্ড লং-টার্ম ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট দেওলিয়াত্বের ঝুঁকিতে পড়ে। এই সংস্থা দেওলিয়া হলে বৃহত্তর আর্থিক ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভিত্তি দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন সরকার উদ্যোগী হয়ে ব্যাংকগুলির সাহায্যে সংস্থাটিতে অর্থের যোগান দেয়।
বণ্ড মালিকেরা বিশেষত উদীয়মান বাজারের বন্ডে বিনিয়োগকারী তহবিলগুলি মারাত্মক লোকসানের শিকার হতে পারে। তবে উদীয়মান বাজারের বন্ড বিক্রির সার্বিক সূচকে রাশিয়ার অংশগ্রহণ সামান্যই। তাই তহবিল-ভিত্তিক বিনিয়োগকারীদের লোকসান হলেও তা তুলনামূলকভাবে কম হবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর তহবিল ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিইয়েভা মনে করেন, বৈশ্বিক পর্যায়ে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্য চরমে পৌঁছে দিয়ে চরম মানবিক দুর্ভোগের জন্ম দিচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ। সে তুলনায় রুশ সরকারের তার বৈদেশিক বন্ডের খেলাপি হওয়ার ঘটনা 'নিশ্চিতভাবেই বিশ্ব ব্যবস্থায় ততোটা প্রাসঙ্গিক হবে না।'
- সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস