যেভাবে ভারতের বিচার বিভাগ এখনও জনগণের আশা জাগিয়ে রেখেছে
দুটি আলাদা মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সূর্যকান্ত- গত এক সপ্তাহের মধ্যে সমগ্র ভারত এমনকী সমগ্র পৃথিবীর সামনে গুরুত্ব সহকারে উপস্থিত হয়েছেন। ভারতের সর্বশেষ সাম্প্রদায়িক উষ্কানির মূল হোতা নূপুর শর্মা তার নিরাপত্তার প্রশ্নে- এক আদেশের জন্য আদালতের শরণাপন্ন হলে বিচারপতি সূর্যকান্ত ও বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালার সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ মৌখিক পর্যালোচনায় বলেছে, তার (নূপুর শর্মা) উচিত পুরো দেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া। তিনি একাই দেশকে অগ্নিগর্ভ করে তুলেছেন।
বিচারপতিরা বলেছেন, 'যেভাবে তিনি দেশজুড়ে মানুষের আবেগ উসকে দিয়েছেন, দেশে যা ঘটছে সেজন্য এককভাবে এ নারী দায়ী।' একইসাথে সুপ্রিম কোর্টের এই বেঞ্চ দিল্লি পুলিশকেও ভর্ৎসনা করে প্রশ্ন তুলে বলেছে, "আপনারা কী করেন?"
গত মে মাসে এক টেলিভিশন আলোচনায় নূপুর শর্মা যেভাবে ইসলামের নবীকে নিয়ে কথা বলেছেন- তা আমরা দেখেছি বলে মন্তব্য করেছেন আদালত। তার এই দায়িত্বহীন মন্তব্যের কারণে মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম প্রধান দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্ক হুমকির মধ্যে পড়ে এবং সেখানকার ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনের কর্তাদের তলব করে নূপুর শর্মার মন্তব্যের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। বিচারপতি সূর্যকান্তের আদালত আরও বলেন, তিনি (নূপুর শর্মা) একাই সবাইকে নিরাপত্তাহীন করে তুলেছেন, দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। আদালত দিল্লির পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'আপনারা কি করছেন আমরা দেখছি। আমাদের মুখ খুলতে বাধ্য করবেন না'।
ঘটনা দুই
মহারাষ্ট্রের শিবসেনা সরকারের ৩৫ জন বিধায়কের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি অনাস্থা। মহারাষ্ট্রে বিজেপি দীর্ঘকাল যাবত সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করে আসছিল। রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস ও শারদ পাওয়ারের ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস দলের সমর্থিত শিবসেনা সরকারকে পাল্টে দিয়ে, বিজেপি তার অনুসারী সরকার গঠন করার চেষ্টা করছিল। সে বিষয়ে শিবসেনার মধ্যে যে ভাঙ্গন দেখা দেয় বিচারপতি সূর্যকান্ত সেই আস্থা ভোটের পক্ষে একটি আদেশ প্রদান করেন। ফলে মুখ্যমন্ত্রী উদয় ঠাকরেকে পদত্যাগে বাধ্য হয় এবং মহারাষ্ট্রে শিবসেনা শাসিত নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা পায়। তারা মূলত বিজেপির অনুসারী হিসেবেই পরিচিত । ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে এই ধরনের দল পরিবর্তনের মাধ্যমে বিজেপির সমর্থন প্রাপ্তিটা অনেক জরুরি ছিল। কারণ রাষ্ট্রপতি ভোটে এই বিধায়করা ভোট দেবেন। এবারকার ভারতীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হাডাহাড্ডি লড়াইয়ের যে সম্ভাবনা উকি দিচ্ছিল- আরো দুই-একটি বিষয়ের সঙ্গে মহারাষ্ট্রের সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে সে সম্ভাবনা বাতিল হল।
বেশ কিছুকাল যাবৎ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক নানান বিষয়ের সিদ্ধান্ত ও মতামত বিশ্বগণমাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সামনে দেশের রাষ্ট্রদ্রোহী আইন বিষয়ক একটি মামলার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট এর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ সরকারের সলিসিটার এর ব্যাখ্যা আবেদন খারিজ করে দিয়ে সরাসরি তাদের ১৮৬০ সাল থেকে চালু হওয়া রাষ্ট্রদ্রোহী আইন স্থগিত করে দিয়ে একটি আদেশ প্রদান করে। যে আদেশের অর্থ হচ্ছে, এ আইনে আটক সকলকে জামিন দিতে হবে এবং এই আইনে নতুন করে কোন মামলা করা যাবে না- যতদিন পর্যন্ত না সরকার আইনটি পুনর্গঠন করেন।
এরপরের যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে বিশ্ব গণমাধ্যমের দৃষ্টি নিবন্ধিত হয়েছিল তা ছিল- ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় মোদি সরকারের দায়মুক্তির আদেশ। ২০০২ সালে জাফর জাফরি নামক কংগ্রেস দলীয় একজন সংসদ সদস্যকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। প্রায় হাজারখানিক মুসলিম সেই দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন। গুজরাট দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছিল গোধরা ট্রেনের অগ্নিসংযোগ এর ঘটনা থেকে। যেখানে বিজেপি কর সেবকরা ট্রেনে করে বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত এক কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছিল। সেই অগ্নিসংযোগে বেশ কিছু হিন্দুও তখন নিহত হয়েছিল। এমনি সমস্ত ঘটনার দায়মুক্তি দিয়েছিল বর্তমান সুপ্রিম কোর্ট নরেন্দ্র মোদিকে।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এমনি নানান বিষয়ে নানান মতামত দেশটির অভ্যন্তরে ও বিদেশে আলোচিত-সমালোচিত হয়। তবুও ভারতীয় জনগণকে আশার সঞ্চালন করেন বিচার বিভাগ, যে বিভাগের ওপর একটি নির্ভরশীলতা এখনও ভারতীয় জনগণের আছে। কিন্তু এর পাশাপাশি উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোতে কী অবস্থা চলছে তা একটি বড় প্রশ্ন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি আদেশ বহুকাল নির্বাহী বিভাগ অনুসরণ করে চলছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পদে নিযুক্তির ক্ষেত্রে একমাত্র যোগ্যতা জ্যেষ্ঠতা উচ্চ আদালতের একটি রায় বলা আছে। আমাদের দেশের উচ্চ আদালতের রায় বলা আছে, 'জ্যেষ্ঠতাই একমাত্র যোগ্যতা নয়'।
সাম্প্রতিক পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে ২০১২-১৩'তে সংগঠিত কিছু ঘটনার বিবরণ দিতে যেয়ে জার্মানিতে নিযুক্ত আমাদের রাষ্ট্রদূত, সেই সময়কার সেতুসচিব এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন দৈনিক সমকালে। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি গ্রেফতার হওয়া থেকে জামিন পাওয়া পর্যন্ত যে বিবরণ দিয়েছেন- তাতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। সরকারের নির্বাহী বিভাগের সরাসরি হস্তক্ষেপে কীভাবে তার জামিন প্রদান করা হয়- তার বিশদ বিবরণ ঐ সাক্ষাৎকারে রয়েছে। গত ২৬ জুন পত্রিকাটি সেটি প্রকাশ করে। সরকারের উচ্চপদের কোনো ব্যক্তির সাক্ষাৎকার জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। তবে এটা ঠিক, রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে অনেক সময় নির্বাহী বিভাগকে নানা কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। রাষ্ট্রের সেসব কৌশল জনসম্মুখে প্রকাশ না হওয়াটাই বাঞ্চনীয়। তা হলে মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং রাষ্ট্রের আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ প্রতিটি অঙ্গ স্বাধীন এবং প্রভাবমুক্ত আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূলমন্ত্র সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক