পোশাক শ্রমিকদের জন্য আর দূরে নয় আইনি সুরক্ষা
রাজধানীর অদূরে টঙ্গীর ব্র্যাক আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রগ্রামের আওতায় পরিচালিত দ্বিতল ভবনের ছোট একটি রুমে রবিবার তিন বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে আইনি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলছিলেন পারুল আক্তার। তিনি একসময় তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন।
পারুল আক্তারের অভিযোগ, স্বামী তার খোঁজ নেন না, ভরণপোষণ বহন করেন না বরং যৌতুক দাবি করেছেন। এই অফিসে আসার পর আইনি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেও সমাধান না পাওয়ায় প্রায় এক বছর আগে গাজীপুরের জজ কোর্টে মামলা করেন। ওই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে স্বামী জেল খেটে কিছুদিন আগে জামিন পান। এখন আলোচনা করছেন, পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে।
তার মতোই খাদিজা আক্তার নামে আরেকজন নারীও নিজের ও সন্তানের ভরণপোষণ না দেওয়ার অভিযোগ করার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
কেবল এ দুই নারীই নন, এই কেন্দ্রে গত তিন বছরে এ ধরণের ৯০টি অভিযোগ এসেছে। যার মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে, অভিযোগকারী ও অভিযুক্তের সম্মতিতে ৫০টি অভিযোগের সালিসি পন্থায় (অলটারনেটিভ ডিসপ্যুট রিজল্যুশন বা এডিআর) সমাধান হয়েছে। ১০টি অভিযোগ সমাধান না হওয়ায় তা আদালতে গড়ায়, যার মধ্যে কয়েকটির ইতিমধ্যে সমাধান হয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রগ্রামের আওতায় ঢাকার বস্তিগুলোতে বসবাসরত পোশাক খাতের শ্রমিকদের এ সেবা দেওয়া হচ্ছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এই প্রকল্পের আওতায় শ্রমিকদের বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ সেবা দেওয়া হয়। এছাড়া আদালতে মামলা হলেও বাদীর পক্ষে বিনামূল্যে এই সেবা দেওয়া হচ্ছে।
রবিবার টঙ্গীতে ব্র্যাকের এই প্রকল্প অফিস ও এখানকার কার্যক্রম সম্পর্কে সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আইনি পরামর্শ সেবার বাইরেও আরো কয়েকটি কার্যক্রম চালাচ্ছে এই অফিস থেকে।
পারুল আক্তার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গত তিন বছর ধরে স্বামী তার খোঁজ নেন না। শিশু সন্তানটিকে নিয়ে তিনি এখন বাবা, মায়ের কাছে থাকছেন। তিনি চান, স্বামী সংসারের দায়িত্ব নিতে না চাইলে তার দেনমোহরের পাওনা পরিশোধ করুক। এজন্য মামলা করেছেন। তিনি বলেন, আইনি সহায়তার জন্য এই অফিস তার কাছ থেকে কোন টাকা নিচ্ছে না।
কেন্দ্রটির লিগ্যাল কো-অর্ডিনেটর শেখ আহমাদুল কায়সার এই প্রতিবেদককে বলেন, ফৌজদারি ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে তারা উভয়পক্ষের মধ্যে এডিআর এর মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করেন, যাতে ভালো ফল এসেছে। আর ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে বাদীকে আইনি সহায়তা দেন।
সালিসি পন্থায় সমাধানের ৬ মাস পর তারা দেখেছেন, ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে তা টেকসই হয়েছে।
ব্র্যাকের এ কর্মসূচীটির প্রোগ্রাম ম্যানেজার এসকে মজিবুল হক বলেন, ২০১৮ সালের পর থেকে এ প্রকল্পের আওতায় চলমান তিনটি সেন্টারে এ পর্যন্ত ৩০১৫ জনকে আইনি পরামর্শ সেবা দিয়েছেন। যার মধ্যে ১০৮টি অভিযোগ বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি তথা এডিআরে সমাধান হয়েছে। ৩০টি ক্ষেত্রে আদালতে মামলা হয়েছে, যার দুই-তৃতীয়াংশ সমাধান হয়েছে। বাদবাকি ক্ষেত্রে তারা কেবল আইনি পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি জানান, এই প্রকল্পের অধীনে একই স্থানে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারের মাধ্যমে আইনি সহায়তা ছাড়াও তারা ছয় ধরণের সেবা দিয়ে থাকেন। এগুলো হলো মৌলিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান, অনলাইনে স্বাস্থ্য, আইনি ও সাইকোলজিক্যাল সার্ভিস, প্লে ল্যাব কাম ডে কেয়ার এবং জাতীয় স্তরের অ্যাডভোকেসি সেবা।
২০১৭ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ডিসেম্বরে। প্রাথমিকভাবে ৫০ হাজার মানুষকে এই প্রকল্পের মাধ্যমে সেবা দেওয়ার টার্গেট থাকলেও গত ডিসেম্বর নাগাদ এই সংখ্যা ৫৭ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সেবা নিয়েছে হেলথ কেয়ার সার্ভিসে, প্রায় ৪০ হাজার।
এছাড়া এখন পর্যন্ত প্রায় ২৪০০ মানুষ প্রতিষ্ঠানটি থেকে স্কিলস ট্রেনিং নিয়েছে, যার মধ্যে ৯৮ শতাংশই পরবর্তীতে বিভিন্ন কারখানায় কাজ পেয়েছে। তবে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিনা অর্থে ট্রেনিং দিলেও এরপর থেকে ১০০০ টাকা করে ফি নেওয়া হয়।
এসকে মজিবুল হক জানান, প্রতিষ্ঠানটি এই প্রকল্পের ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারের মাধ্যমে দেওয়া সেবা নিয়ে একটি গবেষণা করে দেখেছে, ৯০% উত্তরদাতা এই কার্যক্রমে তাদের সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।