লোডশেডিং শুরু আজ থেকে, রাত ৮টায় বন্ধ করতে হবে শপিং মল
এক ঘন্টার লোডশেডিং, ডিজেল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ এবং প্রতিদিন রাত ৮টা নাগাদ দোকানপাট ও বাজার বন্ধ করা বাংলাদেশের জন্য নয়া-বাস্তবতায় পরিণত হতে চলেছে।
জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে সরকারের এমন পদক্ষেপের ইঙ্গিত আগেই দেওয়া হয়েছিল।
এর আওতায় ঘোষিত পদক্ষেপের মধ্যে, আগামীকাল থেকে এক সপ্তাহব্যাপী লোডশেডিং করা হবে দেশের প্রতিটি এলাকায়। নির্ধারিত সময়ে বন্ধ হবে দোকানপাট ও বাজার। পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হবে দেশের ২.৭৯ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহকারী ডিজেল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি। লোডশেডিংয়ের সময়ও তার ফলে বাড়ার সম্ভাব্যতা রয়েছে।
সোমবার (১৮ জুলাই) বিকেলে সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, 'এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করে পরের সপ্তাহে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বাড়ানো বা কমানো হবে। এ ছাড়া, ডিজেল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সপ্তাহে একদিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখায় জ্বালানি আমদানি ২০ শতাংশ কমবে।'
এসব পদক্ষেপের আওতায় মন্দির, মসজিদসহ ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রার্থনার সময় ছাড়া অন্য সময়ে শীতাতপ যন্ত্র (এসি) বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। তবে কবে নাগাদ দেশ এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে- তা সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে পারেননি কর্তৃপক্ষ।
বিদ্যুৎ খাতের সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, শীতকাল এসে বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা না কমা পর্যন্ত আগামী চার মাস এসব বিধিনিষেধ কার্যকর থাকতে পারে।
সরকারের দৈনিক লোডশেডিং করা ও বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে সাধারণ ভোক্তাসহ জ্বালানির খুচরা বিক্রেতা, বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদক খাত, টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্প ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে পড়বে।
বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদকদের সমিতি- বাংলাদেশ ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার অ্যাসোসিয়েশন (বিপ্পা) এর সভাপতি ইমরান কবির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ডিজেল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখায় তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম প্রভাবিত হবে, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প উপায়ও নেই।
'মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান অবমূল্যায়ন হওয়ায় এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানির দর বেড়ে যাওয়ায় আমরা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এই সংকটকালে আমরা ব্যবসা বা লাভের কথা নয়, বরং দেশের স্বার্থের কথাই ভাবছি'।
বিশ্বের অনেক দেশই বিদ্যুৎ আর জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে, বাংলাদেশের সামনেও এমনটা করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু, সরকার সে পথে না গিয়ে ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে জ্বালানি সাশ্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পেট্রোল পাম্প মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ নজরুল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন যে, সরকারের নেওয়া যেকোনো সিদ্ধান্ত তারা মেনে চলবেন।
সোমবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, ডিজেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখায় এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি হবে।
তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, 'বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হছে। আজ (১৮ জুলাই) থেকে এর আওতায় ডিজেল-চালিত কেন্দ্রগুলি বন্ধ রাখা হচ্ছে'।
'এতে ১,০০০-১,৫০০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি হবে। এজন্য দৈনিক এলাকা-ভিত্তিক ১-২ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হবে'।
বর্তমান সংকটকে 'যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা'র সাথে তুলনা করে তিনি আরও জানান যে, 'রাত ৮টার মধ্যেই দোকানপাট, শপিং মল বন্ধ করতে হবে'।
জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, 'যারা এসব নির্দেশনা অমান্য করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মসজিদ ও অন্যান্য উপাসনালয়ে প্রার্থনা ছাড়া অন্য সময় এসি চালানো যাবে না। সরকারি অফিসের সময় কমানো হবে এবং অনলাইনে সভা আয়োজন করা হবে'।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, 'গ্রাহকদের আগে থেকে লোডশেডিং এর সময়সূচী জানানো হবে। যানবাহনে যাতে তেল কম ব্যবহার হয় সে পদক্ষেপও নেওয়া হবে'।
বর্তমানে ডিজেল-চালিত কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ৩০ টাকা, ফার্নেস অয়েল-চালিত কেন্দ্রের ১৬ টাকা এবং গ্যাস-চালিত কেন্দ্রে ১.৫ থেকে ২ টাকা।
নসরুল হামিদ বলেন, 'ডিজেলের ব্যবহার কমালে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, যা এই মুহূর্তে অনেক বড় বিষয়'।
বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট চলমান থাকায় সরকার দোকানপাট ও বাজার ৮টার মধ্যে বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে বলেও জানান তিনি। 'বিদ্যুৎ বিভাগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলির সাথে সমন্বয় করে বিষয়টি মনিটর করবে এবং যারা নির্ধারিত সময়ের পর দোকান খোলা রাখবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে'।
'রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরকার এসব পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদি হবে না। আমাদের আরও সাশ্রয়ী হতে হবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে'।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে এখন আরও ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা দেখা দিবে, কারণ বিদ্যুতের দৈনিক উৎপাদন গড়ে দুই হাজার মেগাওয়াট কমেছে।
রাজধানীর বাইরে পরিস্থিতি আরও শোচনীয়।
সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত জেলাগুলো হলো ময়মনসিংহ বিভাগে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, ফেনী ও চাঁদপুরেও লোডশেডিং বেড়েছে।
বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চল জানিয়েছে, মঙ্গলবার চট্টগ্রাম ও আশপাশের এলাকায় লোডশেডিং সংক্রান্ত বিস্তারিত সময়সূচি প্রকাশ করবে।
বিপিডিবি চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, 'সরকারি নির্দেশনা পাওয়ার পর পরই আমরা লোডশেডিং শিডিউল তৈরির কাজ শুরু করি। তবে আমরা আশা করছি, মঙ্গলবার বিকেলের মধ্যে লোডশেডিংয়ের বিস্তারিত সময়সূচির কাজ শেষ করতে পারব'।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর গ্যাস সংকটে আক্রান্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার ঘটনা আর বিরল নয়। বেশিরভাগ দেশই এখন সঠিক লোড ব্যবস্থাপনার দিকে ঝুঁকছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান জ্বালানি সরবরাহের একটি সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত লোড ব্যবস্থাপনা মানুষের দুর্ভোগ কমাতে পারে। কর্তৃপক্ষের অন্য কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ না থাকায়, লোড ব্যবস্থাপনাকেই গ্যাস ও বিদ্যুতের চলমান সরবরাহ বিচ্ছিন্নতা মোকাবিলার একমাত্র উপায় বলছেন তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস স্থাপনা বন্ধ হওয়ার পরের সপ্তাহগুলোয় ইউরোপ এবং এশিয়ায় গ্যাসের দাম ৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। গত বছরের শুরু থেকে গ্যাসের দাম বাড়ছে, ইউরোপে তা ৭০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
জার্মান সরকার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, গ্যাসের ঘাটতি লেহম্যান ব্রাদার্সের মতো বিপর্যয় ঘটাতে পারে। ব্লুমবার্গের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসা এবং ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুৎ ঘাটতির অভাবনীয় ঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছে ইউরোপের অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্রটি।
জার্মানিতে রাশিয়ান গ্যাস বহনকারী প্রধান উৎস নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইন। গত ১১ জুলাই থেকে এটি সারাই কাজের জন্য ১০ দিন বন্ধ রাখা হয়েছে। মস্কো এটিকে আবার নাও খুলতে পারে এমন আশঙ্কা বাড়ছে বার্লিনের।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৫১.৪৯% বিদ্যুৎ আসে গ্যাস থেকে, ১৮.৯০% ফার্নেস অয়েল থেকে, ১৪.৯৮% কয়লা থেকে, ০.৫৬% জলবিদ্যুৎ থেকে, ০.৩৭% নবায়নযোগ্য উৎস থেকে এবং ১০ শতাংশ আমদানি করা হয়।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমলে, কেবল তখনই প্রকৃত চাহিদা মেটানোর উদ্যোগ নেওয়া একমাত্র সমাধান।
বাংলাদেশ বর্তমানে জ্বালানি চাহিদার প্রায় ৯১ থেকে ৯২ শতাংশ আমদানি করছে। বাকিটা স্থানীয় গ্যাস ক্ষেত্র থেকে পাওয়া যায়।
বিপিসি বলছে, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেল (ক্রুড) আমদানি করতে প্রতি মাসে তাদের প্রায় ৫৬০-৬৯৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ১৬-১৭টি ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হবে।
২০২০-২১ অর্থবছরে, ডিজেল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি প্রায় ১ লাখ ৪৩ হাজার টন জ্বালানি পোড়ায়, এসময় দেশে ডিজেলের মোট ব্যবহার ছিল ৪৫ লাখ ৯৭ হাজার টন।